(ব্লগে আমার প্রথম গল্প)
১
ক্রমাগত ফোন বেজে চলছে।কিন্তু ধরতে ইচ্ছা করছে না।রাত ১টায় বিশেষ করে এল ক্লাসিকো দেখার সময় কারই বা ফোন ধরতে ইচ্ছা করবে!অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন স্ক্রীনে চোখ বুলালাম।একটা বিদেশী নাম্বার দেখে রিসিভ করলাম।‘হ্যালো? অস্বাভাবিক শীতল একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল ‘‘হ্যালো,এটা সাদিক চৌধুরীর নাম্বার না ?’ ‘জ্বি,বলছি’কিছুটা জড়তা নিয়ে উত্তর দিলাম।‘দোস্ত,আমি শান্ত’ ঐপাশ থেকে কণ্ঠটা এবার স্বাভাবিক বলে মনে হল।‘কোন শান্ত’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।‘আরে আমি তোর প্রাইমারির দোস্ত শান্ত’।আমি দারুনভাবে চমকে উঠলাম!আমার শৈশব পুরোটা কেটেছে শান্তর সাথে।পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে আমরা সারাক্ষণই একসাথে থাকতাম।ওর বাবা একটা সরকারি চাকরি করত। আমরা দুইজন ছিলাম যেন একটা মানিকজোড়।কিন্তু প্রাইমারি পাস করার পরে ওর আব্বা অন্যত্র বদলি হয়ে যান।ফলে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।সেই শান্ত আজ প্রায় ১০ বছর পরে ফোন করল!‘আমার নাম্বার পেলি কীভাবে?’ওকে জিজ্ঞেস করলাম।ও বলল ফেসবুক টুইটারের যুগে এটি কোনো ব্যাপার।তুইতো তোর প্রোফাইলে নাম্বার দিয়া রাখছস।আজকে একটু আগে তোর প্রোফাইলটা খুঁজে পাইয়াই তোরে ফোনটা দিলাম। ওর সাথে প্রায় ১ ঘণ্টার মতো কথা হলো।শান্ত জানালো ও ৪ বছর যাবত আমেরিকা আছে। ভালো বেতনে নাকি সেলসম্যানের চাকরি করে।ও বললো আগামী মাসের শেষে ও দেশে আসবে। কথাটা বলতে না বলতেই ফোন কেটে গেল।অনেকবার চেষ্টা করেও আর পেলাম না।
২ একমাস পরের কথা.................................................
রাত ৮টার আবার শান্তর ফোন।এবার একটা জিপি নাম্বার থেকে।ও বলল দোস্ত,আমি তো বাংলাদেশে আসছি।তোর বাসার ঠিকানাটা দে তো।আমি দিলাম।আধ ঘণ্টা পর কলিংবেলের শব্দ পেলাম। দরজা খুলতেই দেখি শান্ত।ছোটবেলার চেহারার সাথে বেশ মিল আছে,তবে চেহারায় কেমন যেন ফ্যাকাসে ভাব।অনেকক্ষণ আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম।.......রাতের খাবার খেতে খেতে ওকে ওর বাবা মার কথা জিজ্ঞেস করলাম।আমি একটু লজ্জিতবোধ করলাম।আসলে অন্য কথার ভীড়ে উনাদের কথা জিজ্জেসই করা হয় নি ! বাবা মার কথা জিজ্ঞেস করতেই শান্তর চেহারা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল কেউ বেঁচে নেই। কক্সবাজারে পিকনিক করতে গিয়ে বাবা মা ভাই সবাই রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।আমার চোখ যেন বিস্ফোরিত হল। অনেকক্ষণ সাত্ত্বনা দেওয়ার পর ও নিজে থেকেই বলে উঠল দোস্ত আজকে যাই।‘এখানে তুই কোথায় উঠেছিস?’ও বলল ‘হোটেলে।’আমি বললাম তোর হোটেলে থাকা চলবে না। আমার বাসায় থাকবি।শান্তর চোখে কেমন একটা স্ম্লানভাব লক্ষ করলাম। ও বলল ‘ঠিক আছে।;আমি তাহলে হোটেল থেকে সবকিছু গুছিয়ে কালকে আসব। আমি তাতে সায় দিলাম।আমার থেকে বিদায় নিয়ে ও চলে গেল।……………………………..পরের দিন সকালে ও দুইটা লাগেজ নিয়ে ও উপস্থিত হল। এসেই বলল ‘চল।গ্রামের বাড়ি যাব।মা বাবা ভাইয়ার কবরটা যিয়ারত করে আসি।আমি তাতে রাজি হলাম।আমি আমার প্রাইভেট কারটা বের করলাম।ও বলল ওদের গ্রামের বাড়ি নবাবপুর জেলার আশুপুরের বিখ্যাত কাজি বাড়ি।এখান থেকে ৪ ঘণ্টার পথ।আমি গাড়ি স্টার্ট করলাম।পথে আমরা নানা বিষয়ে কথা বলতে লাগলাম।হঠাৎ করে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল।আমরা গাড়ি থেকে নামলাম কী হয়েছে তা দেখার জন্যে।জায়গাটা ছিল জনমানবহীন।আমরা যেই না গাড়ি থেকে নামলাম ওমনি পাশের জমি থেকে ৩ টা লোক এসে ঘিরে ধরল আমাদের।ছুরি বের করে সবকিছু বের করে দিতে বলল।শান্ত ছোটবেলা থেকেই ছিল খুব সাহসী।ও ছিনতাইকারীদের সাথে ধস্তধস্তি শুরু করে দিল।ছিনতাইকারীরা ওর পেটে ও বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিল।পুরো ব্যাপারটা চোখের পলকে ঘটে গেল। আমিও ওদের বাধা দিতে গেলাম কিন্তু পিছন থেকে একজন এসে আমার মাথায় আঘাত করল। আমার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।আমি মনে হয় জ্ঞান হারাচ্ছি…….আমার চোখের সামনে আমার প্রিয় বন্ধু মারা যাচ্ছে কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। সব অন্ধকার হয়ে গেল……………………………………………………………………….
৩
আস্তে আস্তে চোখ মেললাম।নিজেকে গাড়ির সিটে আবিষ্কার করলাম। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।শান্তর মৃতদেহ তো দূরের কথা রক্ত কিংবা ধস্তধস্তির কোনো আলামতও নেই!! আমি পুরোপুরি হতবিহবল হয়ে পড়লাম।কী করব বুঝতে না পেরে অবশেষে তাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।ওদের গ্রামটা ছবির মতো সুন্দর।ওদের বাড়ি বের করতে তেমন কোনো বেগ পেতে হল না।গিয়ে বাড়ির দরজায় নক করলাম।এরপর যা দেখখলাম তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।....... বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছেন শান্তর বাবা।শুধু তাই নয় উনার পিছে শান্তর ভাই এবং মাকেও আসতে দেখলাম।আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ভয়ে আতংকে সেখানেই আবার জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে পেয়েছি কয়দিন পরে বলতে পারব না।জ্ঞান ফেরা মাত্রই একজন ডাক্তার এবং সাথে একজন দাঁড়িওয়ালা লোককে দেখতে পেলাম।আমাকে নরম সুরে দাঁড়িওয়ালা লোকটি বললেন ,তোমার নাম তো সাদিক চৌধুরী, ঠিক না?আমি অবাক হয়ে বললাম আপনি জানলেন কেমনে?লোকটি স্নেহমাখা কণ্ঠে বললআস্তে আস্তে সব বলছি।আগে আমার পরিচয় দিই। আমি এই গ্রামের মসজিদের ইমাম আর আমার পাশের ইনি আমাদের ডাক্তার সাহেব।তুমি তো শান্তর সাথে এসেছ না?আমি বললাম, জ্বী।ও মারা গেছে।আমি ওকে বাঁচাতে পারি নাই। ইমাম বললেন, ওতো ৫ বছর আগে মারা গেছে।আমি চিৎকার করে বললাম, কী বলছেন?ডাক্তার বলল হ্যাঁ সাদিক,ইমাম সাহেব ঠিকই বলছেন।কীভাবে এটা সম্ভব।আমি বললাম।‘মাঝে মাঝে পৃথিবীতে ব্যখ্যাতীত কিছু ঘটনা ঘটে। তাছাড়া এ ঘটনার শিকার শুধু তুমি নও।তোমার আগে আরো তিনজন এই ঘটনার শিকার হয়েছে যাদের প্রত্যেকে ছিল শান্তর ঘনিষ্ঠ বন্ধু’।আমার মনে হলো আরেকবার প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম।‘শুনো বাবা, শান্তর পরিবারের সবাই জীবিত আছেন।শান্তর আত্মা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে।’ডাক্তার বললেন।আড়াল থেকে আসলেন শান্তর বাবা।তিনি বললেন, ‘বাবা শান্ত ঠিক ঐ জায়গায় আমেরিকা থেকে আসার সময় নিহত হয় ছিনতাইকারীদের হাতে। বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠলেন তিনি।
পরিশিষ্টঃ
আমি শান্তর কবর যিয়ারত করে চলে আসি সেখান থেকে।আমি এখনও ভেবে পাই না শান্ত কী কারণে তার মৃত্যুর দৃশ্য ৪জন মানুষকে দেখাল।পৃথিবীতে আসলে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।....................................................
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:০৩