[খামোখা একটা পোস্ট দিচ্ছি। এই দাবদাহের সময় বৃষ্টি নিয়ে লেখা! কপালে কী আছে কে জানে! অবশ্য, কেউ পড়বেন না এই ভরসায় দিচ্ছি। আসলে মনটা ভালো নেই। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে, তাই এই লেখা।]
'পৌষের কোনো এক বৃষ্টিভেজা মধ্যরাতে এদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হয়েছিলো আমার, মায়ের কাছে শুনেছি। হঠাৎ বৃষ্টির সেই শীতের রাতে আঁতুর ঘরে মার পাশে দাইমা নামক আমার অ-দেখা এক মহিলা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। উঠোনে রেখে দেয়া প্রয়োজনীয় সাংসারিক অনুষঙ্গ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে দাইমা বাইরে গেলে প্রায়ান্ধকার ঘরে জন্ম হয়েছিলো আমার।
জন্মেই দেখেছিলাম, আমার চারপাশে কেউ নেই- মা ছাড়া।
আজ, এই এতদিন পর- আমার চারপাশে সহস্র মানুষের ভিড়- তবু মার কাছে ফিরতেই ভালো লাগে আমার।'
আমার প্রথম বই- 'দ্বিতীয় মানুষ'-এর উৎসর্গ পাতায় লেখা আছে কথাগুলো। যারা দু-এক কলম লেখেন, তাদের মধ্যে আবার যাদের দু-একটা বই প্রকাশের সৌভাগ্য হয়, তারা জানেন-- অন্তত প্রথম বইটি উৎসর্গিত হয় তাঁর প্রতি, যাঁর কাছে অপার ঋণ জমে আছে, যে ঋণ কোনোকিছু দিয়েই শোধ করা যায় না। আমার প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। কিন্তু উৎসর্গটি ওভাবে লিখেছিলাম শুধু ঋণ প্রকাশের জন্য নয়, একইসঙ্গে বহু মানুষের ভিড়ে আমার নিঃসঙ্গতা আর বৃষ্টির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলার জন্যও বটে। সেই যে বৃষ্টির রাতে জন্ম, তারপরও জীবনের বহু বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে এমন হঠাৎ-বৃষ্টি জড়িয়ে আছে।
মায়ের মুখে সেই জন্ম-বর্ণনা, আহা, কী যে মধুর লাগে শুনতে--
'তোর জন্ম তো শীতের রাতে। বাইরে ফুটফুটে জোসনা, এমনকি জোসনার দাপটে কুয়াশাও পালিয়েছে'-- দারিদ্রপীড়িত সংসারের মধ্যবিত্ত রূপটি ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টায় রত আমার আটপৌরে মায়ের কণ্ঠে যেন কবিতা ঝরে পড়ে-- 'ঘরে তখন দুদুর মা (আমার দাই মা) ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আঁতুর ঘরে তখন আর কারো থাকার নিয়মও ছিলো না। হঠাৎ, কী কাণ্ড, শুনি, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ! আমি বললাম, ও দুদুর মা, বাইরের সবকিছু মনে হয় ভিজে গ্যালো, দ্যাখো তো! বুঝিস না, মাটির চুলায় রান্না হতো, খড়ি-লাকড়ি সব বাইরেই রাখা। শীতের দিনে কি কেউ বৃষ্টির কথা চিন্তা করে ওসব ঘরে তুলে রাখে নাকি! এখন যদি সব ভিজে যায়, কালকে রান্না করতে অসুবিধা হবে। দুদুর মা বাইরে গেলো, কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে টুছিয়ে ফেরার আগেই তোর জন্ম হলো। বুঝলি, তোর জন্মের সময় ঘরে আর কেউ ছিলো না। যেন এই কাণ্ডটি ঘটানোর জন্যই শীতের রাতেই অমন খা খা জোসনার মধ্যেও বৃষ্টি এসেছিলো।'
'কেন মা, শীতের রাতে বুঝি বৃষ্টি হয় না!'
'হতে পারে, তবে সাধারণত হয় না। তাছাড়া ওই রাতে বৃষ্টির কোনো লক্ষণই ছিলো না। বললাম না, ফুটফুটে জোছনা ছিলো, মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। আবার দ্যাখ, হঠাৎ যেমন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসেছিলো, তেমনি হঠাৎই চলে গ্যালো। ওই কয়েক মিনিটের জন্য।'
মায়ের মুখে এই বর্ণনা কতোবার যে শুনেছি তার হিসেব নেই। হয়তো এজন্যই শীতের রাত, জোছনা, বৃষ্টি এই বিষয়গুলো আমাকে নানাভাবে উদ্বেলিত করে, এদের মধ্যে সম্পর্কসূত্র খুঁজে বেড়াই। কখনো পাই, বেশিরভাগ সময়েই পাই না।
একদিনের কথা বলি : আমাদের গ্রামের বাড়িটা ছিলো পদ্মার পাড়ে (সেই বাড়ি এখন নেই, পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে)। তো, বাড়িটা যতোদিন ছিলো, ততোদিন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলো ওই নদী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটেছে পদ্মার পাড়ে বসে। কিন্তু যে সময়ের ঘটনা বলছি, তখন আমি কিশোর ছিলাম, অনির্দিষ্ট সময় ধরে নদীর পাড়ে বসে থাকার স্বাধীনতা ছিলো না। আমাদের বাড়ির কঠোর নিয়ম ছিলো- সন্ধ্যার মধ্যে অবশ্যই বাড়ি ফিরতে হবে। বিশেষ করে ছোটরা সন্ধ্যার পর কোনোভাবেই বাইরে থাকতে পারবে না। তো সেদিন, প্রতিদিনের মতোই, আমি বিকেলে গেছি পদ্মার পাড়ে। সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসার কথা- কিন্তু ফেরা হলো না। সন্ধ্যা হতে না হতেই বিরাট এক চাঁদ উঠলো আকাশে, আর একটু পরই শুরু হলো চাঁদ ও নদীর এক অপরূপ খেলা। নদীর ঢেউয়ে চাঁদের আলো পড়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, আর চিকচিক করে উঠছে এমনভাবে যেন হাজার হাজার হিরকখণ্ড কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে পদ্মার জলে। আরও মজা শুরু হলো খানিক পরই। প্রায় বিনা নোটিশে বৃষ্টি নেমে এলো ঝমঝমিয়ে। জোসনা রাতে বৃষ্টি হয় না, এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল- আমি আমার জীবনে বহুবার হতে দেখেছি। যাহোক, নদীর নিজস্ব শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, আর চাঁদের আলো এই তিন মিলে এমন এক ঘোর তৈরি করলো যে, আমি যে ভিজে একাকার হয়ে গেছি, বাড়িতে গিয়ে বকা শুনতে হবে সেটা ভুলেই গেলাম। যখন বাড়িতে ফিরলাম ততক্ষণে দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। একে তো রাত করে বাড়ি ফিরেছি, তার ওপর কাপড়-চোপর ভেজা, কপালে মার আছে বলে মনে হলো। আমার বড় আপা ছিলো ভীষণ রাগী মহিলা, রাগারাগি-বকাবাজি শুরুও হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু মা তাকে থামালো। আমি অপেক্ষা করে ছিলাম কখন মা বকবে, কিন্তু মা কিছুই বললো না। রাতে যখন শুতে গেছি তখন মা আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো--
'ফিরতে এত দেরি করলি যে, কোথায় গিয়েছিলি?'
'পদ্মার পাড়ে।'
'ওখানে তো রোজই যাস, কোনোদিন তো দেরি করিস না, আজকে করলি কেন? বৃষ্টিতেও তো ভিজেছিস!'
আমি নদী-চাঁদ-বৃষ্টির কম্বিনেশনে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিটা মাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিলো কিছুতেই পরিস্থিতিটা বর্ণনা করতে পারছি না, কী এক ঘোর যে তৈরি হয়েছিলো সেটা কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। বোঝাতে না পেরে আমি একসময় কাঁদতে শুরু করলাম।
মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো-
'কাঁদছিস কেন? আমি তো তোকে বকাবাজি করিনি। করেছি'
'আমি সেজন্য কাঁদছি না মা।'
'তাহলে কাঁদছিস কেন?'
'আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না, বোঝাতে পারছি না... '
'কি বোঝাতে পারছিস না?'
'কী যে হয়েছিলো, মানে কেন আমি ফিরতে পারলাম না... '
'তাহলে তোর কাঁদাই উচিত'-- মা নির্বিকারভাবে বললো-- 'যা বলতে চাস সেটা না বলতে পারলে কাঁদাই উচিত ।'
তখন কথাটার মানে বুঝিনি। এখন মনে হয়, মা আসলে বলেছিলেন-- যে কমিউনিকেট করতে পারে না, তার কাঁদাই উচিত।
সেই থেকে আমি কমিউনিকেট করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিছু একটা বোঝাতে চাইছি। পারছি না। পারছি না বলে কেঁদে চলেছি। কেউ তা দেখতে পায় না। নিঃশব্দ-অন্তর্গত এই কান্না।
জোছনা ও বৃষ্টির এই কম্বিনেশন হয়েছিলো আবার বাবার মৃত্যুর দিনও। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাবা মারা গেলেন। সেটিও ছিলো জোছনাপ্লাবিত রাত। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো বৃষ্টি। প্রায় সারারাত ধরে ঝিরঝির বৃষ্টি হতেই লাগলো, অথচ জোছনা ম্লান হলো না, চাঁদ ঢাকা পড়লো না মেঘের আড়ালে!
এইরকম নানারকম বৃষ্টিমুখরিত জোছনাপ্লাবিত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ভরে আছে আমার জীবন। বর্ণনা করে যা শেষ করা যাবে না।
মানুষের সারাটি জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় তার শৈশব-কৈশোর অর্থাৎ বেড়ে ওঠা দিয়ে। আমার নিজের ক্ষেত্রে অন্তত এটি প্রবলভাবে সত্য। আগেই তো বলেছি, যে বাড়িতে আমার জন্ম ও শৈশব-কৈশোর কেটেছে, তার কাছেই ছিলো পদ্মা। বর্ষার সময় পানি বাড়লে নদীর দু-কূল ছাপিয়ে মাঠঘাট ভেসে যেতো। গ্রামের তখন অন্য রূপ- এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে হতো নৌকায় করে। বৃষ্টিতে ভেজা তখন কেবল একবেলার রোমান্টিসিজম নয়, বরং নিত্যদিনের সঙ্গী। বর্ষাকালের এমন একটি দিনও বোধহয় যায়নি, যেদিন আমরা বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল করিনি। শৈশব-কৈশোরের যে কয়টি জিনিসের সঙ্গে আমার প্রেম, বৃষ্টি তাদের একজন। এর আগের একটি পোস্টে আমি গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে চাঁদ ও জোছনার সম্পর্কের কথা বলেছিলাম। চাঁদের সঙ্গে যে প্রেম পর্যন্ত হতে পারে, বুদ্ধই তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ। সত্যিই তো! মানুষের সম্পর্ক কি শুধু মানুষের সঙ্গেই হয়? একটি গাছের সঙ্গে হয়না? কিংবা একটা নদীর সঙ্গে? ব্রক্ষ্রপুত্রের সঙ্গে কি জয়নুলের কোনোই সম্পর্ক ছিলো না? কিংবা বৃষ্টির সঙ্গে? বৃষ্টি দেখলে যে কিছু কিছু মানুষ পাগল হয়ে যায়, তার কারণ কি? কিছু লোক সবসময়ই বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করে- এটাকে স্রেফ রোমাঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করলে বিষয়টিকে খণ্ডিত করে দেখা হয়। বরং বলা উচিৎ ওই লোকটাও বৃষ্টিকে ভালোবাসে- বৃষ্টিতে ভেজা তাই তার কাছে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করার মতো। অন্তত আমার কাছে ব্যাপারটা ওরকমই। আমিও বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করি।
যাহোক, অনেক ব্যক্তিগত কথকতায় ভরা এই লেখায় আরেকটি ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বলে প্রসঙ্গ শেষ করা যাক। আগেই বলেছি, আমার জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে বৃষ্টির একটা সম্পর্ক আছে। সেসব ঘটনার অধিকাংশই ছিলো আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি যে মেয়েটির প্রেমে পড়েছিলাম (আমি অবশ্য একাধিকবার প্রেমে পড়েছি, কিন্তু এই একটি মাত্র মেয়ের সঙ্গে সারাজীবন পাশাপাশি থাকতে চেয়েছিলাম! তবে মজার ব্যাপার হলো মেয়েটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানানোই হয়নি), তার সঙ্গে খুব আকস্মিক এবং অনিচ্ছাকৃত বিচ্ছেদ ঘটে আমার। বাড়ি থেকে খবর আসে যে, তার মা খুব অসুস্থ। সে বাড়িতে মাকে দেখতে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। মৃতু্যপথযাত্রী মায়ের কথা রাখতে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে। তো যেদিন ও বাড়িতে যায়, আমার সঙ্গে সেদিন তার দীর্ঘ-দীর্ঘ কনভারসেশন হয়। খরাতপ্ত চৈত্রের দুপুর ছিলো সেটি। সম্ভবত কয়েকবছরের মধ্যে সেটিই ছিলো সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী খরা। বৃষ্টির জন্য, একটু মেঘমেদুর আবহাওয়ার জন্য সারাদেশ তখন কাঁদছে। পুড়ে যাচ্ছে গাছপালা, ফসল, আর মানুষের জীবন। তো, যেহেতু পরস্পরকে ভালোবাসা-ভালোলাগার কথাটি তখনও না বলাই থেকে গেছে, আমি ওর মুখ থেকে সেটা শুনতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ও ছিলো খুব বিষণ্ন হয়ে, জানি না আমাদের আসন্ন বিচ্ছেদের ব্যাপারটা ও আগেই আঁচ করতে পেরেছিলো কী না! কীভাবে ওর মুখ থেকে কথাগুলো শোনা যায় ভাবতে ভাবতে আমি ওকে বললাম-
'এই যে তুমি কিছুই বলছো না, তার কারণ তুমি এই শহরের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে থেকে নিজের মনের দরজা খুলতে পারছো না। অথচ, মনে করো, তুমি এই শহরে নও, আছো নির্জন বনভূমির মধ্যে কোনো এক বাংলোয়। একা নও, ধরা যাক আমার সঙ্গেই আছো। তখন যদি তুমুল বৃষ্টি নেমে আসে, আর তোমার ভেতরের কান্নার সঙ্গে যদি বৃষ্টির কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন দেখবে- এমনিতেই সব কথা বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে, অর্গল খুলে যাবে, অবচেতনের দেয়াল দুর্বল হয়ে যাবে... '
ও নিঝুম হয়ে কথাগুলো শুনছিলো। আমার কথা শেষ হতে একটু হেসে বললো- 'সবকিছু রোদে পুড়ে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন বৃষ্টির কথা। আপনি যে কী না! '(তখনও সে 'আপনি' থেকে 'তুমি'তে আসেনি।)
আমাদের কথা থামলো না, বরং ডালপালা ছড়িয়ে মোকাররম ভবনের করিডোর ছেড়ে সেই কথাগুলো আকাশে ডানা মেললো। তারও অনেকক্ষণ পর খেয়াল করলাম, আকাশ কালো হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরই ঝড়ো হাওয়া আর তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। হাওয়ায় ওর চুল আর আঁচল উড়ে এসে আমার চোখে-মুখে পড়ছিলো। কিন্তু ও ছিলো ভ্রুক্ষেপহীন। বিষণ্ন। একা। ওর চোখে ঘনিয়ে এসেছিলো স্বপ্ন। অথবা ঘোর। অথবা মেঘমেদুর বিকেলের ঘন ছায়া। প্রায় শোনা যায় না, এমনভাবে, ফিসফিস করে ও বললো-
'দেখেছো, প্রকৃতি তোমার কথা শুনেছে!' (এই প্রথম সে আমাকে তুমি করে বললো, আমার শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো।)
'প্রকৃতি তো শুনলো, মানুষটি যে শুনছে না!'
'মানুষটি তো অনেক আগেই শুনেছে, তুমি বোঝোনি?'
'না বোঝালে কি করে বুঝবো?'
'শুধু কি কথা শুনেছে, সে তো তার সর্বস্ব তোমাকে দিয়ে বসে আছে'-- বলতে বলতে ওর ঘোরলাগা চোখ ভরে উঠলো জলে।
জলভরা চোখ নিয়ে ও চলে গেলো।
তার বহুদিন পর, ওর সঙ্গে হঠাৎ যেদিন দেখা হলো, সেদিনটিও ছিলো বর্ষণমুখর আর চোখ ভরে ছিলো জলে।
অতঃপর আবার কোনো এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় চিঠিবিহীন এই যুগে মোবাইল ফোনে এসএমএস-চিঠি লিখি অন্য এক বন্ধুকে-
'এখানে তুমুল বৃষ্টি এখন। খানিকটা অসুস্থতা নিয়ে শুয়ে আছি- একা। দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাট এসে আমার চোখ-মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন তার করুণা-মমতা-ভালোবাসার জল ছিটিয়ে দিচ্ছে তার নিঃসঙ্গ সন্তানের চোখেমুখে। আমার ভালো লাগছে। ...বাড়ির কথা মনে পড়ছে...আমার চোখ ভিজে উঠছে।'
উত্তর আসে--
'আপনি তো দেখছি মহাকবি কালিদাস! মেঘবৃষ্টি হলেই আমার কথা মনে পড়ে!...মা কিংবা বাড়ির কথা মনে হলেই আপনি আমাকে এসএমএস করেন। আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। এক দৌড়ে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে। আমাদের বাড়ির উঠোনে বিশাল একটা বকুল গাছ আছে। আর কদিন পরই বকুল ফুল পড়ে উঠোনটা সাদা হয়ে যাবে। আর কী যে গন্ধ! খুব টানে আমাকে। আমার টিপের প্যাকেটে ওই বকুল গাছটার দুটো পাতা রেখে দিয়েছি। পাতা দুটো হাতে নিলে গা শিরশির করে ওঠে আমার।'
বন্ধুর এসএমএস আমার মন খারাপ করিয়ে দেয় নতুন করে। আমরা দুজনই অথবা আমাদের মতো আরো অনেকেই হয়তো বাড়ি ফিরতে না পারার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। কেউ রেখে দিই বকুল গাছের দুটো পাতা, কেউ কেবলই স্মৃতি।
আর অনেকদিন পর শহরে বৃষ্টি নেমে এলে ভাবি, কতোদিন পর আজ বৃষ্টি হলো! কতোদিন! কতো যে মুখ ভেসে ওঠে চোখে! কতো স্মৃতি! তুমুল বৃষ্টিতে বাড়ির উঠোনে ভাইবোনদের সঙ্গে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি খেলছে অথবা টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে আর ঘরে থাকতে না পেরে উঠে গিয়ে বৃষ্টির পানি হাতে-মুখে মেখে নিচ্ছে যে কিশোর, আমার বন্ধু আহসান কবীর জামানের সঙ্গে রিকশায় যেতে যেতে হঠাৎ বৃষ্টি এলে ওর আপত্তি অগ্রাহ্য করে রিকশার হুড না ফেলেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আর হেড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে চলেছে যে তরুণ, অথবা তপ্ত খরার পর একটানা বৃষ্টির মধ্যে প্রিয়তম মানুষটির সঙ্গে কথা বলে চলেছে ওই যে যুবক তাকে কেন এত চেনা লাগছে? ওইসব জীবন কি কখনো আমার ছিলো?
বাইরে বৃষ্টির শব্দ বাড়ে। অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে একসময় জানালায় গিয়ে দাঁড়াই। নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টিতে ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে চরাচর। এই শহরের সমস্ত ক্লান্তি, জঞ্জাল, পাপ, বেদনা, আর হাহাকার কেন ধুয়ে মুছে যায় না? কী তুমুল, অহংকারী, একরোখা, জেদী বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা গ্রাহ্যের মধ্যেই আসে না আমার। মনে হয়, আমাদের গ্রামে ঠিক এইরকম বৃষ্টি হতো। বিড়বিড় করে আমি কেবল বলতে থাকি, উদাসপুর - আমি তোমার কাছে যাবো।