somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমকির মুখে সাংবাদিক ও কবি হুমায়ুন রেজার দেশ ত্যাগ

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গত তিনদিন ধরে লেখার চেষ্টা করছি- কিন্তু কিছুই লিখতে পারছি না। ভয়ে? আতঙ্কে? এ এক অদ্ভ’ত কষ্ট আর যন্ত্রণা। অথচ এই আমিই কি অবলীলাতেই না লিখে গেছি পাতার পর পাতা। রিপোর্ট, ফিচার, সাক্ষাৎকার; দীর্ঘ দুযুগেরও বেশি সময় ধরে। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রগতিশীল আর সামনের সারির সংবাদমাধ্যমগুলোতে লিখেছি। সেই ছাত্রজীবনে, আজকের কাগজ থেকে শুরু করে চাকরিসূত্রে ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমে। এমনকি জার্মানিতে ডয়েচে ভেলেতেও দিনে সাত/আটটা পর্যন্ত লেখা লিখেছি- আমার সে সময়ের সহকর্মী সুপ্রিয়, সঞ্জীব বর্মণের অনুরোধে। ভারত ও বাংলাদেশের নির্বাচিত কবিদের যৌথ সংকলনে কবিতার বই সহ আমার লেখা ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। অথচ আজ জঙ্গি হুমকির মুখে আমার কুড়ি বছরেরও বেশি পেশাগত জীবন, সংসার সবকিছু উপড়ে ফেলে শেকড়হীন হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার কথাটাই লিখতে পারছি না।

ভোরের কাগজে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিন থেকে টানা এক মাস প্রতিদিন লিখেছিলাম ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ, যুদ্ধাপরাধী আর এর বিচারিক বাস্তবতা নিয়ে। বাংলাদেশে এর আগে এভাবে আর কোনো কাগজ এমন সাহস দেখায়নি। সে সময় তিন থেকে চারটি রিপোর্ট প্রকাশিত হ্ওয়ার পরই পেয়েছিলাম- না লেখার জন্য নির্দেশ জানিয়ে হত্যার হুমকি। তখন ঠাট্টা করেছি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম এসব। আমি ভালবাসি এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলকে। বিশ্বাস করতাম ওরা ১৯৭১ সালে যা পেরেছিল, তা আর কখনো ঘটাতে পারবে না কিংবদন্তির এই বাংলাদেশে। কিন্তু এই ২০১৬ সালেও যে সেই মৃত্যু পরোয়ানার ভুত আমার পিছু নেবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

দুমাস আগে, নভেম্বরের শুরুর দিকে প্রথমবার টেলিফোনে হুমকি পাওয়া শুরু করি। তখন বিষয়টি হালকা ভাবেই নিই। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর- এ দুই মাসে আমাকে ৫/৬ বার টেলিফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছে। মাঝ রাতে অপরিচিত সব নাম্বার থেকে ফোন করে বলতো, ইউ আর নেক্সট। বলতো, তোর সময় শেষ; মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ। ফোনে এসব হুমকি পেয়ে স্তব্ধ নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠেছিল জঙ্গীদের হাতে দেশের তরুণ সব প্রগতিশীল লেখকদের নির্মমভাবে চাপাতি আর ছুরির আঘাতে নিহত হ্ওয়ার ছবিগুলো। ভেসে উঠেছিল আমার দুই আত্মজার ফুটফুটে নিরপরাধ অসহায় মুখ, ক্যানসার সার্ভাইভার প্রিয়তম স্ত্রী ও মায়ের চেহারা। 

এখন বাংলাদেশে প্রগতিশীলদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার। ১৯৭১ সালে তাদের নেতৃত্বেই তো এই আধুনিক জঙ্গিদের পূর্বসূরিদের পরাজিত করেছিল বাংলাদেশের সাহসী মানুষেরা। আমারতো ভয় পাওয়ার কথা না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- এ সরকারের চোখের সামনেই একের পর এক লেখকদের হত্যা করেছে জঙ্গীরা। রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে। বাজারের ফর্দের মতো তালিকা করে। একটি হত্যারও কোনো বিচার হয়নি। আজবধি কোনো হত্যার বিচার করা তো দুরের কথা, হত্যাকারীদের ধরতেও ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। আমাকে ভাবতে হয়েছে বিচারহীনতার এই দেশে আমার বা আমার পরিবারের জীবনের নিরাপত্তা সরকার কি করে দেবে।

খুব কাছের দুই একজন ছাড়া কাউকেই বিষয়টা বলতে সাহস পাইনি। পুলিশের কাছে যেতে চেয়েও শেষ মুহূর্তে যাইনি। গিয়ে যে কাজ হবে, সে আস্থাই পাইনি। পুলিশের কাছে গেলে যে কোনো কাজ হয় না; এই অপ্রিয় সত্যটি বাংলাদেশের সবাই জানেন। পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে, নিরাপত্তা নিয়েও জঙ্গীদের হাত থেকে রেহাই পাননি অনেকেই। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক সহকারী জুলহাসকে তার কলাবাগানের সুনিরাপদ বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ওরা। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের ফোনের পরও জুলহাস হত্যার কোনো সুরাহা করতে পারেনি এদেশের পুলিশ প্রশাসন। ব্লগার ও লেখক রাজীব, বাবু, নিলাদ্রী এমন অসংখ্য নাম আজ হয়ত অনেকে ভুলেও গেছেন। পরিসংখ্যানের জন্য, রেফারেন্সের জন্য তথ্যব্যাঙ্কে পড়ে আছে জঙ্গীদের হাতে নিহত এই সব লেখকদের নাম আর হত্যাকাণ্ডের নির্মম বর্ণনা।

ঢাকা দিনে দিনে আরো তিলোত্তমা হয়ে উঠছে। এখানে এখন একের পর এক ফ্লাই ওভার হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে সবকিছুরই। কিন্তু বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতিও প্রবহমান রয়েছে পাশাপাশি। লেখক নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের নাম কয়জন মনে রেখেছে? ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট দুপুরে নিলাদ্রির স্ত্রী আশা আর স্বজনদের সামনেই এই তরুণ লেখককে নির্মমভাবে জবাই করে জঙ্গীরা। নিলাদ্রিকে শিরোচ্ছেদ করে তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে বেরিয়ে যায় খুনিরা।

আমার মতো নিলাদ্রিও হুমকি পেত। সে পুলিশের সহায়তাও চেয়েছিল। আমাদের পুলিশ প্রশাসন সেসব অভিযোগ আমলেই নিতে চায়নি। একটি সাধারণ অভিযোগ দায়েরের নুন্যতম নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন তিনি। নিলাদ্রির হত্যাকারীরা আজও ধরা পড়েনি। বুড়িগঙ্গার স্রোতের মতো এই নির্মম হত্যার বিচারের দাবিও হারিয়ে যাবে একসময়। তার অসহায় স্ত্রীর পাশে কেউ কি দাঁড়িয়েছে? স্বামী হত্যার বিচার এই জীবনে সে দেখে যেতে পারবে - এমন নিশ্চয়তা রাষ্ট্রযন্ত্র দিতে অপারগ। নিলাদ্রির স্ত্রী তাহলে এখন কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?

হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ডের (অথবা হত্যা চেষ্টা - যাই বলা হোক না কেন) বিচার হয়েছে আজ পর্যন্ত? জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত, গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাইকে যে হত্যা করা হল, তার কি কোন কিনারা হবে কখনো? গত কয়েক বছরে যত লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী হত্যা হয়েছে, তার সবগুলোর পরিণতি একই রকমের।

দেশ ছেড়েছি বলে আমাকে যারা কাপুরুষ বলবেন তাদের বলছি। আমি হয়তো আবেগের বশে সাহস দেখিয়ে থেকে যেতে পারতাম দেশে। এসব হুমকি উপেক্ষা করতে পারতাম - নিজেকে সাহসী সাংবাদিক হিসেবে প্রমাণের চেষ্টায়। পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদনও করা যেত। তারপর কি? একদিন ওরা হয়তো আমাকে সত্যিই মেরে ফেলত। আমার স্ত্রী ও সন্তানরা তখন কার কাছে যেত? আমি এভাবে নিজেকে পরাজিত হতে দিতে চাই না। ঘাতকের চাপাতির নিচে আত্মাহুতি দিয়ে মহান হওয়াটা আমার কাছে দেশপ্রেম মনে হয় না। বরং এসব হত্যা হুমকিকে এড়িয়ে প্রবল ভাবে বেঁচে থাকতে পারা, কলম চালিয়ে যেতে পারাটাই বিজয়ের।

অনেক যুদ্ধ করেছি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। অনেক লিখেছি। যখন লেখার জন্য, কবিতার জন্য, স্বজনদের জন্য বেঁচে থাকাটা হুমকির মুখে, তখন এদেশে বসবাস বোকামি। অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা আততায়ীর ছুরি আমাকে যতটা ভীত করে, তার চাইতেও বেশি আতঙ্কিত করে রাষ্ট্র যন্ত্রের অসহায়ত্ব।

আমি ক্ষুব্ধ, ক্লান্ত, অসহায়, হতাশ। বাংলাদেশের বাস্তবতা আমাকে আজ দেশান্তরি হতে বাধ্য করেছে। এই অসহায়ত্ব, এই পরবাসী হওয়াটা বড়ই অপমানের। প্রশান্ত পাড়ের অজানা অচেনা এই অস্ট্রেলিয়ায় দুই কন্যা সন্তান আর অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে, প্রিয়জনদের ছেড়ে, আমার স্বদেশকে পেছনে ফেলে উদ্বাস্তু কপর্দকহীন অবস্থায় কি করে বাঁচবো জানি না। একটি অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। তবু, স্বাভাবিকভাবে যে কটা দিন বাঁচব, তার পুরোটা সন্তান-স্ত্রী আর স্বজনদের জন্য এ পৃথিবীতে নিরাপত্তায়-আনন্দে-প্রতিবাদে কাটিয়ে যেতে চাই। আমার পরবাসী জীবনের কথা ভেবে স্বজনরা যেন বলতে পারে, থাক; ও তো অন্তত বেঁচে আছে, আমার পাঠকরা যেন আমার প্রতিটি লেখায়, প্রতিটি কবিতায় জেগে উঠতে পারে।

যুগে যুগে জীবিত হুমায়ুন রেজারাই এসব হন্যমান জিঘাংসু জঙ্গিদের ভয়ের কারণ। অসহায় শোকার্ত স্ত্রী-কন্যাদের সামনে জঙ্গীদের হাতে নিহত নিথর-নীরব কবি ও সাংবাদিক হুমায়ূন রেজার চাইতে জীবিত কবি ও লেখক, পিতা ও স্বামী হুমায়ূন রেজা অনেক বেশি ধারালো, শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময়।

(এই লেখাটির লেখক হুমায়ুন রেজা নিজে)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:২২
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানালেন ড. ইউনূস

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:১০





যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।শুভেচ্ছা বার্তায় ড. ইউনূস বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আপনাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×