somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সোনালী ঐতিহ্যের নগরী সোনারগাঁও

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


“থাকবো নাকো বন্ধ ঘরে,
দেখবো এবার জগৎতটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।”
সত্যি আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের মনের কথাই বলেছেন। নাগরিক ব্যস্ততার মাঝে কার মন চায় চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকতে। সবাই চায় আপনজন, বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সুন্দর প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে।
আমি সর্বপ্রথম সোনার গাঁয়ের ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানার জন্য ও দেখার জন্য যাই ১৯৯৮সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে। তখন আমার সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলো আমার ক্লাশ ফ্রেন্ড আব্দুল্লাহ আল মামুন রানা। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত আমার সোনারগাঁও যাওয়া হয়নি। গত ১৫ আগস্ট ২০০৪ ইং সনে আমার নিকটতম বন্ধু তরুণ কবি রাকিব হাসান রুবেল আমাকে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশিষ্টত সোনারগাঁও জাদুঘর পরিদর্শনে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। সাথে সমর্থন করলো সাইফুল ইসলাম(মামুন) ও মহিদুল ইসলাম শাহ আলম। কারণ তারা আর কখনো সোনারগাঁও যায়নি। আমি যেহেতু একবার গিয়েছি তাই তারা আমাকে গাইড হিসেবে নিতে চায়। তাদের অনুরোধে আমি রাজি হয়ে গেলাম। দিন তারিখ ঠিক করা হলো ২০ আগস্ট ২০০৪ ইং রোজ শুক্রবার সকাল ৯ টায় আমরা সোনারগাঁয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো।
সোনার গাঁও বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পশ্চিম বঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। এটি ঢাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এখানে আছে মনোমুগ্ধকর বাংলার প্রাচীন রাজধানী গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশিষ্টত সোনারগাঁও জাদুঘর। এখানকার লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বরে রয়েছে বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট। এখানে বনভোজনের পাশাপাশি যে কেউ ভ্রমণ করতে পারেন অল্প খরচে। সোনাগাঁয়ের ইতিহাস বলে দেয় এর পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী, দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদী দ্বারা বেশিষ্টত একটি বিস্তৃত জনপদ। প্রাচীন বাংলার রাজধানী এবং ইতিহাসের এক গৌরববোজ্জল জনপদ ছিল এটি। ১৩৩৮ সালে বাংলার স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁয়ে বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন।
সোনার গাঁয়ের নাম নিয়ে যুগ যুগ ধরে লোক মুখে গল্প শুনে আসছি। কেউ বলে এই প্রাচীন নগরীর পাশে ছিল একটি সোনার খনি। বুড়িগঙ্গা থেকে ভেসে আসতো সোনার গুড়ো। সেই জন্য এই জায়গার নাম রাখা হয় ‘সুবর্ণ গ্রাম। আবার অনেকের ধারনা এই শহরটি নাম হয়েছে ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনা বিবির নামে। আর ওই নগরটি ছিল ঈসা খাঁর রাজধানী। আবার অনেকেই বলে পুরো এলাকার মাটি ছিল লালবর্ণ। সেই থেকে এই জনপদের নাম রাখা হয় সোনার গাঁও।
অপেক্ষায় ছিলাম কবে আসবে সেই দিনটি। এসেও গেল। কথা ছিল আমরা চারজন নরসিংদী প্রাইম হাসপাতালের সামনে সকাল ৯টায় উপস্থিত হব। আমি খুবই কর্তব্যপরায়ন। তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করি কথানুযায়ী কাজ করতে। আজকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আমি সব সময় সময়ই একটু আগেই উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করি। সেই মতে আমি পৌনে নয়টায় নির্দিষ্ট জায়গায় এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমার বন্ধুদের জন্য। ৯.১৫ মিনিটে মামুন আসল। পরে ৯.৩০ মিনিটে শাহ আলম আসল। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা থাকার পর ৯.৫০ মিনিটে এই ভ্রমণের নায়ক রুবেল আসল। তার এই বিলম্বে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো তার মনে নেই যে ৯টায় আসার কথা ছিল। সময়ের প্রতি কে কত সচেতন তা আমি জেনে গেলাম। তাদের জন্য আমাকে ‍অপেক্ষা করতে হয়েছে ১ ঘন্টা ৫ মিনিট।
রৌদ্র উজ্জল দিন কোথাও কোন মেঘের আভাস নেই। এমন এক সময়ে ভ্রমণ পিপাসু চার বন্ধু রিক্সাযোগে ভেলানগর ঢাকার বাসস্টেশন আসলাম। সাথে সাথে বাস পাওয়াতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। চার ভ্রমণপিয়াসী বাসে পাশাপাশি বসে গল্পে মেঠে উঠলাম। বাস চলছে দ্রুত গতিতে। সাড়ে এগারটায় আমরা কাঁচপুর পৌঁছলাম। সেখান থেকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমরা আবার মোগরাপাড়ার বাসে উঠি। ১২.৩০ মিনিটে আমরা মোগড়াপাড়ায় এসে নামলাম।
বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনার গায়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জানার জন্য আমরা এখানে আসলাম। নদী-নালা, খাল-বিল পরিবেষ্টিত এবং অসংখ্য গাছপালা সবুজের সমারোহ আমাদের মতো ভ্রমণ পিপাসুদের মন সহজেই আকৃষ্ট করবে। তাইতো এখানে ছুটে আসে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও বিদেশী পর্যটকরা। ঈসার খাঁর বাড়ীটি অসাধারণ স্থাপত্যশীল আর মধ্যযুগে পানাম নগরী কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দিবে আমাদেরকে।
মোগড়া পাড়া চৌ-রাস্তা দিয়ে একটু দক্ষিণ দিকে গেলে দেখা যাবে ইমারতরাজি, বারো আউলিয়ার মাজার, হযরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তার বংশধরদের মাজার, ইউসুফগঞ্জের মসজিদ, দমদম গ্রামে অবস্থিত দমদমদুর্গ, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজার, এটি ১৪১১ সালে নির্মিত হয়। এটি পুরো কষ্টি পাথর দিয়ে তৈরি। এলাকাবাসী এটিকে কালো দরজা বলে। সোনারগাঁয়ে আছে আরো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। স্থানগুলো হলো- ঐতিহাসিক পাঁচ পীরের মাজার, মোগড়াপাড়া দরগাহ শরীফ, গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোড, লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, লাঙ্গলবন্দের তীর্থ, বাড়ি মজলিশ, শাহছিল্লাপুর, বন্দর, নবীগঞ্জ, পোকাই দেওয়ানের সমাধি, পিঠাওয়ালিরপুল, ঐতিহাসিক মসলিন পাড়ার গ্রাম খাসনগর, খাসনগর দীঘি, মুসা খাঁর প্রাসাদ, গোয়ালদী, আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মসজিদ, পানাম সেতু, পঙ্খিরাজ খাল, কোম্পানির সেতুর, ঐতিহাসিক পানাম নগর, ট্রেজার হাউজ, পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাড়ি, হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি বারদী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, বারদি, মহজমপুর, সোনার গায়ের আমিনপুরে প্রায় চারশো বছরের পুরানো ক্রোড়ি বাড়ি, কুড়িপাড়া ইটের পুল ও দেওয়ানবাগ।


মোগড়াপাড়া এসে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কোথায় যেতে পারি। একদিনে তো এতগুলো দর্শনীয় স্থান দেখা যাবে না তাই সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো আমরা লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে যাব। সোনারগাঁ ফাউন্ডেশন জাদুঘর এলাকায় প্রবেশের পর হয়তো ভাত খাওয়ার সময় পাব না, তাই এখানে এক হোটেল থেকে ভাত খেয়ে নিলাম। তখন বেলা ১টা বাজে। তারপর এখান থেকে রিক্সাযোগে ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা সোনারগাঁ ফাউন্ডেশন এলাকায় চলে আসি। ফাউন্ডেশন এলাকায় প্রবেশ ফি জনপ্রতি ৪ টাকা আর এখানে আছে দুটি জাদুঘর। লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৩ টাকা এবং হস্ত শিল্প জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য ও জনপ্রতি ৩ টাকা।
আমরা টিকেট কেটে প্রধান ফটক পার হয়ে প্রবেশের পথেই দেখতে পেলাম হাতের বামপাশে এক পুকুর। সানবাঁধানো ঘাটলা। এর ডান পাশে আছে আরো একটি সানবাঁধানো ঘাটলা। এই ঘাটলার দু;পাশে আছে ঘোড়ায় সওয়াররত মানুষের দুটি মূর্তি। রুবেল ক্যামেরা এনেছিল। তাই এখানে আমরা একে একে চারজনে ছবি তুললাম। পুকুরের সামনেই দেখতে পেলাম ঈশার খাঁর বাড়ি। ১৯৭৫ সাল থেকে এই বাড়িটি লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বাড়িটির নির্মাণ শৈলী অত্যন্ত চমৎকার কারুকার্যে গড়া। সময়ের আবর্তে এর নকশা গুলি দিন দিন মুছে যাচ্ছে। তবে এখনও এর নির্মাণ শৈলী বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়। এর পাশ দিয়ে সোজা সামনে অবস্থিত হস্তশিল্প জাদুঘর। রাস্তার চারপাশে ফুলগাছসহ বিভিন্ন গাছের দৃশ্য প্রবেশের মূহুর্তে মনকে আন্দোলিত করে তুললো। ফাউন্ডেশন এলাকার বিশাল এরিয়া। পায়ে হেঁটে ঘুরা বিরক্তকর হলেও আনন্দের মনে হলো। প্রধান জাদুঘরের সামনে আছে গরুর গাড়ির মূর্তি। এতক্ষণে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম লেকের পাশে। পুরো পার্কের বৃত্তের মধ্যে এই লেক অবস্থিত। লেকের পূর্ব পার্শ্বে সারি সারি গাছে বেষ্টিত এক মনোরম দৃশ্য দেখতেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। লেকের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যেতে পারবে যে কেউ নৌকা যোগে। এখানে রয়েছে ৬টি নৌকা। ঘন্টা হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়। আরো রয়েছে মেলা প্রদর্শনী, নাগরদোলায় চড়া, শিশুদের ঘোড়ায় চড়া। এখানে রয়েছে বড়শীতে মাছ শিকার করার চমৎকার সুযোগ। লেকের এ পাশ থেকে ঐ পাশে যাওয়ার জন্য আছে বাঁশের সাকু। আমরা সাকুতে ছবি তুললাম। পরে অপর প্রান্তে চলে গেলাম। সারি সারি গাছের ফাঁকে ফাঁকে যখন হাঁটছিলাম তখন মনে হয়েছে এ যেন এক স্বপ্নীল জগতে চলে এলাম। আমাদের সাথে আরো শত শত নারী-পুরুষ দল বেঁধে হাঁটছে। এসব দৃশ্য দেখতে খুব চমৎকার লাগছে।
শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় বেলা যখন বাড়তে লাগল তখন দর্শনার্থীর সংখ্যাও বেড়ে গেল। বিকাল তিনটায় দেখলাম লোকজনে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ক্ষণিকের আনন্দে অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আমরা হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। ৩.১৫ মিনিটে আমরা গ্রন্থগারে প্রবেশ করি। এত সুন্দর পরিপাটি ও অসংখ্য বইয়ের গ্রন্থগার আর কখনো দেখিনি। ইচ্ছে ছিল এখানে বসে কিছুক্ষণ বই পড়ার কিন্তু সময়ের জন্য বসতে পারলাম না। কারণ এখনো অনেক কিছু দেখার বাকী রয়েছে।
একে একে আমরা এখানের সবকিছুই দেখতে লাগলাম। এখানে আছে প্রাচীন আমলের গোলপাতার ঘর। আছে বেতের তৈরি ও বাঁশের তৈরির বিভিন্ন সৌখিন জিনিসপত্র। আমি এখান থেকে একটা বাঁশের তৈরি হাতপাখা ক্রয় করি। আমার দেখাদেখি রুবেল ও তিনটি পাখা ক্রয় করে। মামুন কাঠের তৈরি একটা কলম কিনল। আরো ঝুড়ি পাতিলসহ হস্ত শিল্পের চমৎকার জিনিসপত্র। স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখার জন্য অনেক ভ্রমণকারীকে দেখলাম হস্তশিল্পের পণ্যগুলো কিনতে দেখলাম। এখানে আছে পানাহারের জন্য রেস্তোরা ও ক্যাফেটরিয়া। সেখানে বসে আমরা কোক ও কেক খেলাম।
বাঙালি ইতিহাসের হাজার বছরের পথ অতিক্রমকারী এক ধূসর সোনালী অধ্যায় হচ্ছে সোনারগাঁও। কালের আবর্তে সেই রহস্যময় নগরী হয়ে উঠেছে দর্শনীয় স্থান। প্রাচ্যের রহস্যময় সোনারগাঁওকে নিয়ে ঐতিহাসিকরা লিখেছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। সোনারগাঁওয়ের মাটিতে এসেছিলেন ১৫৮৬ সালে রাণী এলেজাবেথের বিশেষ দূত রাফল কীচ। ১৩৪৫ সালে এখানের ঐতিহ্যকে জানতে মেঘনা তীরে দাঁড়িয়ে মরক্কোর বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এসেছিলেন। আরো এসেছিলেন ফাহিয়েন, চীনা নৌবহনের ক্যাপ্টেন কংছুলো হাত নেড়ে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। এখানে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন হযরত শাহজালাল (রহঃ। এই সোনারগাঁও ছিল এক সময়ের একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। প্রাচীন বাংলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন দেশ সোনারগাঁওয়ের রাজনৈতিক পরিমন্ডল ছিল দিল্লির দরবারে অবধি দীর্ঘ ৮ মাইল লম্বা ৩০ হতে ৪০ মাইল পাশের একটি দেশ ছিল সোনারগাঁও। সম্পূর্ণ দেশটিই সোনারগাঁও রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। সে রাজ্যের রাজধানীর নামও ছিল সোনারগাঁও। সোনার গায়ের পূর্ব নাম ছিল সূবর্ণ গ্রাম। সূবর্ণগ্রাম নামটি হল সংস্কৃত শব্দ। সূবর্ণগ্রামোজয়া, সোনারং, সূবর্ণবীথি, নব্যঅবকাশিকা নামেও সোনার গাঁওয়ের পরিচিতি ছিল। ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে মূলত সোনার গাঁও একটি স্বাধীন দেশে রূপান্তরিত হয়। গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ্ সোনারগাঁওয়ের গর্ভনর থাকাকালীন সোনারাগাঁওয়ের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দিল্লীর তুঘলক বংশের সম্রাট গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ্ পরাজিত হন। তুঘলক বাহাদুর শাহের সঙ্গে যুগ্ন শাসক হিসেবে তাতার খানকে সোনারগাঁয়ে নিয়োগ দেন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্ ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সোনার গাঁওয়ের ইলিয়াস শাহী বংশের শুভ সূচনা করেছিলেন। তাঁর রেশ ধরে তার উত্তরাধিকারী গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ১৪১০ খ্রিঃ পর্যন্ত সোনার গাঁওয়ের গৌরবময় ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন। ১৪১০ খ্রিষ্টাব্দের পরে সোনার গাঁয়ের ঐতিহ্য আবার হারিয়ে যায়। শুধু মসলিন কাপড় উৎপাদন ও কয়েকটি সমৃদ্ধ শিক্ষালয়ের জন্য সোনারগাঁও টিকে থাকে।


আমরা ঘুরতে ঘুরতে বিকাল ৪টায় আবার জাদুঘর এলাকায় চলে আসলাম। প্রথমে শিল্পচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে প্রবেশ করি। জাদুঘরের ভেতর ঢুকতেই নরজকারা হস্তের কারুকাজ গুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রাচীন কালের মানুষ এত সৌখিন ছিল তা ভাবতেই অবাক লাগে। এটি ১৯৯৬ সালে স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে দুটি গ্যালারী আছে। এর নিচ তলায় রয়েছে কাঠ খোঁদাই করা বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহ্যের আকর্ষণীয় দ্রব্যাদী। যা দেখে আমাদের মন জুড়ে যায়। নিচ তলা দেখার পর দ্বিতীয় তলায় গেলাম। সেখানেও সুন্দর সুন্দর জিনিস পত্র দেখে মন ভরে গেল। এখানে রয়েছে জামদানী ও নকশী কাথার গ্যালারী।
এ জাদুঘর পরিদর্শন শেষে উত্তর দিকে গেলাম। সেখানে দেখতে পেলাম পানাম নগরী। লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশন থেকে একটু উত্তর দিকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে গোয়ালদী গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক পানাম নগর। প্রাচীন এ নগরীর ধ্বংসাবশেষ এখানে বিদ্যমান আছে। বড় নগর, খাসনগর, পানাম নগর-প্রাচীন সোনার গাঁওয়ের এই তিন নগরের মধ্যে পানাম নগর ছিল অন্যতম আকর্ষনীয়। এখানে রয়েছে কয়েক শতাব্দি পুরানো অনেক ভবন। যার বাংলার বার ভূইঁয়াদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। সোনার গাঁওয়ের ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এ নগরী গড়ে ওঠে।
১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন এখানে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড় আর এদেশ থেকে যেতো মসলিন। শীলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়ত পালতোলা নৌকা। ঐসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্য কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। পরবর্তীতে ইংরেজরা এখানে নীল বাণিজ্য শুরু করে। সোনার গাঁওয়ের প্রাচীন শহর ছিল পানাম নগর। মূলত পানাম নগর ছিল ব্যবসায়ীদের বসত ক্ষেত্র। এই ব্যবসায়ীদের বসত ছিলো ঢাকা-কলকাতা জুড়ে।


এখানে রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপত্যকলা ও অনুপম শিল্প নিদর্শনে ভরপুর। রাস্তার শত বছরের পুরানো অট্রালিকা দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসেবে। এর চারদিকে আছে পংখীরাজ খাল। এ খালের একটু ভেতরেই আমরা দেখতে পেলাম পংখীরাজ সেতু ও নীটকুঠি। তৎকালীন সময়ে বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এখানে বাস করতেন বলে জানা যায়। এই পানাম নগরীতে আরও রয়েছে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, মঠ, আবাসিক ভবন, গোসলখানা, পান্থশালা, নাচঘর, চিত্রশালা, আর্টগ্যালারি, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, প্রশস্তকক্ষ, বিচারালয়, গুপ্তপথ, পুরানো জাদুঘর, বিদ্যাপীঠ, পক্ষপীরের মাজার, কদম রসুল, চিলেকোঠাসহ বহু পুরাতাত্বিক গুরুত্ববহ স্থাপনা। এছাড়াও এখানে রয়েছে চারশো বছরের প্রাচীন টাকশাল বাড়ি। এই জাদুঘরের দুই নম্বর গেইট দিয়ে বের হয়ে যেতেই দেখতে পেলাম পশ্চিম দিকে মুসলিম স্থাপত্য গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। এ মসজিদটি আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর আমলে নির্মিত বলে জানা যায়।
সব শেষে আমরা লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে প্রবেশ করি। এখানে প্রবেশ করেই আমরা অবাক হয়ে যাই। সরু ও পেচানো রাস্তা দিয়ে এক রূপ থেকে অন্য রূমে যাচ্ছি। যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি সেই রাস্তা দিয়ে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এই জাদুঘরে ১১টি গ্যালারী আছে। যাতে দেখলাম গ্রামীণ বাংলার পটচিত্র, মুখোশ ও নৌকার মডেল, উপজাতি, লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শণ, মৃৎশিল্প শামুক, ঝিনুক, নারিকেল, কারুশিল্প, জামদানী শাড়ী, তাত বস্ত্র, শতরস্ত্রী, রেশম বস্তু, পাটজাত শিল্প ও লোহার কারুশিল্প, কাঠের তৈরি সামগ্রী, লোহা, তামা, কাশা, পিতলের তৈজশপত্র অলংকার, কাঠের তৈরি পালকি, পুরানো পিঁড়ি, দরজা, বড় সিন্দুক, বন্ধুক, বড় বড় পিতলের আংটি, ছুরি, রামদা, ছেনি, বাসন, বালা, নূপূর, চামচ, পিতলের পাটি, পাতিল, ধান ভানার ঢেঁকি, বেতের তৈরি হাতি, আরো কত কি? যা বাংলার প্রাচীন ইতিহাসকে ফুটিয়ে তুলেছে।
এদিকেসন্ধ্যা গণিয়ে আসছে। আমাদেরকে নরসিংদী পৌঁছতে হবে। তাই আর এখানে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। দ্রুত আমরা সোনার গাঁও ফাউন্ডেশন এলাকা পরিদর্শন শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মন কিছুতেই এই সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতে যাচ্ছে না। তবুও আমাদেরকে আপন ঠিকানায় ফিরতে হল।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:২০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×