মানুষের জীবনকে পাল্টে দিতে মনে হয় এক মুহূর্তই যথেষ্ট।হঠাৎ কিছু দমকা হাওয়া মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারে। যেমন এই মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আমি সব কিছু অন্ধকার দেখছি।হ্যাঁ, একটি মাত্র মেডিক্যাল রিপোর্টই পাল্টে দিয়েছে আমার সবকিছু, হয়তোবা কেড়ে নেবে আমার সবচেয়ে মূল্যবান কিছু। আমি এখন ফিরছি হাসপাতাল থেকে। মেডিক্যাল রিপোর্টটি ঘরে নেওয়ার মতো সাহস কিংবা ইচ্ছা কোনোটায় আমার নেই।আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি আমার তিতলির এরকম কিছু হবে কোনোদিন। মাত্র কিছুদিন আগে তিতলির হালকা রকমের কিছু অসুখ হয়েছিল ।সেটাই পরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে। কিন্তু এর রিপোর্ট যে এতো ভয়াবহ হবে কে জানত সেটা !!! তিতলির নাকি এক মরনব্যাধি অসুখ হয়েছে (নামটা আমি বলতে চাচ্ছি না )।ও নাকি মাত্র ৬ মাস বাঁচবে। অসুখ নাকি একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ধরা পড়েছে। এখন নাকি আর কিছু করার নেই।হয়ত আল্লাহ্ আমার থেকে আরেকবার পরীক্ষা নিতে চান। আমি খুব ধার্মিক না হলেও ২-৩ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। আমার মা আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছেন। আমি ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। বাবার মুখ আমি দেখেনি কখনো। এরপর থেকে মা অনেক কষ্ট আর সংগ্রাম করে আমাকে মানুষ করেছেন। আমিও জীবনে কখনো মায়ের অবাধ্য হইনি বরং মায়ের আদর্শ ছেলে হিসাবে থাকার চেষ্টা করে গিয়েছি। মদ,সিগারেট থেকে অনেক দূরে থেকেছি। আমার বিয়েটাও মায়ের পছন্দে করা । তিতলি মেয়েটাকে মা এক নজর দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিল।আর করবেই না কেন। এমন মায়াময় আর স্নিগ্ধ চেহারা পৃথিবীর আর কয়টা মেয়েরই বা আছে। আল্লাহ্ পৃথিবীর দুইজন নিঃসঙ্গ মানুষকে একত্রিত করে দিয়েছেন। আমার ভাগ্য তো ভাল ছিল তাই মায়ের সান্নিধ্য লাভ করেছি।কিন্তু তিতলি সেটা থেকেও বঞ্ছিত হয়েছে। ওর মা-বাবা ছোটবেলায় মারা যান। মেয়েটা মামার ঘরেই এরপর মানুষ হয়। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম ও আমাকে অনেক ভয় পেত ! ! ভয়ে মেয়েটা আমার চোখের দিকে তাকাত না।কিন্তু এরপর সময় সবকিছু পরিবর্তন করে দিয়েছে। মানুষকে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তিতলির ।মায়ের সাথে ওর সম্পর্ক ছিল একেবারে মা-মেয়ের মধুর সম্পর্কের মতো। মা মারা যাওয়ার পরে ও শোকে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের মাত্র ১০ মাসে কোনো মেয়ে তার শাশুড়িকে এত ভালবাসতে পারে একথা আমি মায়ের মৃত্যুর পরে ওকে দেখে বুঝেছিলাম।
*****
তিতলির চেহারা হয়ত অতো সুন্দর না।কিন্তু চেহারায় যে পরিমান মায়া আছে সেই মায়ার সাগরে ডুব দিয়েই বাকি জীবন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়া যায়।কিন্তু মেয়েটিকে আমাকে কী নিশ্চিন্তে থাকতে দেবে না?৬ মাস পরে ফাঁকি দিয়ে এভাবে চলে যাবে?বিয়ের প্রথম দিনেই তো আমরা হাতে হাত রেখে বাকি জীবন একসাথে কাটানোর কথা দিয়েছিলাম।এখন কেন তিতলি তার কথা রাখতে পারবে না!!কথা ভঙ্গ করার মত মেয়েতো ও না। একবার ও বাসার কাজের বুয়াকে বলেছিল মাসের শুরুতে তাকে থ্রী পিস দেবে।কিন্তু বেচারি পরবর্তীতে ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিল। মাসের প্রথম দিনেই বুয়া ব্যাপারটা তাকে মনে করিয়ে দেয়।পাগলীটা তখন নিজের সম্পূর্ণ নতুন একটি থ্রী পিস বুয়াকে দিয়ে দেয় অঙ্গীকার পূরণের জন্যে। তার এইসব গুণগুলো আমাকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখে। অদ্ভুত এক নেশায় যেন আমি বুঁদ হয়ে থাকি।
****
বাসার সামনে আসতেই আমার একটা একটা কথা মনে পড়ে গেল।উঁহু, তিতলির জন্যে তো গোলাপ কেনা হল না আজ।আসলে ওই রিপোর্টের কথা চিন্তা করতে করতে আমি ফুলের কথা একদম ভূলে গেছি। কিন্তু তিতলির সামনে আমাকে স্বাভাবিক থাকতে হবে এখন।আমি ওকে এখন কিছুই বলব না।এই ফুল আনার পিছনে একটা ঘটনা আছে। একবার আমার এই সহজ সরল বউটাকে কিছু টাকা ঠকিয়ে পাশের বাসার এক মহিলা পালিয়ে যায়।আমার তখন বেতন আরো কম ছিল।ধারদেনাও ছিল কিছু।কাজেই আমি ওকে বোকামির জন্যে কিছু বকাঝকা করেছিলাম।অভিমানে মেয়েটা কিছু খায় নি সেইদিন।পরে আমি অফিস থেকে একটা গোলাপ কিনে পাপড়িগুলো ওর মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিলাম।তাতেই ওর সকল অভিমান শেষ হয়ে যায়। সেই থেকে প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরতে আমি তিতলির জন্যে একটা করে গোলাপ ফুল কিনে আনি।এই ফুলটা পেলে যে মেয়েটা কি পরিমাণে খুশি হয় যেন আমি ওর জন্যে হীরের আংটি নিয়ে এনেছি। অবশ্য মেয়েটার এই ধরনের কোন চাহিদাও নেই।কখনো ও আমার কাছে কোনো বিলাসী আবদার করে না।ওর আবদারগুলো খুব সামান্য। কখনো বেলি ফুলের মালা কিংবা জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলো ছাদে বসে একসাথে উপভোগ করা কিংবা নদীর তীরে এক সাথে হাটতে যাওয়া এই ধরনের।আমিও সহজেই মিটিয়ে ফেলি এই ধরনের আবদারগুলো। আমারো খুব প্রিয় এই ধরনের আবদার।হঠাৎ দোকানদারের কথায় আমার চিন্তাসূত্রে ছেদ পড়লো। ‘ভাইজান বাকি টাকা নিলেন না যে?’ ‘ও আচ্ছা,দিন।’ তিতলির কথা চিন্তা করতে গিয়ে আসলে আমি বাস্তব দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছি যে গোলাপের টাকা ফেরত নিতে ভূলে গেছি।আচ্ছা আমার এই উদ্ভ্রান্তরূপ তিতলির কাছে ধরা পরবে না তো। আমি তো ওর কাছে কিছু লুকোতে পারি না। কেমনে করে যেন মেয়েটা আমার সব কিছু জেনে যায়। অবশ্য তিতলিরও আমার কাছে কিছু লুকাতে পারে না। ধরা খেয়ে যায়। ওর সাথে আমার রুচি আর পছন্দে এত মিল পাওয়া যায় যে আমি নিজেই এতে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে পড়ি। কিন্তু তিতলির কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচব কিভাবে। অতি সাধারণের মধ্যে অসাধারণ এই মেয়েকে ছাড়া আমি এক মুহূর্ত যে চলতে পারি না। প্রতিদিন আমাকে ঘুম থেকে সকালে ডেকে তোলা,খাওয়া- দাওয়ায় অনিয়মের জন্যে মিষ্টি বকুনি এইসব তো তিতলির প্রাত্যহিক কাজ।আগে কাজগুলো মা করতো। মা মারা যাওয়ার পরে এই গুরু দায়িত্ব নিয়েছেন তিতলি ম্যাডাম। মা মারা গেছেন, এখন যদি তিতলিও আমাকে ছেড়ে চলে যায় তবে আমার উপর খবরদারি কে করবে?
****
আমি বাসার কলিংবেলে চাপ দিলাম। ওইপাশ থেকে সেই পরিচিত মিষ্টি কণ্ঠটি বলে উঠল,কে?’আমি জবাব দিলাম।দরজা খুলতেই তিতলির সেই মন মাতানো হাসি।যে হাসি একটিবার দেখার জন্যে আমি সবকিছু ত্যাগ করার জন্যে প্রস্তুত।রাতে খাওয়ার পরে আমরা টিভি দেখতে বসলাম।তিতলির প্রধান কাজ টিভিতে কার্টুন দেখা।মাস্টার্স পাশ করা একটি মেয়ের কার্টুনের প্রতি এতো ঝোঁক বিস্ময়কর মনে হতে পারে।কিন্তু তিতলির এই ধরনের ছেলেমানুষির সাথে আমি পরিচিত। হঠাৎ তিতলি বলে উঠলো, “ কী ব্যাপার জাদিদ, তোমাকে এত মনমরা দেখাচ্ছে কেন? অফিসে আজ কিছু হলো নাকি?”
‘নাহ তো।”
আমার তো মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছ? মায়ের জন্যে মন খারাপ।তাই না?
হ্যাঁ।
‘আচ্ছা জাদিদ, প্রিয় মানুষেরা এত দ্রুত ছেড়ে চলে যায় কেন?’ কথাটা কেমন যেন একটু উদাসভাবে বলল তিতলি। তিতলির এই কথাটা আমার বুকে যেন সূঁচ হয়ে এসে বিঁধে গেলো । ‘তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো কখনো’? ‘নাহ,কখনোই না।’ আমি শক্তকরে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে বললাম।
*****
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে তিতলি ।ওর উজ্জ্বল চোখ দুইটি যেন কিছু একটা হারানোর ভয়।আমার দিকে তাকিয়ে ও স্লানমুখে বলল , ‘একটু শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখো জাদিদ।তুমি শক্ত করে ধরলে আমার আর কিছু লাগবে না। শান্তিতে মরতে পারব। আমি চিৎকার করে বললাম,তোমার কিচ্ছু হবে না, তিতলি ।আমি সব সময় তোমার পাশে আছি,থাকব।” ওর মুখে যেন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ওর উজ্জ্বল চোখ দুইটি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি আবারো না বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি পাশ ফিরে দেখি আমার রাজকন্যা আমার পাশে ঘুমুচ্ছে।জানালার মধ্য দিয়ে আসা চাঁদের আলোতে তিতলিকে পুরো রাণী হেলেনের মত লাগছে।যদিও আমি রাণী হেলেনকে দেখিনি কিন্তু আমার কল্পনায় রাণী হেলেন তো তিতলিই। এই মেয়ে কী আসলেই আমাকে ছেড়ে ৬ মাস পরে চলে যাবে??
অন্ধকারকে তিতলি ভীষণ ভয় পায়। রাতের বেলায় লোডশেডিং হলে মেয়েটা দ্রুত আমার কাছে চলে আসে।সেই মেয়ে কিভাবে ৬ মাস পরে অন্ধকার কবরে একা থাকবে আমাকে ছাড়া! পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই।তাদেরকে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৈরি থাকতে হয়। কিন্তু আমি না কেঁদে পারলাম না ।বাথরুমে গিয়ে আমি অনেকক্ষন কাঁদলাম। কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। তিতলিকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডাক্তার দেখাবো।আমি শেষ একটা চেষ্টা করে দেখব। এর জন্যে দরকার হলে আমি আমার কিডনি বিক্রি করব।আমি কালকেই আবার ডাক্তারের কাছে যাব। এইসব চিন্তা করতে গিয়ে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পরলাম টের পেলাম না।
*****
‘এই উঠো, সকাল হয়ে গেছে।” তিতলির মিষ্টি কণ্ঠে আমার আরেকটা দিন শুরু হল।
‘অ্যাই, একটা নাম্বার থেকে অনেকবার কল করা হয়েছে তোমার নাম্বারে।” ফ্রেশ হয়ে একটু কল ব্যাক করো। আমি নাস্তা বানাতে যাচ্ছি।’আমি নাম্বারটিতে কল দিলাম। ওইপাশ থেকে কেঊ একজন বলে ঊঠলো, ‘স্যরি,স্যার। গতকাল আপনার স্ত্রীর রিপোর্টের সাথে আমাদের কারিগরি সমস্যার কারণে আরেকজনের রিপোর্ট অদলবদল হয়ে গেছে।আপনার স্ত্রীর রিপোর্টে আসলে কিছু ধরা পড়ে নি।তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনি এসে দয়া করে সঠিক রিপোর্টটি নিয়ে যাবেন। কাজে গাফলতির কারণে আমাদের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ’ আমি কেবল মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলাম।
‘কে ফোন করেছিল?’ তিতলির মুখে এক টুকরো শুভ্র হাসি।আমি উত্তর না দিয়ে মুগ্ধ হয়ে তার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।হাজার রাত, হাজার দিন কেটে যাবে কিন্তু আমার এই মুগ্ধতা শেষ হবে না।.......
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৭:৪৭