আসলে প্রকৃত ইসলাম আর আজকের ইসলামের মধ্যে হয়তো অনেকখানি পার্থক্য ঢুকে গেছে। মহানবী (সঃ) এর দেয়া বিদায় হজ্বের কথাগুলো পড়লে বুঝতে পারবেন ইসলাম সত্যিকারের কতো মহান। কিন্তু কতিপয় গোষ্টি ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে এই মহান ধর্মটির অনেক ক্ষতি করছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী, অন্য ধর্মের অনুসারী এবং আস্তিক ও নাস্তিক সর্বস্তরের মানুষকে একবার বিদায় হজ্বের ভাষন পড়ে দেখার অনুরোধ করছি।
[শুক্রবার, ৯ জিলহজ, ১০ হিজরি সনে হজ্বের সময় আরাফা ময়দানে দুপুরের পর হযরত মুহাম্মদ (স) লক্ষাধিক সাহাবার সমাবেশে এ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। হামদ ও সানার পর তিনি বলেন]
হে মানুষ! তোমরা আমার কথা শোনো। এর পর এই স্থানে তোমাদের সাথে আর একত্রিত হতে পারবো কি না, জানি না। হে মানুষ! আল্লাহ বলেন, ‘হে মানব জাতি! তোমাদেরকে আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো’।
অতএব শুনে রাখো, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। আরবের উপর কোনো অনারবের, অনারবের উপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালোর বা কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লার কাছে বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহকে ভালবাসে।
হে মানুষ! শুনে রাখো, অন্ধকার যুগের সকল বিষয় ও প্রথা আজ থেকে বিলুপ্ত হলো। জাহিলি যুগের রক্তের দাবিও রহিত করা হলো।
হে মানুষ! শুনে রাখো, অপারাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর উপরই বর্তায়। পিতা তার পুত্রের জন্যে আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্যে দায়ী নয়।
হে মানুষ! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ী ভাবে হারাম (অর্থাৎ পবিত্র ও নিরাপদ) করা হলো, যেমন আজকের এই দিন, আজকের এই মাস, এই শহর সকলের জন্য হারাম।
হে মানুষ! তোমার ঈর্ষা ও হিংসা-বেদ্বশ থেকে দূরে থাকবে। ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সকল সৎগুণকে ধ্বংস করে। হে মানুষ! নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করো না। তাদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপর তাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণের দিকে সবসময় খেয়াল রাখো।
হে মানুষ! অধীনস্থদের সম্পর্কে সতর্ক হও। তোমরা নিজেরা যা খাবে, তাদেরও তা খাওয়াবে। নিজেরা যা পরবে, তাদেরও তা পরাবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানো আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।
হে মানুষ! বিশ্বাসী সেই ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে অন্যের সম্মান, ধন ও প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে অন্যের জন্যেও তা-ই পছন্দ করে।
হে মানুষ! বিশ্বাসীরা পরস্পরের ভাই। সাবধান! তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মত কুফরি কাজে লিপ্ত হয়ো না।
হে মানুষ! শুনে রাখো, আজ হতে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা কৌলিন্যপ্রথা বিলুপ্ত করা হলো। কুলীন বা শ্রেষ্ঠ সে-ই যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে।
হে মানুষ! ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। বিশ্বস্ততার সাথে প্রত্যেকের আমানত রা করতে হবে। কারো সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারো জন্যে হালাল নয়। তোমরা কেহই দুর্বলের উপর অবিচার করো না।
হে মানুষ! জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান। জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্যে ফরজ। কারণ জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে তোমরা চীনে যাও।
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে। নামাজ কায়ের করবে, রোজা রাখবে, যাকাত আদায় করবে, হজ করবে, আর সঙ্ঘবদ্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করবে; তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
হে মানুষ! শুনে রাখো, একজন কুশ্রী কদাকার ব্যক্তিও যদি তোমাদের নেতা মনোনিত হয়, যতদিন পর্যন্ত সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবে, ততদিন পর্যন্ত তার অনুগত্য করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য। হে মানুষ! শুনে রাখো আমার পর আর কোন নবী নেই।
হে মানুষ! আমি তোমাদের কাছে দুটি আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটোকে অনুরসণ করবে, ততদিন তোমার সত্য পথে থাকবে। এর একটি হলো আল্লার কিতাব। দ্বিতীয়টি হলো আমার জীবন-দৃষ্টান্ত।
হে মানুষ! তোমরা কখনই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। কেননা অতীতে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। হে মানুষ! প্রত্যেককেই শেষ বিচারের দিনে সকল কাজের হিসেব দিতে হবে। অতএব সাবধান হও। হে মানুষ! তোমরা যারা এখানে হাজির আছো, আমার এ বাণী সবার কাছে পৌছে দিও। (এরপর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন)
হে মানুষ! আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌছে দিয়েছি? সকলে সমস্বরে জবাব দিলো: হ্যাঁ!
এরপর নবীজি (স) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো! আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি।