উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জামায়াতের সাফল্য ঈর্ষণীয়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে সর্বত্র। সুশীল সমাজ থেকে কুলি-মজুর। চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশনের পর্দা, সর্বত্র চলছে এ আলোচনা। এ ফলাফলে কেউ হতাশ, কেউ ক্ষিপ্ত। কেউ করছে বিশ্লেষণ আবার কেউ করছে সমালোচনা। সবার প্রশ্ন একটাই; জামায়াত কীভাবে উপজেলায় এত ভোট পেল? এত সাফল্যের কারণ কী।
দেশব্যাপী ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। এ পর্যন্ত চার দফায় ৩৩টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছে জামায়াত। ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলটির সাফল্য আরো ঈর্ষণীয়। এই পদে জয়ী হয়েছে ১০৯ জন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী। এছাড়া মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছে ৩১টি উপজেলায়।
আর যেসব উপজেলায় হেরে গেছে সেগুলোতেও তাদের ভোটপ্রাপ্তির হার রেকর্ড পরিমাণ। যা দলটির জনপ্রিয়তার প্রমাণিত মাপকাঠি। নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্যেও দলটির বিরুদ্ধে নেই কোনো ভোট ডাকাতি, জাল ভোট প্রদান কিংবা কেন্দ্র দখলের অভিযোগ। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সামাজিক প্রতিষ্ঠান দলটির সাফল্য নিয়ে উপস্থাপন করছে নানা তথ্য।
বিএনপির সমর্থন নিয়ে দলটি সাফল্য অর্জন করেছে বলে একটি পক্ষ দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি জয় লাভ করেছে বেশি উপজেলায়। এছাড়া যশোরসহ অনেক এলাকায় জামায়াতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপির প্রার্থী জামানত হারিয়েছে। ডান থেকে বাম, সাংবাদিক থেকে বিশ্লেষক সবাই নানা সমালোচনা করলেও জামায়াতের জনপ্রিয়তার কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেনি।
দলটির বিরুদ্ধে একাত্তরে বিতর্কিত ভূমিকার অভিযোগ করে বিভিন্ন গণমাধ্যম বছরের পর বছর প্রচারণা চালালেও তা গ্রহণ করছে না সাধারণ মানুষ। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত থাকলেও তাদের প্রতি ভালবাসা থেকে জনগণ বেশি ভোট দিচ্ছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন এলাকায়। প্রার্থীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ের ভিত্তিতে যোগ্য হিসেবে জামায়াত প্রার্থীকে ভোট দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন এলাকার জনগণ।
প্রথম ধাপের পর বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই না করলে জামায়াতের আরও বেশি প্রার্থী বিজয়ী হতো বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। এছাড়া পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মামলা, নির্যাতন ও প্রশাসন দিয়ে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের চাপে রাখার অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে।
সাতকানিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মতো অনেক উপজেলায় জামায়াত প্রার্থীরা জেলে থেকে নির্বাচন করেছেন বলে জানা গেছে। ভোলার চরফ্যাশনে জামায়াত প্রার্থীকে নির্বাচনের আগে অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে। তা না হলে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা আরও বেশি উপজেলায় জয়ী হতো বলে দাবি করছে দলটি।
বিভিন্ন এলাকায় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটাররা প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, সততা ও সামাজিক অবস্থান দেখে জামায়াত প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে যেখানে লুটপাট, জমি দখল, চাঁদাবাজি ও খুনের মামলা রয়েছে। সেখানে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিল সমাবেশের পাশাপাশি হরতাল-অবরোধে অংশ নেওয়ার মতো অপরাধ ছাড়া আর কোনো মামলা নেই। যা সাধারণ জনগণের কাছে কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য নয়। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা যখন ভোট না দিলে কেন্দ্র দখলের হুমকি দিয়ে ভোট চেয়েছে। সেখানে জামায়াত প্রার্থীরা মামলার ভয়ে আত্মগোপনে থেকে ভোট চেয়েছে।
সরকার বিরোধী আন্দোলনের পর জামায়াতের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের পর যেখানে জামায়াতের অস্তিত্ব হুমকির মুখে সেখানে জামায়াতের জনপ্রিয়তার সাফল্য সব মহলকে চমকে দিয়েছে। বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশব্যাপী যৌথ বাহিনীর অভিযান ও গণমাধ্যমে জামায়াত বিরোধী প্রচারণার পরও উপজেলা নির্বাচনের তিনটি পদে দলটির দেড় শতাধিক প্রার্থীর বিজয়কে অবিশ্বাস্যই বলতে হবে।
সাংগঠনিক ঐক্য এবং জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য জামায়াত স্থানীয় নির্বাচনে ভোট পেলেও সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে থাকাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে বগুড়ায় তা প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির দুর্গ বলে খ্যাত এ জেলায় চার দফায় পাঁচটি উপজেলায় খোদ বিএনপি প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছে জামায়াত প্রার্থীরা। এতে সরকার বিরোধী আন্দোলনে কঠোর ভূমিকার প্রভাব রয়েছে বলে দাবি করেছেন বগুড়ার ভোটাররা। একই কারণে অন্তত আরো ১০টি জেলায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি সমর্থিত বর্তমান চেয়ারম্যান পরাজিত হয়েছেন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর নিকট।
জামায়াতের প্রতি সরকারের বিরূপ মনোভাব তাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। তাদের নেতাদের বিচারও হচ্ছে। তাই বলে জামায়াতের সব সমর্থক অপরাধী তা কিন্তু নয়। তাদের প্রতি সরকারের এবং প্রশাসনের অন্যায় বলপ্রয়োগ জনগণ মেনে নেয়নি। তাই জনগণের কাছে তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
জামায়াতের বক্তব্য হচ্ছে, যখন আওয়ামী লীগ এবং বাম সংগঠনগুলো জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে, তখন উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তার সমুচিত জবাব দিয়েছে।
দলটির নেতারা বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান কাজ হিসেবে দেখা যায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দমন করা। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে দমন করা। পরবর্তী পাঁচ বছর জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এমন কোনো পন্থা নেই যা মহাজোট সরকার অবলম্বন করেনি। জামায়াত ও শিবিরের প্রতি আওয়ামী লীগের দমন নীতি সাধারণ মানুষের কাছেও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি করতে গিয়ে গণতান্ত্রিক দল বলে পরিচিত আওয়ামী সরকার পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
জামায়াত নেতাদের দাবি, সরকারের দমননীতি জামায়াত-শিবিরকে দমন করতে পারেনি। বরং দিন দিন সংগঠনটি জনপ্রিয় বেড়েছে। আর তার প্রমাণ উপজেলার নির্বাচনের ফলাফল।
সরকার গণতান্ত্রিক আচরণ করলে জামায়াত ভবিষ্যতে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে
উৎসঃ