বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও নির্ভীক (পরিবেশবাদী সংগঠন) এর যৌথ আয়োজনে আগামীকাল ১৩ জুন ২০০৯, শনিবার সকাল ১০: ৩০ টায় মেঘনাঘাটে (সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ) ‘‘টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ কর, মেঘনা নদী রক্ষা কর’’ এই দাবীতে এক সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। কর্মসূচীতে বাপা’ ও নির্ভীক এর নেতৃবৃন্দসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিনিধিগন অংশগ্রহণ করবেন।
সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত বিশেষ করে মণিপুর, মিজোরাম ও আসাম রাজ্যের লাখ লাখ আতংকিত, ক্ষুব্ধ জনতা এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের কোটি কোটি উদ্বিগ্ন মানুষের মতামত ও প্রতিবাদের পরও শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বর মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় শক্তি মন্ত্রণালয় মণিপুর রাজ্যের টিপাইমূখ নামক স্থানে বরাক ও টুইভাই নদীর সংযোগস্থলের কাছে বহুল নিন্দিত টিপাইমূখ বাঁধ বহুমূখী বাঁধ প্রকল্পের বাস্তবায়নে সম্মতি প্রদান করেছে। এটির নক্সা চূড়ান্ত, প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই। সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে ১০০ কিঃমিঃ দূরে নির্মিত হবে এই নদী সংহারক বৃহৎ বাঁধ। এর দৈর্ঘ হবে ১৫০০ ফুট ও উচ্চতা হবে ৫০০ ফুট। এই বাঁধের কাংখিত বিদ্যুৎ উৎপাদন মতা হবে ১৫০০ মেগা ওয়াট, ন্যূনতম প্রাথমিক উৎপাদনমাত্রা হবে কমপে ৪ শত মেগা ওয়াট। বাঁধটি তৈরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত নর্থ ইষ্ট ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন (নিপকো) আগামী ২০১২ সালে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার কথা ভারতীয় সরকারকে নিশ্চিত করেছে। অথচ খোদ ভারতীয় জনগনই এই বাঁধ নির্মাণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কারণ কথিত পরিমানণর বিদ্যুতের বদলে মণিপুর, মিজোরাম ও আসামের মানুষ ও পরিবেশ ব্যাপক ক্ষতির সম্মূখীণ হবে, বরাক ও অন্যান্য নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাবে ১৭, ৩৫৪ কিউসেক। বাঁধ সংলগ্ন বিরাট এলাকা জলমগ্ন হবে, উৎখাত হবে ১৩২০টি আদিবাসী পরিবার, বিনষ্ট হবে তাদের ২৭, ২৪২ হেক্টর বন ও পাহাড়ী ভূমি। আমরা জানি বরাক নদীই বাংলাদেশে প্রবেশের পর সুরমা ও কুশিয়ারায় বিভক্ত হয়েছে যা পরবর্তীতে আবার যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে মেঘনার। অর্থাৎ বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা একই পানি প্রবাহ যা সর্বমোট ৯৪৬ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত হয়ে আছে। এর মধ্যে ভারতে রয়েছে ২৭৭ কিলোমিটার আর ৬৬৯ কিলোমিটার বাংলাদেশে। আমরা জানতে পেরেছি যে, ভারত শুধু জলবিদ্যুতের জন্য টিপাইমূখের বাঁধ বানিয়েই ক্ষান্ত হবে না, বরাকের আরেকটু উজানে ফুলারতল এলাকায় তারা আরেকটি সেচ-ব্যারাজও নির্মান করবে যার মাধ্যমে শীতকালে প্রচুর পানি কৃষিকাজের জন্য বরাক থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। এসব বাঁধ নির্মিত হলে এই দীর্ঘ এলাকার পানি সরবরাহ হ্রাস পাবে, পাহাড়ী ও সমতল বন, গাছ-গাছালি, ফল-ফসল, কৃষি উৎপাদন, জলাশয়, অন্যান্য ছোট-বড় শাখা নদীসমূহ পানি বঞ্চিত হবে, শুরু হবে মরুকরণ, উপরের দিকে উঠে আসবে সামুদ্রিক লোনা পানি, জমি হবে লবণাক্ত, সৃষ্টি হবে পানীয় জলের সংকট, বিপর্যস্ত হবে বাংলাদেশের পরিবেশ ও কোটি জনতা। শুকনো মওশুমে পানি টিপাইমূখে আটকে রাখার ফলে বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা ও তৎসংলগ্ন ময়মনসিংহ এলাকা হবে শুষ্ক ও পানিশূন্য আর বর্ষার ভারি বর্ষনের সময় খোলে রাখা ফাডগেট থেকে প্রবল স্রোতের প্রচুর পানি নেমে এসে একই এলাকা বন্যায় ভাসাবে। এক হিসেবে বলা হয়েছে যে, টিপাইমূখ বাঁধ চালু হলে সুরমা নদীর পানি বর্ষাকালেই ৫ ফুট কমে যাবে, বঙ্গোপসাগরের লবন ঢাকা বেয়ে সিলেট শহরে পৌঁছুবে ১৫ বছরের মধ্যেই। তাছাড়াও ভূ-প্রাকৃতিক চরিত্রের কারণে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভূমিকম্প প্রবণ যে ছয়টি স্থান রয়েছে তার মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের এই টিপাইমূখ এলাকা অন্যতম। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিগত এক-দেড় শত বছরে সর্বমোট ১৮টি বৃহঃ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, সর্বশেষ ৫০ বছর পূর্বের আসামের ভূমিকম্পের পর পরবর্তী মারাত্মক কম্পন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। টিপাইমূখের মত বৃহৎ অবকাঠামো এই ভূ-কম্পনকে করবে ত্বরান্বিত, আর তার ধ্বংসযজ্ঞও হবে অনেক অনেক বেশি। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ। নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে সকল আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি, কনভেনশন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার পানি চুক্তি এবং ভারতীয় মন্ত্রীদের আশ্বাস মোতাবেক বাংলাদেশের জন্য তিকর কোন নদী-ভিত্তিক কার্যক্রম ভারত করার কথা নয়, কিন্তু বাস্তব অবস্থা তার উল্টো। বাংলাদেশমূখী সকল নদী নিয়ে আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্পসহ ভারতের এতসব কর্মযজ্ঞ অবাধে চলছে অথচ বাংলাদেশ সরকার বা যৌথ নদী কমিশন সেসব বিষয়ে যথাসময়ে বা যথেষ্ঠ অবহিত নয়।
অতএব আজকের সমাবেশ থেকে আমাদের জোর দাবীঃ
(১) অবিলম্বে টিপাইমূখ বহুমূখী জলবিদ্যুৎ ও সম্ভাব্য ফুলারতল সেচ প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
(২) টিপাইমূখ বাঁধের নক্সা, তার পরিবেশগত প্রভাব ও বাঁধের স্থায়িত্ব বিষয়ক প্রাক প্রতিবেদন বাংলাদেশকে দিতে হবে।
(৩) বাংলাদেশের সাথে আলাপ আলোচনা ব্যাতিরেকে দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কোন নদীর উপর কোন অবকাঠামো নির্মান করা চলবেনা,
(৪) নদীর উপর বেষ্টনীমূলক দৃষ্টিভঙ্গী নয় বরং মুক্ত-নদীর দৃষ্টিভঙ্গীভিত্তিক আঞ্চলিক পানি সম্পদ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে,
(৫) নদী বিষয়ক যে কোন একক বা যৌথ প্রকল্প প্রণয়নের পূর্বে উভয় দেশের নদী অববাহিকার জনসাধারণের মতামত গ্রহন বাধ্যতামূলক করতে হবে,
(৬) সকল দেশের নদী-পানি-পরিবেশের জন্য তিকর পদপে বন্ধের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে ভারত ও উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সকল পক্ষের জন্য উপকারী পানি সম্পদ নীতিমালা গ্রহন ও তা বাস্তবায়নে জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
(বিঃদ্রঃ - উপরের এই লেখাটি আমার নয়। বাপার একটি প্রেস রিলিজ। আমি কয়েকটি বানান ঠিক করেছি মাত্র। আমার পক্ষে টিপাইমুখ নিয়ে এত তথ্যবহুল লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু টিপাইমুখ সম্পর্কে আমাদের সকলের জানা দরকার। সে কারণে এ লেখাটি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। )