বিএসএমএমইউ লাইব্রেরিতে গেলে বিভিন্ন বয়সের বিমর্ষ কিছু ডাক্তারের মুখ চোখে পড়ে। তারা কেউ কেউ পনের-বিশ বছর আগে এমবিবিএস পাশ করেছেন। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন নামক মুলার পিছনে ছুটতে ছুটতে তারা তাদের জীবনের সবচেয়ে কর্ম-চঞ্চল সময়গুলো পার করে ফেলেছেন। বইয়ের পৃষ্ঠার নিচে চাপা পড়ে থাকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের গতি-উন্নতি-স্বপ্নগুলো। কিন্তু কেন এমন হলো? অথচ তারাই ছিলো বিগত জীবনে সবচেয়ে মেধাবী সন্তান; বিগত পরীক্ষাগুলোতে তারা প্রায় সবাই ঈর্ষনীয় ফলাফল করেছিলো। আজ তারা কেনো ক্রমাগত সয়ে যাচ্ছে অনুত্তীর্ণ জীবনের গ্লানি?
এমবিবিএস পাশ করতে করতে জীবন থেকে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পার হয়ে যায়। তারপর একজন ডাক্তারকে জীবনের অনেকগুলো বিষয় অতিক্রম করতে হয়। কেউ সরকারি চাকরি করে, কেউ প্রাইভেট চাকরি করে কিংবা প্র্যাকটিস করে। পাশাপাশি পরিবার, বিবাহসহ নানাবিধ আনুষঙ্গিক বিষয় জীবনে চলে আসে। ইত্যাদি সব কিছু ম্যানেজ করতে যেয়ে অনেককেই হিমশিম খেতে হয়। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে রয়েছে নানান সমস্যা। রেফারেল সিস্টেম নেই, রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যত্রতত্র ওষুধ বিক্রি হয়। গ্রাম ডাক্তার, কোয়াক, ওষুধের দোকানদারসহ বিভিন্ন অডাক্তারগণই এ দেশে প্রধান ডাক্তার। গড়ে উঠে নি জেনারেল প্র্যাকটিস( জিপি) কনসেপ্ট। তাই জীবনের নানা জটিলতা সত্ত্বেও একজন গ্র্যাজুয়েট ডাক্তারের স্বপ্ন থাকে ‘সিম্পল এমবিবিএস’ থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু সেই পথ যে বড়ই বন্ধুর পথ! সেই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে দিতে জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নিজের অজান্তেই পার হয়ে যায়। সরকারি-বেসরকারি ডাক্তাররা উপায়ান্ত না দেখে ডেপুটেশন-শিক্ষা ছুটিসহ পোস্টিং প্লেসে নানা পদ্ধতিতে ম্যানেজ করার মাধ্যমে কর্মস্থল থেকে দূরে এসে বইমগ্ন হয়ে থাকেন। সবাই ভাবে ডাক্তাররা কর্মস্থলে ফাঁকি দিচ্ছেন, কিন্তু কেনো দিচ্ছেন কেউ জানতে চায় না, বুঝতেও পারে না।
তাদের এই বেদনার কথা কী নীতি-নির্ধারকগণ জানেন না? সামান্য কারণেই ক্রমাগত অকৃতকার্য্য করিয়ে তাদের ‘কোয়ালিটি ইমপ্রোভ’ করার যে দর্শন অধ্যাপকগণ চর্চা করে থাকেন তা মারাত্মক একটি ভুল দর্শন। প্রথমে ভাবতে হবে, আমরা কী সব ডাক্তারকেই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট বানাবো কি-না? জিপি পদ্ধতি, রেফারেল পদ্ধতি কী এ দেশে প্রয়োজন নেই? কেউ নিজস্ব মেধা দিয়ে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন করতে আসলে তার ট্রেনিং পদ্ধতিই বা কেমন হবে?
এ বিষয়ে আমার প্রস্থাবনা সমুহঃ
১) এমন পদ্ধতি থাকতে হবে যেন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যেই শেষ হয়। জীবনের অধিকাংশ সময় পরীক্ষার পিছনে ব্যয় করলে তারুণ্য নির্ভর গতিশীল সেবা ডাক্তাররা মানুষকে কখন দেবে? ডাক্তারদের চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর বইয়ের পৃষ্ঠায় ভিতরে আটকে রাখলে মাঠে প্রকৃত সেবা কার্যক্রম কে চালাবে?
২) পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের মেয়াদ ৩-৪ বছরের বেশি হওয়া অনুচিত। এই মেয়াদে মূলত প্রায়োগিক ও ইন্টারভেনশনাল শিক্ষা দিতে হবে। সকল পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কোর্স রেসিডেন্টশিয়াল হওয়া উচিৎ। ট্রেনিং হতে হবে স্ববেতনে ও রেসিডেন্টশিয়াল। তাহলে ডিগ্রির প্রতি ছাত্রদের একাগ্রতা বৃদ্ধি পাবে।
৩) পরীক্ষক ও শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা যাচাই জরুরী বলে মনে করি। পরীক্ষা পদ্ধতি ট্রান্সপারেন্ট হওয়া উচিৎ। এ জন্য শক্তিশালী পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বোর্ড থাকতে হবে।
৪) সারা দেশে একই কারিকুলামে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কোর্স থাকা উচিৎ বলে মনে করি।
৫) উন্নত দেশের ডিগ্রি যেমন, এমআরসিপি, এফআরসিএস, এমআরসিওজি প্রভৃতি এবং রেজিষ্ট্রেশন পরীক্ষা যেমন, এএমসি, প্লাব, মিডল ইস্টসহ অন্যান্য দেশে ডাক্তারি করার জন্য রেজিষ্ট্রেশন পরীক্ষা কেন্দ্র এ দেশে থাকলে যারা বাইরে যেতে ইচ্ছুক তাদের জন্য সুবিধা হবে যা আদতে দেশকেই লাভবান করবে। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।
৬) যে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষায় পাশের হার কম সেই পরীক্ষা পদ্ধতি এবং ল্যাকিংসগুলো নিয়ে পুনঃ পুনঃ মূল্যায়ন করতে হবে।
৭) বেসিক সাবজেক্টে নন-প্র্যাকটিসিং এলাউন্সসহ বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে ছাত্র-ছাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য।
সর্বোপরি, এই দেশতো আমাদের সবারই। ভালো থাকি, মন্দ থাকি এই দেশেই আমাদের থাকতে হবে। যারা জীবনের প্রয়োজনে বাইরে যান তারা কী সবাইকে নিয়ে যান? তাদের পরিজনও এই দেশেই থাকেন। আমাদের সমস্যা আমাদেরকেই দূর করতে হবে। নীতি-নির্ধারকগণ সব ঠিক করে দেবেন এই আশা নিয়ে বসে থাকলে বিরাট ভুল হয়ে যাবে। ঐক্যই সকল পরিবর্তনের মূল শক্তি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠতে পারে একটি ডাক্তার-বান্ধব, রোগি-বান্ধব উন্নত বাংলাদেশ।