চট্টগ্রামের নির্বাচনঃ জয়-পরাজয়ের পেছনে
আবদুর রহমান
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের নির্বাচন হয়ে গেল গত ১৭ তারিখ। এই নির্বাচনটি যত বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, ফলাফলের পর এর গুরুত্ব আরো বেশী বেড়ে গেছে। তিনবার নির্বাচিত মেয়র মহিউদ্দিনের বিশাল ব্যাবধানে পরাজয় ও বিরোধী জোট সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়ই এর কারণ। যদিও বোদ্ধারা এ ফলকে অনাকঙ্খিত মনে করছেন না।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৪ সালে বি এন পি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে প্রথম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। একাধারে তিনবার নির্বাচিত হবার পর এবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতেও তিনি চতুর্থবার আর নির্বাচিত হতে পারলেন না। আপাতদৃষ্টিতে ব্যতিক্রম মনে হলেও এটি আসলে সহজবোধ্য একটি ব্যাপার। প্রথমত মহিউদ্দিন চৌধুরীকে কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণায় একাই খাটতে হয়েছে। তিনি দলের অন্য গ্রুপগুলোকে থামাতে পারলেও নিজের পক্ষে প্রচারণায় কাজে লাগাতে সক্ষম হননি। আরেকটি ব্যাপার হলো ভোলার নির্বাচনের সময় দেখা গেছে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি করে দিয়েছিলো যারা ব্যাপকভাবে তৎপরতা চালায়। মহিউদ্দিনের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সেই তৎপরতা চট্টগ্রামে কিন্তু দেখা যায়নি। এমনকি মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পাবার আগেই নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আরেকটি বড় ব্যাপার হলো তিনবার কোন ব্যক্তি নির্বাচিত হবার পর আবার নির্বাচিত হওয়া বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে স্বাভাবিক নয়। এজন্য মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটার মত অস্বাভাবিক কোন উন্নয়ন করা দরকার। মহিউদ্দিন চৌধুরী তা করতে পেরেছেন কি না তা প্রশ্ন থাকে। তাছাড়াও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে তার বিভিন্ন কাজের হিসাব নিকাশ তথা সমালোচনা মানুষের মুখে এমনিতেই চলে আসে।
অপরদিকে প্রার্থী পছন্দের ক্ষেত্রে চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকজন প্রার্থী ছিলো যেমন আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুল্লাহ আল নোমান ও মীর নাছির উদ্দিন প্রমুখ। এদের যে কোন একজনকে মনোনয়ন দিলে অপরজনের সমর্থন পাবার নিশ্চয়তা দেয়া যেত না। কিন্তু আভ্যন্তরীণ এ সকল প্রার্থীর বাইরে এমন একজনকে আমদানী করা হলো যিনি প্রথম সপ্তাহেই বিএনপির সকল গ্রুপকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন। জামায়াতসহ অন্যান্য দলের সমর্থনও তিনি পেলেন। মঞ্জুরুল আলম পূর্বে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন এবং ভারপ্রাপ্ত মেয়রও ছিলেন। উপরন্তু তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন এবং একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। এ সবকিছুই তার বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে।
তবে নির্বাচন পরবর্তী কিছু বিষয় সবারই নজর কেড়েছে। সকালে ভোট দেবার পর দুই প্রার্থীই বললেন নির্বাচন সুষ্ঠ হচ্ছে, আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী এবং ফলাফল যাই হোক মেনে নেব। নির্বাচন চলাকালে বিএনপি অভিযোগ করলেন যে ২০ টি কেন্দ্রে মঞ্জুরের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছেনা। বিকালে ভোট প্রদান শেষে গণনার সময় অভিযোগ উঠলো যে প্রিজাইডিং অফিসার রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করছেন না। এরপর যখন ৬২ টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হলো তখনও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বেশ এগিয়ে। কিন্তু তারপর থেকে আর তার ভোট এগিয়ে যায়নি। তাহলে কি এ অভিযোগ সত্য যে মহিউদ্দিন কে বিজয়ী করার জন্যই যেসব কেন্দ্রে তিনি ভোট বেশি পেয়েছেন সেসব কেন্দ্রের ফল আগে ঘোষণা করা হয়েছে? এ সময় নির্বাচন কমিশন থেকে খুব ধীরে ধীরে ফলাফল ঘোষণা হতে থাকে। মঞ্জুরের এজেন্ট আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অভিযোগ করেন যে ২৫০টি কেন্দ্রের যে ফল তিনি পেয়েছেন তাতে মঞ্জুর ৫০ হাজার ভোটে এগিয়ে আছেন। ঢাকায় বি এন পি মহাসচিব মন্তব্য করেন যে ডিজিটাল কারচুপির চেষ্টা করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী ক্যাম্প এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের বাইরে মঞ্জুরের সমর্থকরা ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তখন নির্বাচনের ফল দ্রুত প্রকাশ হতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই মহিউদ্দিনের অবস্থান নিচে চলে যায় এবং তিনি এবার লোকজন নিয়ে হাজির হন এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। তার সকালের কথা পরিবর্তন হয়ে যায়। মহিউদ্দিন বলেন তার ভোট চুরি করা হয়েছে এবং এ নির্বাচনের ফলাফল তিনি মেনে নেবেন না। নির্বাচন পরবর্তী এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য না করে এটুকুই বলতে চাই যে সবার সতর্ক অবস্থান পরিলক্ষিত হয়নি।
নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে সবাই ক্ষমতায় আসে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন এবং আধুনিত নগরী গড়ার প্রতিশ্রুতি সব প্রার্থীই দিয়েছেন। মহিউদ্দিন হয়ত তার পূর্বের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। নতুন মেয়র মঞ্জুর আলমও ১৭ দফা ইশতেহার দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তিন সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনকে সাথে নিয়েই নগরীর উন্নয়ন করতে চেয়েছেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এ নগরীর উন্নয়নে তিনি যথাযথ ভূমিকা রাখবেন এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।
লেখকঃ মাস্টার্স, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Click This Link