মনসুর মিয়া হাতের ঘড়ি দেখছে বারবার । কিছুটা উত্তেজিত দেরি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। হারামি শ্যামল টা এখনো আসছে না। টাকাটা তো ওকে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে, মটর সাইকেলে করে নিয়ে আসবে, টাকা দিয়ে জিনিস নিয়ে ব্যাস।সোজা বাসা। ওদিকে ওদের সাথে কথা হয়েছে ১০ মিনিট আগে। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে কখন আসবে।
শামীমের উচিত ছিল পড়াটা ঠাণ্ডা মাথায় চালিয়ে যাওয়া। কালকে পরীক্ষা। এই তিনমাস তো কম পরিশ্রম করল না। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছে না। একদম পাকা নিউজ। শাকিল ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া পাকা নিউজ, কোন মিস নাই। স্নিগ্ধা কে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বললে হয়। কমার্সের পরীক্ষার ঢের দেরি আছে। মেডিকেলের পরীক্ষা সবার আগে হয়। কোন মিস নাই মেডিকেলে এইবার। আব্বুর তো কম টাকা না। একটু মাসুমকে ডিস্টার্ব করি।শালা তো ভাল জায়গায় চান্স পাবে।
মনসুর মিয়া অন্ধকারে দাঁড়ায় আছে। সামনে চায়ের দোকানে বসলে হয়। নিজ এলাকা থেকে দূরে, তাও কেউ যদি চিনে ফেলে জিজ্ঞেস করে এত রাতে কি করছে এইখানে। অন্ধকারে ভাবতে ভাবতে কই যেন হারায় গেল মনসুর মিয়া। সেই এস.এস.সি পাশের পর পরিবারে ধাক্কা লাগে। কি করবে না ভেবে পেয়ে পাশের শাড়ী কাপড়ের দোকানে কাজ নিয়ে রাখেন। পরিবার টানতে হবে তো। আজ এত বছর পর মার্কেটে তার তিনটা দোকান। ব্যবসা তুঙ্গে। টাকা পয়সা আল্লাহ দিয়েছেন। এখন চান ছেলেটা মেডিকেলে চান্স পেলে হয়। ছেলে ডাক্তার হবে, বাপের মুখ উজ্জ্বল করবে। দুই লাখ কেন আরো দুই লাখ খরচ করতে সমস্যা নাই।
শামীমের মোবাইলে সন্ধ্যা হতেই শাকিল ফোন দেয়। শাকিল চালু ছেলে।
-শামীম আছো?
- জি শাকিল ভাই।
- তা প্রিপারেশন কেমন?
- শাকিল ভাই ভাল না। ভয় লাগছে।
- মিয়া ভয় দূর করার ওষুধ পাইছি তো
-কন কি? কি ওষুধ?
- আরে সেদিন কইলাম না, ঐটা, তবে দাম একটু বেশি যে
- ও বুঝছি, কত?
- দুই লক্ষ। হার্ড ক্যাশ।
- দুই লক্ষ ভাই!! কই পাবে?
- আরে পাওয়ার কি আছে? তোমার আব্বারে কও । বুঝিয়ে বল না হলে আমারে ফোন দিও
শাকিল ভয়ে ভয়ে মনসুর সাহেবের সামনে গেলো। ইদানীং মার্কেট থেকে সন্ধ্যা হলে চলে আসে। ছেলের পরীক্ষা চলছে। বাসায় থাকা ভাল। মনসুর সাহেবের কাছে কথা বলেই শামীম বুঝলো বাপ রাজী হবে না। না পেরে ফোন ধরিয়ে দিল শাকিল ভাই এর সাথে
- আংকেল সালাম
- হা বল তুমি
- আংকেল সোজা কথায় বলি। বাজারে ছেয়ে গেছে এই জিনিস। অনেকেই কিনছে। না কিনে ভাল জায়গায় চান্স পাওয়া মুশকিল। শামীম আমার ছোট ভাই এর মত তাই ভালর জন্য বলছি আংকেল। মাত্র দুই লক্ষ।
- তুমি কত পাবা? দুই লাখের
- আংকেল কি যে বলেন। আমার কিছু নাই। শামীম ছোট ভাই তাই বলছি আপনাকে। এখন ওদের কে দুই লাখ দিলে হয়ত কিছু আমাকে দিবে। এমনি তিন চারের কমে রাজি হচ্ছে না। আমার ক্লোজ তাই দুই তে রাজি হয়ে গেছে
- ঠিক আছে। আমি আসছি। তোমার কাছে । মোবাইলে কথা হবে।
- আংকেল কোন চিন্তা করেন না। টাকা লস যাবে না। গ্যারান্টি আমি।
ছেলে কে ডাক্তার বানানো জরুরি। মনসুর সাহেব ভাবলেন ক্যাশে কি এত টাকা আছে। ব্যাঙ্ক তো বন্ধ । তারপর শ্যামলরে ফোন দিলেন। শ্যামল এখন তার ব্যবসা দেখে। সকল কাজের কাজী টাইপ ছেলে। টাকাও ম্যানেজ করবে, সাথে ওকে নিয়ে গেলেও হয় ।এসব ব্যাপারে একা না যাওয়ায় ভালো। শামীম ভাবলো, হয়ে গেছে কাজ। আর চিন্তা করতে হবে না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনসুর সাহেব ভাবছেন, শামীম কে ডাক্তার বানানোর ইচ্ছে আগে থেকে। তার আব্বা সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন। পড়াশোনা ছেড়ে দোকানে কাজ করতে হল। আর তার ছেলে হবে ডাক্তার। মটর সাইকেলের শব্দে চমকিয়ে উঠলেন। শ্যামল চলে আসছে। মটর সাইকেলে চড়তে চড়তে জিজ্ঞেস করলেন
- নিয়ে আসছিস
- হা পেলাম। আজকে ভাল ক্যাশ ছিল।
- চল তাহলে, জানিস তো কোথায় যেতে হবে।
মটর সাইকেল চলছে। মনসুর সাহেব আবার চিন্তার জগতে হারিয়ে গেলেন। আব্বাটা ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। আর আজ তার ছেলে ডাক্তার হয়ে যাবে।আচ্ছা শামীম কি ভাল ডাক্তার হবে? না হলে তো সমস্যা। আচ্ছা কি করে ভাল ডাক্তার হবে? তাঁকে তো তিনি দু নম্বরি পথে ভর্তি করাচ্ছেন। আজ এত বছর ধরে ব্যবসা করেন তিনি, দুই নম্বর পথ এড়িয়ে চলেছেন সব সময়। অথচ তার ছেলে ডাক্তার হবে দুই নম্বর উপায়ে। ছি ছি ছি। লেখাপড়া কম করেছেন জীবনে কিন্তু এইটুকু বুঝেন এইভাবে শুধু সে তার ছেলের ক্ষতি করছে না দেশের ক্ষতি করছে। হায় হায় এদের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কত অযোগ্য পোলাপান প্রশ্ন কিনবে। থামাতে হবে।
-শ্যামল মটর সাইকেল থামা
- কি হল ভাই
- ঐ র্যাবে তোর কে যেন আছে না?
- হা পাশের বাড়ির এক বড় ভাই আছে, অফিসার।
- নিয়ে চল এখনই আমাকে ঐ খানে
-ক্যান?
-আরে নিয়ে চল কথা বাড়াস না
র্যাব অফিসের সামনে যেয়ে শ্যামল কে আগে ভিতরে পাঠালেন মনসুর মিয়া। সে সময় তিনি শামীম কে ফোন দিলেন
- হা আব্বু পেলা
- শামীম, মন দিয়ে শুন। মোবাইল অফ করে পড়তে বস। কিচ্ছু পাওয়া লাগবে না। যা বলছি কর
- আব্বু কি বলছ তুমি?
- শুন ব্যাটা। ডাক্তার হওয়ার চেয়ে আগে মানুষ হওয়াটা জরুরি। তুই মানুষ হ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৭