সুজন এক মনে বসে আছে। কাস্টমার কম আজকে। উদাস মনে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। শহরের নামী এক রেস্টুরেন্টে কাজ করে সে। সাধারন মানুষের ভাষায় সে ওয়েটার। ওয়েটার শুনলে মনটা খচখচ করে সুজনের। পরিপাটি পোষাক, মার্জিত কথাবার্তা তাঁদের, যদিও বেতন টা বলতে যাওয়া লজ্জাজনক, তাও একটা ব্যাপার থাকে না। ওয়েটারের বিকল্প শব্দ কি হতে পারে তাই নিয়ে ভাবছে। সুজনের একটা জিনিস ভাল লাগে, এই রেস্টুরেন্টের অনেকে এসে ওকে ভাইয়া বলে ডাকে কিংবা ভাই। সুজন ভাই বলেও ডাকে অনেকে। খারাপ লাগে না এইটা শুনতে। শিক্ষিত স্মার্ট ছেলে মেয়েদের ডাকার ধরন টাই আলাদা।
“সুজন ভাই একটু শুনেন”। চিন্তায় ছেদ পরল সুজনের। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরুন টা রেস্টুরেন্টের নিয়মিত আসা যাওয়া করে। “ জি স্যার বলেন, কি করব”। “ আমাদের এক বান্ধবীর আজ কে জন্মদিন, ওরা কিছুক্ষন পর আসবে, উইশ করব। আপনি আমরা বসার পর এই কেক টা নিয়ে যেয়ে ওর সামনে দিবেন। আর আমরা চিৎকার করে ওকে সারপ্রাইজ দিবো”। “ ঠিক আছে স্যার কোন সমস্যা নাই, আপনেরা এসে বসেন, আমি নিয়ে যাবো”।
খুব সাধারন একটা কাজ, সুজন প্রায় করে। বার্থডে পার্টি তো লেগে আছেই হরহামেশা। হইচই করতে করতে ঢুকে গেল আজকের বার্থডে পার্টির দল। যে মেয়েটার জন্মদিন সে আজকে নীল শাড়ি পরে আসছে। চট করে বুঝা না গেলেও সুজনের অভিজ্ঞ চোখ ঠিকই ধরে নেয় কার জন্মদিন আজকে। এই বয়সের মেয়েরা শাড়ি পরে না, জন্মদিন বলে হয়ত বাসায় কেউ জোর করে পরতে বলেছে, কিংবা এই বন্ধুদের মধ্যে থাকা কোন প্রিয় মানুষের অনুরোধে।
ইশারা পেয়ে কেক নিয়ে চলে গেল সুজন। সামনে রাখতেই সেই পরিচিত চিৎকার, হ্যাপি বার্থডে দোস্ত। মেয়ের অবাক হয়ে যাওয়া কিছুটা। সুজন সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সুজন ভাই নাইফ কই? আড্ডার মধ্যে থেকে কথাটা ভেসে আসতেই নাইফ টা মেয়ের হাতে দিয়ে সুজন বলে উঠল, “ হ্যাপি বার্থডে ম্যাম। অনেক অনেক শুভেচ্ছা। জানেন আর তিনদিন পর আমারো জন্মদিন”। এই কথাটা বলে থেমে গেল সুজন, সবাই ওর দিকে তাকিয়ে। চট করে চলে আসলো সুজন জায়গা ছেড়ে।
সুজনের উচিত হয়নি কথাটা বলা, সে এক ওয়েটার, সে কেন এই কথা বলবে। ওরা যদি কমপ্লিন দেয়? কিন্তু জন্মদিন কথাটা মাথায় চেপে গেছে ছোট থেকে, বাবা ছিলেন সামান্য দোকানদার। জন্মদিন মনে রাখার কথা না, কিন্তু সুজনের যেদিন জন্ম হয়, ওদের এলাকার চৌধুরি বাড়ির ছেলে আসিফের ও সেদিন জন্ম হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, প্রতিবছর আসিফ চৌধুরির জন্মদিন ধুমধামে পালন হত। আর তা দেখেই সুজন বুঝত কবে তার জন্মদিন।
তিনদিন পরের কথা, সুজনের আজ জন্মদিন। কাজের চোটে ভুলেই গেছে সে কথা। সকাল থেকে রেস্টুরেন্টে ভিড় লেগে আছে। দুপুরে বেশ বড়সর একটা গ্রুপ কে খাবার সার্ভ করতে করতে সুজনের মাথায় আর অন্য কোন চিন্তায় আসেনি। গতদিন পর্যন্ত ওর মনে ছিল জন্মদিনের কথা। চৌধুরি পরিবারের ধুম ধাম জন্মদিন দেখে সুজনের বাবা একটা ছোট্ট ড্রাই কেক নিয়ে আসতেন। রোজকার সন্ধ্যায় জ্বালানো মোমবাতি টা বিকেল বেলায় জ্বালানো হত। সুজন মোমবাতি ফু দিয়ে কেক টা খেয়ে ফেলত। বাবা মারা যাবার পর আর জন্মদিন করে উঠা হয়নি। আর চৌধুরি পরিবার ও চলে গেছে বাহিরে।
বিকেল বেলায় রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করল ইকবাল। দেখলো সুজন এক কোনে বসে আছে। আজকের এক বার্থ ডে পার্টির জন্য তার হাতে কেকের প্যাকেট। এই শহরে যে কোন ভাল কাজে ইকবাল এক পরিচিত মুখ।
“সুজন ভাই শুনেন”। “ জ্বি স্যার বলেন”। কিছুটা ক্লান্ত সুজন। “ এই নেন কেকের প্যাকেট। কিছুক্ষন পর আমাদের একটা গ্রুপ আসবে। সার প্রাইজ দিতে হবে। বুঝছেন তো কি করতে হবে”। “জ্বি স্যার”। ইকবাল ছেলেটা কে চিনে সুজন। নিয়মিত আসে, আড্ডা গুলোতে তিনি সবচেয়ে বেশি মজা করেন আর কি। কিছুক্ষন পর হই চই করে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো ইকবালদের গ্রুপ। সুজন খেয়াল করল, কিছুদিন আগে যে ম্যাডামের জন্মদিন ছিল তিনিও আছেন। ব্যাপার কি, এদের জন্মদিন লেগেই থাকে নাকি।
কেকের প্যাকেট টা নিয়ে এগিয়ে যেয়ে দেখে মাঝখানে, ইকবাল স্যার বসা। ব্যাপার কি উনার জন্মদিন নাকি? প্যাকেটটা থেকে কেক বের করে দিয়ে এগিয়ে দিলে সুজন। ঠিক সে সময়ে সবার হইচই করে বলে উঠা, “হ্যাপি বার্থ ডে সুজন ভাই”!!!! “ হাতে নাইফ নেন আর তাড়াতাড়ি কেক কাটেন তো”। প্রথমে বুঝতে পারেনি সুজন, কিছুক্ষন পর দেখলো ওরা তাকেই উইশ করছে। কেকের উপরে সুন্দর করে সুজনের নাম লিখা।
কিছুক্ষনের জন্য সুজন কে ঘিরে ছোটখাটো উৎসব। মুখে কেক খাওয়ে দেওয়া, ক্রিম মাখানো। কেউ কিছু বলেনি কিন্তু সবাই খেয়াল করেছে, মুখে হাসি থাকলেও সুজনের চোখে পানি চিক চিক করছিল। এই পানি আনন্দের। আজকের দিন সুজনের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাওয়া জীবনের এক কোনে সুখের চিহ্ন হিসেবে থাকা স্মৃতি।
উৎসর্গঃ ব্লগার মিনহাজুল হক শাওন । শুভ জন্মদিন ভাইয়া।