আমার বিকাশ একাউন্ট দিয়ে আমি নিজেই টাকা ভরিয়ে লেনদেন করেছি কাউকে পিনকোড না জানিয়ে; সমস্যা হয়নি। কিন্তু এর কিছুদিন পর দেখি আমার একাউন্টটি ইনাক্টিভ করা হয়েছে এবং জমানো টাকার খবর নেই। ২৪৭ নম্বরে ডায়াল করলে বলে ১৬২৪৭ নম্বরে কন্টাক্ট করুন। অই নম্বরে অনেক টাকা খরচ করে কথা বলার পর জানায় আপনার ডকুমেন্ট ভেরিফাইর জন্য এমন করা হয়েছে, আবার কাগজপত্র নিয়ে এই নম্বরে কন্টাক্ট করুন-০১৭১৩৩৮৪৩৩৪,০১৭১৩৩৮৪৩৩৭-তারা আপনাকে জানাবে কী করতে হবে কোথায় কাগজ জমা দিতে হবে ইত্যাদি।
যাহোক, ব্যাংকিং আইনে এভাবে মোবাইলে টাকা লেনদেনের কোন বৈধতাই নেই এবং আইনও নেই। থাকলে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কসহ সরকারী ব্যাংকগুলোই আগে এই ব্যাবসায় করতো।
বরং বৈধ ব্যাবসায় করছে কেবল ইসলামী ব্যাঙ্ক, ডিবিবিএল, ইউসিবিএল ব্যাঙ্কসহ কয়েকটি ব্যাংক যথাক্রমে এমক্যাশ, ডিবিবিএল ও ইউক্যাশ নামে। এরা যা করছে তাই প্রকৃত আইব্যাংকিং যা আইনী প্রক্রিয়ায়ই চলছে। এরা বিকাশের মত সুবিধা ছাড়াও বিনামুল্যে একটি ব্যাংকিং একাউন্ট খোলাসহ সহজ ব্যাংকিং সুবিধাও দেয় যা সম্পূর্ণ নিরাপদ।
তাহলে পড়ুন বিকাশের প্রতারণাঃ
‘বগুড়ার এক এজেন্টের মোবাইল নং—-০৫৭৯৭৩ । গত ৬ মার্চ এই নম্বর থেকে বাবা ৩ হাজার ৬০ টাকা পাঠায়। ৭ মার্চ টাকা তুলতে এজেন্টের কাছে গিয়ে মোবাইল ও পিনকোড দিয়ে ‘ক্যাশ আউট’ করতে বলি। এ সময় বিকাশ এজেন্টের প্রতিনিধি কিছুক্ষণ মোবাইল টিপে অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই বলে জানায়। পরে বিকাশের হটলাইনে (১৬২৪৭) কথা বলেও কোনো সমাধান মেলেনি। বাধ্য হয়ে আজ কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে এসেছি। কাস্টমার কেয়ার থেকে বলা হচ্ছে— আমার অ্যাকাউন্ট থেকে আমি নিজেই নাকি —-২৭৮২৭০ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। যে নম্বরে টাকা গেছে সেখানে ফোন করলে হুমকি শুনতে হচ্ছে। ওই নম্বর থেকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে ‘বাড়াবাড়ি’ না করার জন্য ।’ এসব কথা বলেন কুমিল্লা থেকে বিকাশ কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে আসা হোসেন নামের এক চাকরিজীবী।
কৃষি মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন আবু তাহের। তিনি বলেন, আমার ছেলে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ৩ হাজার ৬শ টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু গত ১ মাস ঘুরেও সে টাকা ক্যাশ আউট করতে পারিনি। বিকাশ কাস্টমার সেন্টারে এসে একাধিকবার অভিযোগ-আবেদন করেও কোনো ফল মেলেনি।
শুধু হোসেন আর তাহেরই নয়, বিকাশের এজেন্টরাও প্রতারিত হচ্ছেন। অর্থমন্ত্রণালয় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতারণার বিষয়টি অবহিত করার পরও কিছুই হচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মহাখালী প্যারাগন হাউসের চতুর্থ তলায় বিকাশ কাস্টমার কেয়ারে কথা হয় প্রতারিত বেশ কয়েক জনের সঙ্গে। তাদের সকলেরই অভিযোগ— মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে টাকা আদান প্রদানের ব্যবসা করছে ‘বিকাশ’। অথচ গ্রাহককে ‘টাকা প্রাপ্তি’র নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদ বর্তমানকে বলেন, ‘টাকা হারানোর অভিযোগ এখন অনেক। কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ, গ্রাহকের ফোন থেকেই আবার অন্য নম্বরে টাকা পাঠানো হয়েছে। ফলে টাকা ট্রান্সফারের বিষয়টি প্রতারণা কিংবা অসাবধানতাবশত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর দায়ভার গ্রাহকেরই।’ অভিযোগ নেয়া ও সমাধান প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা অভিযোগ নিচ্ছি, কিন্তু সব অভিযোগের সমাধান দিতে পারছি না। কারণ, টাকা হাতানো অনেক নম্বরই বন্ধ হয়ে গেছে।’ সমাধান না পেলে বিকাশের উপর থেকে গ্রাহকের আস্থা কমবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন মেনেই ব্যবসা চলছে; এতে লাভক্ষতির প্রশ্ন অবান্তর।’
বিকাশ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা অভিযোগ করেন, সম্প্রতি নানা কর্মকাণ্ডের জন্য খুব অল্প সময়ে জনপ্রিয় হওয়া ‘মোবাইল ব্যাংকিং’ বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে। গ্রাহক এবং এজেন্ট উভয়ই প্রতিনিয়ত মোটা অঙ্কের অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। সিম রিপ্লেস, হ্যাক ও গোপন নম্বরের মাধ্যমে প্রতারণা করছে সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। সারাদেশে থাকা বিকাশের অনুমোদিত ৬৮ হাজার এজেন্টের অধিকাংশই (বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশিত কেওয়াইসি (কণঈ) ফরম যথাযথভাবে পূরণ না করেও এজেন্ট হওয়ারা) প্রতারক চক্রের সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে ।
কাস্টমার কেয়ারে প্রতিদিন হাজারো গ্রাহক: গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিকাশ কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে গ্রাহকদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। মহাখালী প্যারাগন হাউসের চতুর্থ তলায় দশঘণ্টাব্যাপী অবস্থানকালে প্রতারিত গ্রাহকদের সমস্যা ও ভোগান্তির চিত্রের পাশাপাশি তাদের শূন্য হাতে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। প্রতারিত অনেক গ্রাহকের সঙ্গে সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বিতণ্ডায় জড়াতেও দেখা গেছে।
এ সময় কথা হয়- এশিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সামছুল আরেফিনের সঙ্গে। তিনি অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে জানান, ‘পরীক্ষার ফি হিসেবে বাবা ১৭ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। এখন টাকা ক্যাশ আউট করতে পারছিনা। গত ৩ দিন ধরে কাস্টমার কেয়ারে আসলে কখনো ভোটার আইডি কার্ড, কখনো ছবি, কখনো বাবার মোবাইল সিম নিয়ে আসতে বলে হয়রানি করছে। বাবার মোবাইল সিম কুরিয়ারের মাধ্যমে এনে দেখানোর পর এখন আবার বলছে বাবাকেই আসতে হবে। না হলে সমাধান নেই।’
প্রাইম ইউনির্ভাসিটির ৫ম সেমিষ্টারের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। জানালেন, ‘নড়াইল থেকে ১৭ মার্চ বাবা এক এজেন্টের (আব্দুল হক) মাধ্যমে ২ হাজার টাকা পাঠান। কিন্তু ক্যাশ আউট করতে গিয়ে শুনি আমার নম্বরটি হ্যাক করা হয়েছে। ওইদিনই কাস্টমার কেয়ারে গেলে বিকাল ৫টা ৫মিনিট হওয়ায় আমার কোনো কথায় তারা শুনেনি। পরেরদিন গেলে ভোটার আইডি কার্ড ও ছবি আনতে বলে। আজ ছবি ও আইডি কার্ড নিয়ে আসার পর বলে আমার অ্যাকাউন্টে কোনো টাকাই নেই।’
মাকসুদা বেগম নামের এক বিকাশ এজেন্ট বলেন, ‘গ্রামীণফোন কোম্পানির মোবাইল সিমের —-৫০৫৩৩৪, —-৫০৫৩৩৫ ও —-৫০৫৩৩৬ নম্বরগুলো রেজিস্ট্রেশন এবং বিকাশ করা। এই সিম তিনটিতে মোট ৯৩ হাজার টাকা ছিল। বিকাশ কার্যক্রম পরিচালনার এক পর্যায়ে দেখি (১৬ জানুয়ারি ২০১৪) আমার সিমগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু মিনিট পনের পর সিমগুলো আবার চালু হয়। এ সময় চেক করে দেখা যায় সিমগুলোতে ৯৩ হাজার টাকার মধ্যে মাত্র ২ টাকা আছে। হ্যাকিং করে সব টাকা লুট করা হয়েছে। পরে কাস্টমার কেয়ারে অভিযোগ, থানায় জিডি (কাফরুল থানা, নং ১৬৩২) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাইনি। প্রায় ২ মাস পর কাষ্টমার কেয়ার থেকে বলা হলো- তাদের কিছুই করার নেই।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোরশেদ আলম জানান, বিকাশ করা—-১৫৯৯৫৪ নম্বরের মাধ্যমে নিয়মিত লেনদেন করেছি। গত মাসে হঠাত্ একদিন সিমটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে দেখি অ্যাকাউন্ট থাকা ২৭ হাজার টাকা ভৌতিকভাবে উধাও হয়ে গেছে। টাকা উদ্ধারের চেষ্ঠায় বিকাশ কাষ্টমার কেয়ার, গ্রামীণফোন অফিস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দফায় দফায় ছুটেছি। কিন্তু কোথাও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।
বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাব্বির হোসেন বলেন, ‘সব সমস্যা প্রায় একইরকম। আমরা সমাধানের চেষ্টা করি। কিন্তু ‘সমাধান’ আমাদের আয়ত্তের বাইরে হলে কিছু করার থাকে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, বিকাশের প্রধান কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সপ্তাহে ৫ দিন (শুক্র ও শনিবার বন্ধ) সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলে অফিস। এ সময়ের মধ্যে কাউকে হয়রানি নয়; সবাইকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করি।’
গ্রাহক এবং এজেন্টদের অভিযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও অবহিত করা হয়। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি।
রাঙামাটি কম্পিউটার ও টেলিকম ব্যবসায়ী মালিক কল্যাণ সমিতি এবং রাজধানীর ঠাটারিবাজারের ফরিদ ট্রেডার্সের মালিক ফরিদের অভিযোগ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। এই চিঠিতে প্রতারিত হওয়ার ঘটনার ধাবাহিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
বিকাশের এজেন্ট রাজধানীর ঠাটারিবাজারের ফরিদ ট্রেডার্সের মালিক ফরিদের অ্যাকাউন্ট থেকে তার অজ্ঞাতে ৬ মিনিটের ব্যবধানে প্রায় ৩ লাখ টাকা অন্য নম্বরে স্থানান্তর করা হয়। এ অবস্থায় বিকাশের ওই এজেন্ট টেরিটরি ম্যানেজার তানভীরকে অ্যাকাউন্টটি ফ্রিজ করতে বললে তিনি হটলাইনের ১৬২৪৭ নম্বরে জানাতে বলেন। কিন্তু এ হটলাইনটি তার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এসময় বিকাশের কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেনকে জানানো হলে তিনিও কোনো ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরই মধ্যে তার অ্যাকাউন্টে থাকা ২ লাখ ৯২ হাজার ৮৫০ টাকার মধ্যে মাত্র ২ টাকা ৭০ পয়সা রেখে পুরো ব্যালান্স হাতিয়ে নেয়া হয়। পুরো ঘটনাটি অর্থমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অবহিত করা হয়।
সুনির্দিষ্ট এই অভিযোগের বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে দু’দফা চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলেও কোনো জবাব দেয়নি ব্র্যাক ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র (সিআইপিসি) সূত্রের দাবি, বিকাশের বিরুদ্ধে করা একাধিক অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে এরই মধ্যে। এজন্য বিকাশকে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে আত্মসাত্ হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর আগে এজেন্টের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আত্মসাত্ প্রসঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, মোবাইলের সিম কার্ডের দায়দায়িত্ব বিকাশের নয়। বৈধ মালিক ব্যতীত অন্য কারো নামে সিম রিপ্লেস করে টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে আমরা অবগত হয়েছি। এ ধরনের ঘটনা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। যেহেতু গ্রাহকদের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ তাই সচেতনভাবে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে আরো যাচাই-বাছাই করে সিম কার্ড রিপ্লেস করার অনুরোধ জানিয়েছি। তবে, এসব আত্মসাতে বিকাশের কেউ জড়িত নয়।
সার্বিক বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এবং মামলা-জিডি অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিচ্ছে। অভিযোগ পাওয়ায় সম্প্রতি সাতক্ষীরার ব্রহ্মরাজপুর বাজার থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে লতিফা খাতুন ও তার ভাই মঞ্জুর বিশ্বাসকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়া সিরাজগঞ্জ ও পিরোজপুর থেকে ৮ জনকে আটক করা হয়। একইভাবে সারাদেশে প্রতারকদের আ্টক অভিযান অব্যাহত আছে।
Click this link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:৩৯