বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের মধ্য অসংখ্য দল ও মতের উদ্ভব ঘটেছে। যথা শিয়া, সুন্নী, খারেজী, রাফেজী, কাদিয়ানি, ওহাবী ইত্যাদি। রাসুল (স) ফরমান "আমার পূর্ববর্তী নবীদের আমলে ৭২ ফেরকা ছিল, কিন্তু আমার উম্মতের মধ্য ৭৩ ফেরকা বা দল হবে, এখ ফেরকা জান্নাতি আর ৭২ ফেরকা জাহান্নামী হবে"
আজ যদি বিশ্বের মুসলমানদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় তাহলে দেখা যায়-নানাবিধ দল ও মতের কারনে তাদের মধ্য শান্তি নেই। কোন মতবাদটি সঠিক আর কোনটি সঠিক নয় তা যাচাই না করে বরং নিজেদের মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুসলমানদর মধ্য দন্দের শেষ নেই। কোন কোন দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগন স্বার্থের জন্য ইহুদী ও খ্রিস্টানদের চর হিসেবে কাজ করে নিজেদের ধর্মকে পর্যন্ত বিকৃত করতে দ্বিধাবোধ করেনি। এমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন ওহাবী মতবাদের জনক জনাব মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব নাজদী। তিনি ব্রিটিশদের যোগসাজসে ইসলামকে বিকৃত করে একটি নতুন মতবাদের জন্ম দিয়েছেন, ইহাই ওহাবী মতবাদ নামে পরিচিত। আরবের নাজদ প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব নাজদী। নজদের 'হুরাইমিলা নামক স্থানে ১১১১ হিজরী সনে (১৬৯৬ খ্রি) তিনি জন্ম গ্রহন করেন এবং ১২০৬ হিজরী (১৭৮৭ খ্রি) মারা জান। নজদ প্রদেশটির প্রতি রাসূল (স) খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন, তিনি অন্যান্য এলাকার জন্য দোয়া করেছেন বটে কিন্তু 'নজদ' এলাকার জন্য কখনো দোয়া করেন নি। " হযরত ইবনে ওমর (র) হতে বর্নিত আছে যে রাসূল (স) বলেছেন-হে আল্লাহ! আমাদের শাম (সিরিয়া) ও ইয়েমেন দেশে বরকত দান কর। উপস্থিত সাহাবগন 'নজদ' দেশের জন্য পর পর ৩ বার দোয়া করতে আবেদন করলে, রাসূল (স) বলেন- নজদ দেশে নবতর ফেতনা রয়েছে এবং নজদ হতে শিংযুক্ত শয়তান বের হবে। (বোখারী )
রাসূল (স) এর হাদীস মি্থ্যা হতে পারেনা। পরবর্তীকালে 'নজদ' প্রদেশ হতে মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব নামে এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যিনি বিধর্মীদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ইসলামের মধ্য এক চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। ওহাবী মতবাদের জনক ওহাব নাজদী ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার 'হামফ্রে' এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। 'হামফ্রে' তুরস্কের শায়খ আফিন্দির নিকট ছদ্মবেশী মুসলমান সেজে কোরান ও হাদীস চর্চা করে ওহাব নাজদীর একান্ত বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে পরিগনিত হয়। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয় নিয়ে তাদের মধ্য যে আলোচনা হয় তা 'হামফ্রে' তার 'হামফ্রেজ মেমোরিজ'১ নামক ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করেন।
{ পাদটীকা ১- মাসিক তরজুমান পত্রিকায় ( আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ সংখ্যা) আব্দুল ওহাব নাজদী প্রসংগটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন জনাব লোকমান আহমদ আমিনী। নিবন্ধটি 'হামফ্রেজ মেমোরিজ" নাম শিরোনামে প্রকাশিত হয়}
জনাব 'হামফ্রে' এর ডায়রিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জার্মানীর হস্তগত হয়, তখন জার্মান পত্রিকা 'ইসপগিল' তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে। এতে ব্রিটিশদেরকে বিশ্ব সমাজের নিকট অনেক লজ্জিত হতে হয়। ডায়রিটি ফরাসী পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। জনৈক লেবাননী বুদ্ধিজীবী তা আরবীতে অনুবাদ করেন।
হামফ্রে লিখেছেন-আমি যখন তরখানের কাজে নিয়োজিত ছিলাম তখন একজন লোকের সাথে আমার সাক্ষাত হয়, তিনি সেখানে যাতায়াত করতেন এবং তুর্কী, ফারসী এবং আরবী ভাষায় কথা বলতেন। তিনি দ্বীনি তালেব ইলমের পোশাক পরিধান করতেন। তার নাম হলো মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব। তিনি উচ্চাভিলাষী, সম্মানাকাংখী এবং ধোপ দুরস্ত লোক ছিলেন। উসমানী সরকারের প্রতি অত্যন্ত ঘৃনা পোষন করতেন ও সর্বদা তার সমালোচনা করতেন। কিন্তু ইরান সরকারের সাথে তার কোন যোগাযোগ ছিলনা। তরখান আব্দুর রেজার সাথে তার বিশেষ সম্পর্কের কারন হলো উভয়েই উসমানী খলিফাকে নিজের পরম শত্রু মনে করতেন। কিন্তু এটা আমার বোধগম্য হয়নি যে, তিনি কি কারনে আব্দুর রেজার সাথে বনদ্ধুত্ব গড়ে তুললেন কারন দুজন ছিলেন দুই মতাবলম্বী ( একজন শিয়া আরেকজন সুন্নী )। আমি এটাই জানতে পারিনি তিনি ফার্সী ভাষা কোথায় শিখলেন। অবস্য বসরায় শিয়া সুন্নীরা এক ছিল। সেখানে আরবী ও ফার্সী উভয় ভাষার প্রচলন ছিল।
আব্দুল ওহাবের ধ্যন ধারনা-আবদুল ওহাব স্বাধীনচেতা লোক ছিলেন। তার মন শিয়া সুন্নীর পক্ষপাতিত্ব মুক্ত ছিল। অথচ সেখানকার বেশীরভাগ সুন্নীই শিয়া বিরোধী ছিলেন। আবার কোন সুন্নী মুফতী শিয়াদের কাফের বলে অভিহিত করতেন। আব্দুল ওহাবের দৃষ্টিতে হানাফী, সাফেয়ী, হাম্বলি ও মালেকী শিক্ষা কেন্দ্রের কোনটিরই বিশেষ কোন গুরুত্ব ছিলনা, তার বক্তব্য ছিল আল্লাহতায়ালা কোরান মজীদে যা বলেছেন তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব কোরান হাদীস চর্চা করেছেন। স্বীয় অভিমতের পক্ষে ইসলামী জ্ঞান বিশারদের মতামত প্রমান হিসেবে পেশ করতেন। কিন্তু কোন কোন সময় তার চিন্তাধারা প্রখ্যাত আলেমদের বিপরীত অর্থে হতো। তিনি কথায় কথায় বলতেন রাসূল (স) শুধু কিতাব ও সুন্নতকে অপরিবর্তনীয় বিধান করে আমাদের জন্য পেশ করেছেন। তিনি কখনো বলেন নি যে, সাহাবায়ে কেরাম ও আইয়ামে দ্বীনের বর্ননা অটল এবং অবতীর্ন ওহীর শামিল। আমাদের জন্য কিতাব ও সুন্নতের অনুসরন করাই শুধু ওয়াজিব। উলামা চার ইমাম, এমনকি সাহাবাদের মতবাদ যাই হোক না কেন তাদের ইখতিলাফের দ্বারা দ্বীনকে মজবুত করার দরকার নেই।
একদিন ইরান থেকে আগত জনৈক আলেমের সাথে খাবার টেবিলে তর্ক শুরু হয়ে গেল। সে আলেমের নাম ছিল শায়খ জাওয়াদ কুম্মী। তিনি আব্দুর রেজা তরখানের মেহমান ছিলেন। শায়খ জাওয়াদ কুম্মীর সাথে আব্দুল ওহাবের মৌলিক মতভেদ ছিল। তাদের কথাবার্তা শিঘ্রই তিক্ততার রুপ গ্রহন করে। শায়খ কুম্মী আব্দুল ওহাবকে বললেন "তুমি যদি স্বাধীন চিন্তার লোক হও, নিজের দাবী অনুযায়ী যথেষ্ট লেখা পড়া করে থাক, তবে কেন শিয়াদের মত হযরত আলী (র) কে সম্মান প্রদর্শন করনা?' আব্দুল ওহাব উত্তরে বললেন " হযরত উমর (র) ও অন্যান্যদের মত তাদের কথা আমার কাছে প্রমান নয়, আমি শুধু কিতাব ও সুন্নতকে মানি" কুম্মী- আচ্ছা তুমি যদি সুন্ণতের অনুসারী হয়ে থাক তবে কি রাসূল (স) বলেন নি যে " আমি জ্ঞানের শহর আর আলী (র) তার দরজা" একথা বলে কি আলী (র) ও অন্যান্য সাহাবাদের মধ্য পার্থক্য করেন নি? আব্দুল ওহাব- যদি ব্যপার এরকমই হয় তবে রাসুল (স) এর বলা উচিত ছিল " আমি তোমাদের নিকট দুটি জিনিষ রেখে গেলাম- একটি কিতাব ও দ্বিতিয়টি আলী (র)" কুম্মী- নিশ্চই রাসূল (স) এ কথাও বলেছেন আমি তোমাদের মধ্য কিতাব ও আহলি বাইতকে রেখে গেলাম" নিশ্চই আলী (র) আহলে বাইত এর মাঝে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আব্দুল ওহাব এ হাদীসকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করলেন। কিন্তু শায়খ কুম্মী 'উসূলে কাফীর ইসনাদের' ভিত্তিতে হাদীসটির সত্যতা প্রমান করেন। তখ ওহাব নাজদী চুপ থাকতে বাধ্য হলেন। পরে তিনি বলে উঠলেন রাসূল (স) যদি আমাদের জন্য শুধু কিতাব ও আহলে বাইয়াত রেখে গিয়ে থাকেন তাহলে সুন্ণত কোথায় গেলো? কুম্মী- সুন্নত এ কিতাবের তাফসীর ওতাশরীহকে বলে অন্য কিছুকে নয়। ইবনে ওহাব-আপনার মতানুযায়ী আহলে বাইয়াত ই কালামে ইলাহীর তাফসীর, তবে হাদীসের মতন বৃদ্ধি করা হলো কেন? কুম্মী-রাসূল (স) এর ওফাতের পর উম্মতে মোহাম্মাদীকে কোরান বুঝাবার প্রয়োজন ছিল।কেননা জনসাধারন নিজের জীবনকে আল্লাহর নির্দেশনুযায়ী গঠন করতে চেয়েছিল। এজন্য পয়গম্বর (স) গায়েবী ইলমের ভিত্তিতে কিতাবে ইলাহীর মূল ধরে আর বংশধরকে কোরানের ভাষ্যকার ও কিতাবের ব্যখ্যা ঠিকমত উম্মতের নিকট পেশ করার জন্য হাওয়ালা করেছেন।ঐবনে ওহাব এরপর খাচায়বন্দী পাখির ন্যয় ছটফট করতে থাকেন।
আব্দুল ওহাবের সাথে মেলামেশা ও সাক্ষাতে বুঝতে পারলাম যে, ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যবলীকে কার্যকর করার জন্য এ ব্যক্তি অত্যন্ত উপযোগী হবে। তার উচ্চাভিলাষ, খ্যতি কামনা, অহংকার দ্বারা উলামায়ে কেরাম, মাশায়েখে ইসলাম ও সাহাবায়ে কেরামের এমনকি খোলাফায়ে রাশেদিন পর্যন্ত পর্যন্ত সমালোচনায় লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়। কোরান হাদীস থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসীল ই তার উদ্দেশ্য ছিল।
আমি চিন্তা করলাম কোথায় এ অহংকারী যুবক আর কোথায় ইস্তাম্বুলের সেই আহামদ আফেন্দী।হানাফী মাযহাবের অনুসারী সে বৃদ্ধ ইমাম আবু হানীফার নাম নেওয়ার আগে ওযু করে নিত। আর আব্দুল ওহাব আবু হানিফা (র) কে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তিনি বলতেন আমি আবু হানিফার চেয়ে বেশী জানি, এবং 'সহী বোখারী বেহুদা কিতাব বৈ কিছু নয়।১
{১-আব্দুল ওহাবের রচনাবলীতে বোখারী শরীফের হাওয়ালার উল্লেখ দেখা যায়, সম্ভবত প্রাথমিক জীবনে তিনি এ ধরনের উক্তি করে থাকবেন অথবা হাফফ্রে তার প্রতি অপবাদ হিসেবে একথা লিখে থাকবেন}
আব্দুল ওহাবের সাথে হামফ্রের বন্দ্ধুত্ব লাভ-
হামফ্রে বলেন যাহোক আমি আব্দুল ওহাবের সাথে গভীর সম্পর্ক করে নিলাম এবং আমি বার বার তাকে এ কথা শুনাতাম " আল্লাহ আপনাকে হযরত আলী (র) ও হযরত উমর (র) এর চাইতে বেশী উপযুক্ত করে বানিয়েছেন। আপনি যদি রাসূল (স) এর সমসাময়িক লোক হতেন তাহলে রাসূল (স) এর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারতেন।আমি সবসময় আশা ভরা সুরে তাকে বলতাম আমি চাই ইসলামে যে বিপ্লব সাধিত হবে তা আপনার দ্বারাই হোক। আপনি এমন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ণ লোক যে আপনিই ইসলামকে অবনতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন।
আমি ইবলে আব্দুল ওহাবের সাথে ঠিক করলাম যে আমরা দুজন মজলিসে বসে উলাম, মুফাসিরীন, মাযহাব ও সাহাবাদের থেকে ভিন্ন পন্থায় নতুন চিন্তা ধারার ভিত্তিতে কোরান মজীদ নিয়ে আলোচনা করবো। আমি কোরান পড়তাম আর আয়াতের অর্থ নিয়ে মতামত প্রকাশ করতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিলযে কোন প্রকারে তাকে ইংরেজ উপনিবেশবাদী সংস্থার ফাদে জড়িয়ে দেয়া।আমি ক্রমে ক্রমে এ উচ্চাভিলাষী লোকটিকে জড়িয়ে ফেলতে লাগলাম, এমনকি তিনি বাস্তবতার উপর স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।
একদিন তাকে জিগ্গাস করলাম জেহাদ করা কি ওয়াজিব? তিনি বললেন অবশ্যই। আল্লাহতায়াল বলেছেন-কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর। আমি বললাম আল্লাহ তায়াল বলেছেন কাফের ও মুনাফেক উভয়ের সাথে যুদ্ধ করা ওয়াজিব তাহলে রাসূল (স) কেন মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধ করেন নি? আব্দুল ওহাব- জেহাদ শুধু যুদ্ধের ময়দানে নয় বরং রাসূল (স) নিজ চলাফেরা কথাবার্তার দ্বারা মুনাফেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আমি বললাম তাহলে এ অবস্থায় কাফেরদের সাথেও কথাবার্তা ও চলাফিরার দ্বারা যুদ্ধ করা ওয়াজিব। তিনি বললেন না রাসূল (স) যুদ্ধের ময়দানে তাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন। আমি রাসূল (স) কাফেরদের সাথে প্রান বাচাতে যুদ্ধ করেছেন কেনান কাফেরগন তার জানের দুশমন ছিল। আবদুল ওহাব এ কথার উপর মাথা নাড়লেন, আমি বুঝতে পারলাম আমার কাজে আমি সফল হতে চলেছি।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১১ ভোর ৫:১১