বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়ে গেছে। আজ রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির রাত ১টা ৫৪ মিনিটে কারাগার থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য জানিয়েছেন। জাহাঙ্গীর কবির বলেছেন তাদের দুইজনের মৃত্যুদণ্ড একই সময়ে কার্যকর করা হয়েছে। তার আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বিষয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। এরপর কারাগার থেকে রাত ৮টা ৩০ মিনিটের দিকে মুজাহিদ এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের খবর দেয়া হয় শেষবারের মতো দেখা করার জন্য। রাত পৌনে ১১টায় সাক্ষাৎ শেষে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হোমাম কাদের চৌধুরী বলেন আমার বাবা ক্ষমা চাননি। তিনি বলেছেন, এসব বাজে কথা এই ধরনের অনেক কথা শোনা যাবে। আমি ক্ষমা চাইব এটা তোমরা বিশ্বাস করলে কী করে। অন্য দিকে রাত ১২টা ৬ মিনিটে সাক্ষাৎ শেষে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর সাংবাদিকদের জানান তার বাবাও জানিয়েছেন তিনি মার্সি পিটিশন করেননি।
শনিবার দুপুরের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করেছেন। এই দুই মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় যে আবেদনটি রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠানো হবে। রাতে আইনসচিব আবু সালে মোঃ জহিরুল ইসলাম এই আবেদন নিয়ে বঙ্গভবনে যান। তিনি রাত ৯টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় যান। রাত ৯টা ৫০ মিনিটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন রাষ্ট্রপতি ক্ষমার আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। তারপর রাত ১০টা ৪২ মিনিটে তিনি জানান ক্ষমার আবেদন নাকচের বিষয়টি তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ক্ষমার আবেদন প্রচারের পর থেকেই মুজাহিদ এবং সালাহউদ্দিন কাদেরের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ক্ষমার কোনো আবেদন তারা করেননি। তারা রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারপ্রক্রিয়ার ত্রুটির কথা উল্লেখ করে চিঠি দেবেন।
দণ্ড কার্যকর উপলক্ষে শনিবার বিকেল থেকেই কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বিপুল র্যাব পুলিশ ডিবি কারারক্ষী এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদেরও মোতায়েন করা হয়েছে। কারাগারের আশপাশের এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সকাল ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন দুই ম্যাজিস্ট্রেট। তবে বিকেল সাড়ে ৩টায় কারাগার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তারা কারাগারের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলেননি। ক্ষমার আবেদনের বিষয়ে জানার জন্য আশরাফুল ইসলাম এবং তানভীর আহমেদ নামে দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা কারাগারে প্রবেশ করেন বলে জানায় কারাসূত্র।
তাছাড়াও কারা অধিদফতর থেকে আইজির প্রিজন একটি চিঠি নিয়ে সাড়ে ৩টার দিকে কারাগারে প্রবেশ করেন একজন বার্তাবাহক।
ডেপুটি জেলার সর্বোত্তম দেওয়ান এবং আরিফুল ইসলাম বেলা ২টা ৪০ মিনিটের সময় কারাগার থেকে চিঠি নিয়ে বের হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। কারাসূত্র জানিয়েছেন মার্সি পিটিশন নিয়ে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। রাত ৮টায় কারাগারে প্রবেশ করেন অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল ফজলুল কবির। এসময় কারাগারে অবস্থান করছিলেন জেল সুপার এবং জেলার।
তওবাসংক্রান্ত অন্যান্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য রাত ১১টায় কারা ইমাম হাফেজ মো: মনির হোসেন প্রবেশ করেন কারাগারে। এর আগে রাত ১০টা ২০ মিনিটে প্রবেশ করেন ঢাকা জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন। এ ছাড়া সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক কারা চিকিৎসক আহসান হাবিব এবং একটি বিশেষ গার্ড এই সময় প্রবেশ করেন কারাগারে।রাত ২টা ৩৫ মিনিটে লাশ কারাগার থেকে বের হয়নি।
আলী আহসান মুজাহিদের মামলাঃ ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে চলতি বছর ১৬ জুন রায় দেন আপিল বিভাগ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মুজাহিদকে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডের একটি সাজা বহাল রাখা হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডের আরেকটি সাজা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়।
আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে সেটি হলো ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা এবং ষড়যন্ত্র। গত ১৮ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মুজাহিদের রায় পুনরায় বিবেচনার আবেদন খারিজ করে চূড়ান্ত রায় দেন। মুজাহিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এর মধ্যে দু’টিতে যথা ৬ ও ৭ নং অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যে অভিযোগগুলোতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় সেগুলো ৬ নং অভিযোগ যথা মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে শারীরিক শিক্ষা কলেজ) পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে আলী আহসান মুজাহিদ বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করেন। ওই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ’৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। আপিল বিভাগের রায়ে ৬ নং তথা বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মামলায় গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ২৬ আগস্ট মুজাহিদের বিরুদ্ধে শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই বিচারকার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন।
আপিল বিভাগে মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রধান আইনজীবী ছিলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন।
মুজাহিদের পরিচিতি : আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পশ্চিম খাবাসপুরে তার দাদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা আবদুল আলী। মাতার নাম নুরজাহান বেগম। আলী আহসান মুজাহিদ ছিলেন রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। তার পিতা মাওলানা আব্দুল আলী ১৯৬২ সাল থেকে ৬৪ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরে এমএলএ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য) ছিলেন। আলী আহসান মুজাহিদ ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন এবং তারপর ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।
পিতার অনুসরণে মুজাহিদ ছাত্রজীবন থেকে সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৮ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলা ছাত্রসঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক এবং দুই মাসের মাথায় তিনি সভাপতি হন। ১৯৮১ সালে তিনি জামায়াতের ঢাকা মহানগরী আমির নির্বাচিত হন। দীর্ঘ দিন এ পদে দায়িত্ব পালনের পর তিনি ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন এবং এক যুগেরও বেশি সময় তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদের সময় তিনি সর্বপ্রথম জামায়াতের পক্ষ থেকে ফরিদপুরে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। তবে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। এরপর ২০০১ সাল বাদে সবক’টি সংসদ নির্বাচনেই অংশ নিয়েছেন।
একজন দক্ষ সংগঠক এবং সমন্বয়ক হিসেবে সুনাম রয়েছে তার। জেনারেল এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের সাথে তিনি লিয়াজোঁ রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দল ও ব্যক্তিদের সাথে তিনি সমন্বয় রক্ষার ভূমিকা পালন করেছেন।
২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারে তিনি টেকনোক্র্যাট কোটায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (১) ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। চলতি বছর ২৯ জুলাই তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের রায়ে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে চারটি অভিযোগে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এর সবই বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগের রায়ে। গত ১৮ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ রায় পুনরায় বিবেচনার আবেদন খারিজ করে চূড়ান্ত রায় দেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালিয়া থানায় হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, নির্যাতন দেশান্তরকরণসহ মানবতাবিরোধী মোট ৩২টি অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সেখান থেকে ২৩টি অভিযোগে চার্জ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। রাষ্ট্রপক্ষ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগের মধ্য থেকে ১৭টি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী হাজির করে। ১৭টি অভিযোগের মধ্য থেকে তাকে ৯টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকি আটটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে গ্রেফতার করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। ২০ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৪ অভিযোগ : ট্রাইব্যুনালের রায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যে চারটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো ৩, ৫, ৬ ও ৮ নং অভিযোগ।
অভিযোগ-৩ : রাষ্ট্রপক্ষের এ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উপস্থিতিতে এবং তার নির্দেশে রাউজানের গহিরায় অবস্থিত কুণ্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাতা সমাজসেবক অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজেও তাকে গুলি করেন।
অভিযোগ-৫ : এ অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়, ১৯৭১ সালে ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কিছু অনুসারী নিয়ে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন।
অভিযোগ-৬ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালানো হয়। এ সময় ৫০ থেকে ৫৫ জন হিন্দুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-৮ : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহম্মদ ও তার পুত্র শেখ আলমগীরসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য প্রাইভেটকারে চট্টগ্রামের রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসছিলেন। পথে হাটহাজারী থানার খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি তিন রাস্তার মোড়ে বেলা অনুমান ১১টায় পৌঁছামাত্র আসামি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে থাকা পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যরা তাদের প্রাইভেট গাড়িটি আটকিয়ে শেখ মোজাফফর আহম্মেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
৪ পাকিস্তানিসহ আট বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষ্য দেয়ার আবেদন
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের শুনানির সময় তার পক্ষে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আটজন বিশিষ্ট নাগরিকের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর আপিল বিভাগে এ আবেদন দায়ের করা হয়। পাকিস্তানের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী মোহাম্মাদ মিঞা সুমরো, পাকিস্তানের সাবেক রেলমন্ত্রী ইসহাক খান খাকওয়ানি, ডন মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারপারসন আম্বার হারুন সাইগাল, স্থপতি মুনিব আরজামান্দ খান, ভিকারুননিসা নূনের নাতি ফিরোজ আহমেদ নূন, ফিজিতে দায়িত্ব পালনকারী আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত ওসমান সিদ্দিক, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শামীম হাসনাইন এবং বিচারপতি শামীম হাসনাইনের মা জিনাত আরা বেগম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আবেদন করেন।
তবে গত ১৬ নভেম্বর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের সাথে আটজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রধান আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেনÑ উল্লিখিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের বক্তব্য হলফনামা আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে বলেছেন, ’৭১ সালের ২৯ মার্চ তারিখের পরে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাদের সাথে পাকিস্তানে ছিলেন এবং ’৭১ সালের আগস্ট মাসে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার পর তিনি লন্ডনে চলে যান। বিচারপতি শামীম হাসনাইন মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে লিখিত আবেদনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদানের অনুমতি চেয়েও কোনো প্রতিউত্তর পাননি।
আপিল বিভাগের রায়ে উপরি উক্ত নাগরিকদের হলফনামাগুলোকে যোগসাজশশের সৃষ্টি বলে সেগুলো বিবেচনা করা হয়নি। তারা আদালতে এসে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন তাদের হলফনামাগুলো যোগসাজশে তৈরি করা হয়নি।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৪৯ সালে ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানায় জন্মগ্রহণ করেন। দুই বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যু হয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দুই ছেলে এবং এক কন্যাসন্তানের বাবা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি পরিচিত নাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি পরপর ছয়বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আলোচিত একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজে (বর্তমানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ) ভর্তি হন ১৯৬০ সালে এবং সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। ওই বছরই নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্নাসে ভর্তির পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি হন। পরে তিনি লন্ডনের লিঙ্কনস ইনে ভর্তি হন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। তবে তা শেষ করেননি তিনি। ছাত্রজীবনে তিনি সরাসরি কোনো ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত না থাকলেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন বলে ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দীতে জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা। স্পষ্টবাদী, তীর্যক মন্তব্য এবং বাকপটু হিসেবে পরিচিত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে আলোচনায় এসেছেন। মামলা চলার একপর্যায়ে সব আইনজীবী বিদায় করে তিনি নিজে সাক্ষীকে জেরাও করেছেন।
তথ্যসূত্রঃ আমাগো দেশের অনলাইন পেপার ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:৪৪