আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলামঃ
"একদিন মা দিবস আর নারী দিবসে নারীদের শ্রদ্ধা দেখিয়ে বলো না তুমি মানুষ !
একদিন ভালোবাসা দিবসে আর বসন্তের কোন বিকেলে ফুল দিয়ে দাবি করো না তুমি প্রেমিক পুরুষ !
একদিন কোন গিফট দিয়ে , ভালোবাসি তোমাকে বলে ,একদিন কবিতা গান লিখে হবে না তুমি সেরা বীর পুরুষ ।
সারাবছর আমাকে নারী বানিয়ে নিজেকে পুরুষের দলে ফেলে আজীবন থেকে যাবে তুমি কাপুরুষ ।
যতদিন জানবে না যে আমিও তোমারই মত রক্তে মাংসে গড়া সমাজের একটা অংশ !
এই পৃথিবীর প্রাণীকুলের মাঝে আমিও একটা মানুষ ঠিক তোমারই মত ! ”
আজকে আমার এক বন্ধু আমাকে বলল আমি কেন এমন স্ট্যাটাস দিলাম? আমি কি মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য এমন স্ট্যাটাস দিলাম? নাকি একদিনের ভালোবাসাকে অবমূল্যায়ন করলাম? নাকি একদিন যে যাকে ভালবাসবে তাকে গ্রহন করার বা না করার সুযোগ দিলাম? কেনই বা চতুর্থ লাইনে নিজেই নারী পুরুষ দুইটি শব্দ লিখলাম!
এবার জবাব দেই ।
আমি নারী, এই নিয়ে আমার আফসোস নেই যে তা না আবার অহংকারও কম না। কেন আফসোস কেন অহঙ্কার সবাই কম বেশী জানে।কিন্তু কেন নারী হয়েও নারী শব্দের প্রতি বিদ্বেষ তা আজকে বলি । ছোটবেলায় আমাদের তিনবোনকেই বাবা চুল ছোট করে রাখতেন ,বাবার মধ্যে মেয়ে নিয়ে কোন আফসোস ছিল না, কিন্তু মেয়েলি চলাফেরার চাইতে উনি নিরঝঞ্ঝাট চলতে পছন্দ করতেন, চুল ছোট রাখলে সেই চুলের পেছনে ব্যয় করা সময় পড়ার কাজে লাগবে ,আজও সাজতে শিখিনি কেননা সেই ছোটবেলায় আব্বু/আম্মু কোনদিন মুখে রঙ মেখে প্রদর্শন করাটা শিখায় নি ।শিখিয়েছেন গানঅর্জন করতে ,শিখিয়েছেন প্রতিটি কর্মকে আনন্দের সাথে করতে ।
একটু বড় হলাম,তখন আমি ক্লাস ফাইভে পরি, আমরা তখন ময়মনসিংহে থাকি ,আব্বু বাজার করে বাসায় ফিরছিলেন ,কলেজে পডুয়া একটি মেয়েকে বেশ কিছু ছেলে রিক্সাশহ ঘিরে রেখেছে ,লোকজন তামাশা দেখছে ,কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না ,তখন কার পরিস্তিতি বর্তমানের মত ছিল না ,তখন কেউ সাহস করে এগিয়ে গেলেই চলত ,আমার আব্বু এগিয়ে গেলেন এবং পরিস্থিতি থেকে মেয়েটাকে বের করে আনলেন । বাসায় এসে আব্বু আমাদের বোঝালেন যে মেয়েরা রাস্তা দিয়ে যখন যাবে কেউ কিছু বললে জবাব দিবে না ,না শোনার ভান করবে ।মুল কথা কথার পিঠে কথা বলবে না ,কেননা তোমাদের সাহায্য করার মত কেউ থাকবে না পাশে ।তখন খুব কষ্ট লেগেছিল কেন কিছু বলব না ?
এটা কিছুই না ,এরপর অনেক ঘটনাই ঘটেছে জীবনে মেয়ে মেয়ে শুনতে শুনতে জীবন তেনা হয়ে আবার জীবনের দিকে মোড় নিয়েছে । ক্লাসে মেয়েদের ফলাফল ভালো হলে শুনতে হত স্যারদের সাথে ঘটনা ঘটাইয়া পার পাইছে ,অথবা ক্লাসের মেধাবী ছেলেটাকে পটাইয়া ,অফিসে বসকে পটাইয়া !
আমি নিজেই একদিন অবাক হলাম , টিভিতে একদিন একজন অনেক বড় কর্মকর্তা নাম মনে নেই সম্ভত এয়ারটেল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (মহিলা) বক্তব্য দিচ্ছিলেন আমার ভাই বলে উঠলেন এই মেয়েটার রেপুটেশন ভালো না ! আমি খুব কষ্ট করে এড়িয়ে গেলাম। আবারও বলল তার নামে অনেক স্ক্যানডেল আছে । আমি রেগে যেয়ে বললাম স্ক্যানডেল থাকলে থাকুক সেটা তার ব্যাপার সেটা এখানে আসছে কেন ?অথছ একজন পুরুষ যদি হত এই ধরনের স্ক্যানডেল তাদের যে থাকতো না তানা তাদের ক্ষেত্রে তো বলা হয় না তার স্ক্যানডেল আছে ?
চাকুরীতে ঢোকার পর দেখলাম কলিগরা নিজেদের আয়রোজগার নিয়ে খুব চিন্তিত ,ক্যারিয়ার নিয়ে ,বিয়ে শাদি করলে বাচ্চা কাচ্ছা ক্যামনে পালবে তা নিয়ে । আর আমাদের সামনে পরলেই বলবে আপানাদের কি চিন্তা আপা আপানারা তো কারো ঘাড়ে চড়বেন । বলি আজকাল গাধাও মাল টানে না তো কোন আহাম্মক আমাদের ঘাড়ে চড়াবে ? তোমরা মনে হয় কোন জবলেস মেয়ে বিয়ে করবা ,তোমাদের ঘাড়ে চড়াবা ? কিন্তু বলি না ।এভাবে বলি ভাই আপনারা টাকা দিয়া কি করবেন ? তারা ফামিলিকে দেয় ।আরে ভাই আমাদের ও তো ফেমিলি আছে ,বাবা মা আমাদের এত কষ্ট করে পড়াইছে ,আপনাদের টাকা দিয়া পড়াইছে আমাদেরও পড়াইছে ,আমাদের দেশের প্রতিও দায়িত্ত আছে এই দেশে আমাদের মেয়েদের পড়াশুনা ভালো মত হয় সেজন্য সরকার আলাদা উপবৃত্তি ও দিছে তাহলে আপনাদের চাইতে আমাদের তো চাকুরি করে পরিবার সমাজ দেশকে সাহায্য করা বেশী দরকারি তাই না ?
আপা আজকে খাওান ,আমি বলি কেন ?আরে আপানারা মাইয়া মানুষ কাম কি ? রান্না কইরা আনবেন! কি যুক্তি যাও খাওয়ানোর ইচ্ছা থাকে তাও গায়েব হয়ে যায় ।এই হল অবস্থা ।
মেয়ে শব্দটার প্রতি তাই আমার এত বিদ্বেষ । না আমি ক্লাসের নেত্রী হতে চাই নি ,অথচ যখনি কোন কথার পিঠে কথা বলি ,সত্যি কথা বলি তখনই শুনতে হয় আপনি তো নারীনেত্রী ,এই কথা স্কুল থেকে অফিস পর্যন্ত শোনা হয়ে গেছে, এখন আমাকে কেউ এই উপাধি দিলে রেগে যাই না বিরক্ত হই !
হুম স্বীকার করতে বাধ্য কিছু নারীর আচরণে আমাদের কে নারীর প্রতি বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয় তবে ভালো মন্দ মিলিয়ে মানুষ ,সে নারী হোক কিংবা পুরুষ । আমি নারীকে আলাদা স্থান দিতে বলিনি , একজন মানুষ হিসেবে সন্মান দাও ।যখনি তুমি আঙ্গুল দিয়ে বল আমি নারী তখনি নিজেকে বল পুরুষ ,কেন আমাকে তো মানুষ হিসেবে মনে করত পারো ।অফিস থেকে বাসায় খুব তাড়াতাড়ি চলে আসি ,তাড়াতাড়ি মানে এই নয় যে সময়ের আগে আসি ,আটঘণ্টা কাজ করে আসি ,বের হবার সময় শুনি চলে যাচ্ছেন ? আপনাদেরই মজা আমাদের তো রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় ,আমি খুব লজ্জিত হই । আমাদের সমাজ ব্যবস্থা যদি আমাকে নিরাপদে রাতে ঘরে ফেরার গ্যারান্টি দিত আমিও তোমার সাথে রাত জেগে কাজ করতাম আমার ভাই ।আমি মাথা নিচু করে চলে যাই । একই বেতনে দুইজন কর্মচারী দুইভাবে কাজ করে ! আমি আবারও লজ্জিত হই ।তখন আমি মানুষ হতে নারী হয়ে যাই ।আমি কিন্তু বাসের সেই মহিলা আসনের সিটটির জন্য অপেক্ষা করি না ,আমি নিজেই ছেড়ে দেই অন্য কাউকে , আমি যদি অথর্ব হয়ে যাই সেদিন যেন কেউ আমাকে জায়গা দেয় সেই আশায় , নারী হিসেবে নয় ।
অথচ এই মানুষটি কিন্তু মা হয়ে নির্দ্বিধায় সব কাজ করে যাচ্ছে বিনা পারিশ্রমিকে কোন একটি পরিবারে সেটা না হয় সবাই অগোচরেই থাকে তার জন্য কোন স্পেশাল এওয়ার্ড থাকে না ,বেষ্ট এমপ্লয়ি হবার ,হাই ক্যারিয়ার সম্পন্ন মানুষ হবার সাধ সেদিন ছেড়ে দিতে হয় ।আমার অফিসের প্রথম লিড ইঞ্জিনিয়ার আপু জব ছেড়ে দিলেন কিছুদিন আগে , মনটা খারাপ হয়ে গেছিল আমিও হয়ত কদিন পর ওনার পথের পথিক হব । আপু ৬ মাস মাত্রিত্তকালিন ছুটি নিয়েছিল ,এরপর আরও একমাস ,এরপর আর পারলেন না চাকরিটা ছেড়েই দিলেন ।অনেকই বলে মেয়েরা টেকনিক্যালে কম কেন ? উচ্চ শিক্ষায় কম কেন ? কেন এইজন্য যে তাকে নারীত্বের দায়িত্ত পালন করতেই হয়। আমার দুইভাগে বিভক্তি পছন্দ না ,তুমি আমাকে সন্মান দাও তুমিও সমান সন্মানী পাবে । কেউ কারো থেকে কম না, সুযোগ পেলে একটি মেয়ে একটি ছেলের চাইতে বেশী কিছু করতে পারে । গতদিন শুনলাম আমাদের নাকি সব মেয়েদের অফিস থেকে ছেলেরা কেক কেটে শুভেচ্ছা জানাবে ,আমি অবশ্য বরাবরের মতই আগেই চলে এসেছি তাই জানি না কি হয়েছে । তবে মনে মনে হাসলাম বাবারা , পুরো একটা বছর তোমাদের জন্মদিন পালন করেছি টিমে দুইজনের জন্মদিন কেউ ১ বছরে উদযাপন করলানা ,আর সেই দুই অভাগা আমরা দুই নারী !
এই সেই নারী যে কিনা প্রকৃতপক্ষে উপেক্ষিত অথচ বিশেষ দিনে সন্মানিত চাই না সেই সন্মান যেটা সারাবছর উপেক্ষিত থাকে আর একদিন বন্যায় ভাসিয়ে দিবে ! চাই প্রতিদিনের সন্মান ,শ্রদ্ধা ,ভালোবাসা তো অন্য জিনিস সেটা তো আসবেই !
“সারাবছর আমাকে নারী বানিয়ে নিজেকে পুরুষের দলে ফেলে আজীবন থেকে যাবে তুমি কাপুরুষ ”।
ভালো থাকা হোক সবার সবসময় ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:৩৮