উত্তরা ৪ নং সেক্টর ১৭ নং সড়কের মাথায় অনেক পরিচিত অপরিচিত রিকসার বসবাস। অনেক সময় পরিচিতদের মাঝে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। কোনটা থেকে কোনটা বেছে নেব, কোনটায় উঠব আর কে মন খারাপ করে বসে রবে। সবাই ডাকে সবাই মুচকি হাসে। অনেক সময় রিকসায় না চড়ার অভিনয় করে লাইনে দাড়িয়ে থাকা রিকসার সর্বশেষ রিকসায় চড়তে চড়ি বা চড়ার মনস্থ করি। কারন যেতে তো হবে গন্তব্যে। আজকেও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি
ছোট একটা ছেলে স্কুল ড্রেস পড়া হাতে চায়ের ফ্লাক্স, পলিথিনে কয়েক পদের বিস্কিট। অনেক সময় এগুলোকে হার্ডওয়ার খাবার বলে থাকতাম, এখনও বলি । যে কর্মের সাথে জড়িত সেখানে প্রায় সময় এমন হার্ডওয়ার খেয়ে মধ্যাহ্নভোজের যন্ত্রণা লাঘব করতে হয়। তবে আজ সে রকম নয় । প্রায় সময় ছেলেটিকে দেখি। খুব মিষ্টি, নাম সেই প্রথম পরিচয়ে জানা। যেমন মিষ্টি ছেলেটা তেমন মিষ্টি তার নাম, তন্ময়। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম ভাই একটা বিড়ি দাও তো। সে বিড়ি বললেই বুঝতে পারে আমি কোন বিড়ি চাইছি। যে ছেলে প্রথম দিনেই ধরতে পেরেছে তাকে অবশ্যই মেধাবী এবং চালাক বলতেই হবে ।
বিড়ির সাথে ম্যাচ। আলতো করে ঠোঁটে রেখে জাহান্নামের অনল ধরিয়ে দিলাম টান। পকেট থেকে টাকা দিয়েই রিকসায়। রাজলক্ষ্মী এসে কিছুক্ষণ গাড়ি নির্বাচন করতে হলো। এটা নিত্যদিনের অভ্যাস। একারন আমি প্রায় সময় বিআরটিসিতেই চড়ে গন্তব্যে পৌছানোর চেষ্টা করি। আর এর অন্য আরেকটি কারনও আছে। দোতলায় প্রায় সময় বসার আসন খালি থাকে। আর অন্যান্য গাড়িতে দাড়িয়েই যেতে হয় পুরোটা গন্তব্য।
আজকে কেন জানি বনানীর উদ্দেশ্যে উত্তরা রাজলক্ষ্মী থেকে বেঙ্গল মটরস্ গাড়িকে নির্বাচন করেছি বলতে পারবো না। মনে হলো তাই উঠে পড়লা। উঠে তো ভালই লাগলো গাড়ির প্রায় আসন ফাঁকা। কেন জানি অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ গাড়িতে যাত্রী সংখ্যা খুব বেশি নয়।
তিন আসনের গদীকে বেছে নিলাম, গাড়ির ঠিক মাঝামাঝি। আমার মতো আরেকজন আছেন ইচ্ছে করে তার সাথেই বসে পড়লাম। ডান পাশের জানালা ঘেষে বসে আছেন আমার থেকে দেখতে অনেক সুন্দর যুবক। মুখে খোচাখোচা দাড়ি। ফর্সা মানুষের অবশ্যই এমন মুখভড়া দাড়ি থাকলে বেশ ভাল লাগে। বয়সে মনে হচ্ছে আমার ছোটই হবে। আড়ে আড়ে একবার চেয়েও নিলাম।
রাস্তায় হালকা জ্যাম লেগেই আছে এটা যেন জন্মসূত্রে পাওয়া পৈত্তিক সম্পত্তি। এ নিয়ে চিন্তার কোন কারন নেই। ঢাকা শহর মানেই জ্যামের শহর। জ্যাম ছাড়া ঢাকা শহর ঠিক পল্লীর তো মনে হয়। রাজলক্ষ্মী থেকে এয়ারপোর্ট কুড়ি মিনিট লেগে গেলো।
এয়ারপোর্ট বাস কাউন্টার এসে দাড়াতেই সারিসারি মেহগনি গাছের মতো দাড়িয়ে আছে হাফ সেঞ্চুরির মতো জনতা। এর অর্ধেক ইউনিভার্সিটি আর কলেজ পড়ুয়া এক একজন ইরানী মডেল মনে হচ্ছে। আগে এমন সুন্দর মেয়ে মানুষ খুব কম দেখা যেতে। দিন বদলের হাওয়ায় যেন বাহ্যিক সুন্দরের হাট বসেছে পৃথিবী জুড়ে। অবশ্যই তাদের জন্য এমনটা প্রাপ্য। আগের দিনে মেয়ে মানুষের সাথে অনেক অন্যায় অত্যাচার করা হতো। বর্তমানে যে করা হচ্ছে না তা নয়। সংসারের প্রথম সন্তান মেয়ে মানেই হলো ঐ সংসারের আল্লাহর রহমত বেশি।
যাই হোক সত্য কথা বলতে কি সুন্দরের পূজারি আমরা সবাই। অন্ধরা শরীরের ঘ্রাণ শুকেও আজকাল বলে দিতে পারে এমন সুগন্ধি কত বয়সের নারীর হতে পারে। স্বপ্নের মাঝে বিভোর হয়ে যায় আর আফসোস করতে থাকে। এমন আফসোস কে করে না, এমন আফসোস কি আমি করি না? সেটার একমাত্র উত্তর যদি এমন কেউ হাতটি ধরে বলতো চলো আমরা দুজন হারিয়ে যাই দূরাজানায়। চোখ বন্ধ করে মাথাটাকে ১৩৫ ডিগ্রী এঙ্গেল করে সম্মতি দিতাম। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলতাম আর হয়তো অঙ্গের ইশারা সবচেয়ে আগে প্রকাশ পেতো।
একে একে প্রায় সবাই গাড়িতে উঠেছে। সকল সিট পূর্ণ ফাঁকা পড়ে আছে শুধু আমার মাঝের আসনটি। মনে মনে ভাবলাম যাক বেঁচে গেছি এখনকার মতো এই আসনের কোন মালিক নেই। অন্তত খিলক্ষেত পর্যন্ত আরামে যাওয়া যাবে। গাড়ি সবেমাত্র হাটতে শুরু করেছে, চাঁকা মনে হয় তিনবার তার জায়গা পরিবর্তন করেছে। হঠাৎ করেই দেখি আর ঘুরছে না চাঁকা। মনে মনে ভাবতে থাকলাম গরীবের সুখ কপালে সহে না। কে যেন গরীবের সুখ নষ্ট করতে চলে আসছে।
কি সুন্দর চেহারা ইরানী নয় যেন মিসরী। কোথায় হারিয়ে গেছি বলতে পারবো না। স্বপ্ন কি সত্যি হয় ?
ভাই আপনি ভেতরে যাবেন? ভাই, আপনি ভেতরে যান আমি বসব। জ্ঞান ফিরে দেখি বাসের অন্যান্য যাত্রীরা আমার দিকে কালির চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি নাকি দু’তিন বার আমাকে এমন কথা বলেছেন। হঠাৎ করে চিন্তা ভঙ্গ, চোখে যেন সরষের ফুল দেখছি। একি এ এখানে কেন? কল্পনা কি বাস্তবে পরিণত হয়? ভ্যাকাচ্যাকা খেয়ে বললাম,
আপনি পুরুষের বাম পাশে বসবেন কেন? পুরুষের বাম পাশে বসার মানে জানেন? আপনি ভেতরে বসেন। আমি বাহিরেই থাকবো। আমার গন্তব্য খুব দূরে নয় । আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি অনেক দূরের যাত্রী। বারবার কষ্ট দেয়ার থেকে একবার কষ্ট দেয়া অনেক ভাল। যাক এবার সবার কালির চোখের দৃষ্টি আমায় মুক্তি দিয়েছে। সবাই মুক্তি দিয়েছে কিন্তু নাছোড় বান্দা সে তো আমায় মুক্তি দিচ্ছে না।
দেখেন এতো কিছু ভাবার সময় নাই, ঘন্টা খানেক দাড়িয়ে ছিলাম, কোমড় ম্যাজম্যাজ করতেছে। সরবেন নাকি আপনার কোলে বসে পড়ব। এবার শরমে লাল হয়ে গেলাম। সবাই হাসছে আর হাসছে।
লাফ দিয়েই মনে হয় বাম পাশের আসনটি শূন্য করে দিতে হইল। দুনিয়ায় এতো মাইয়া মানুষ দেখেছি এমন মাইয়া আজকেই প্রথম দেখতে পেলাম। চুপ হয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। হারিয়ে গেলাম স্বপ্নের রাজ্যে যেখানে রাজকুমারী থাকে। এভাবেই ভাবতেছিলাম যদি’র জীবন নিয়ে। হঠাৎ বিকট শব্দে সজাগ হলাম। মনে হলো যেন বজ্রপাত আমার দুই কর্ণে প্রবেশ করেছে। সকল চিন্তার অবসান।
কি আপনার সমস্যা কি? কোথায় উড়ে যান মাঝে মাঝে? কিছু বললেই দেখি চমকে উঠেন। রাস্তা ঘাটে স্বপ্ন দেখে বেড়ান নাকি ? স্বপ্নে মানুষ হৃদয়ে মোচড় দেয় এটা জানি কিন্তু আপনার দেখি আলাদা দিনের বেলায় চলন্ত গাড়িতে স্বপ্ন দেখেন দেখি। যাই হোক এতো বগবগ করতে পারমু না। সবাই আবার হকার ভাববে।
আচ্ছা আপনি আমাকে কি জানি জিজ্ঞেস করছিলেন ? ও মনে পড়েছে পুরুষের বাম পাশে বসতে নেই। পুরুষের বাম পাশে নারীর বসার রহস্য কি? সেটা আমি ভাল করেই জানি এবং সে বুঝার ক্ষমতা আমার খুব ভাল। প্রতিটি নারী এমন দিনের অপেক্ষা করে। আমিও করি। আপনি যতটুকু বুঝেন আমি ঠিক তার থেকে বেশি বুঝি। মুরুব্বীদের নিকট থেকে শুনেননি পনের বছরের ছেলে যা না বুঝে ১০ বছরের মেয়ে তার থেকে দুই গুণ বেশি বুঝে। আজ আর মিস করতে রাজি নই।
আপনার কথার মানে বুঝতে পারলাম না। “আজ আর মিস করতে রাজি নই ” এর মানে কি ?
আপনার এতো কিছু বুঝনের প্রয়োজন নেই। আমার বুঝা আমি বুঝে গেছি। অধিকার আদায় করেই নিতে হবে।
কিসের অধিকার, কার অধিকার ? মনেমনে হায় আল্লাহ আজ কোন পাগলের পাল্লায় ফেললে আমাকে।
কি আপনি একা একা বিড় বিড় করছেন ক্যান ? আমি কিন্তু পাগল নই। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। শুনুন, আমি সরাসরি কথা বলতে শিখেছি। যখন বলতে পারিনি তখন খুব কষ্ট করতে হয়েছে। জানি না এতোটা কষ্ট কেন হয়েছে। তবে এবার আর নয়, প্রতিজ্ঞা করেই বাসা থেকে বের হই প্রতিদিন একই সময়ে। ইনিভার্সিটির একটি ক্লাসও মিস করি। এসবের কারন একটিই। আগের ভুল শুধরে নেওয়ার।
আপনার ভুল আপনি শুধরে নিন, সেখানে আমার আবার কি প্রয়োজন। এতো কথা ভাল লাগছে না আপনি একটু চুপ থাকুন।
চুপ থাকলেই কাঁদতে হয় সেটা শিখেছি। আর কাঁদবো না একা একা।
আপনি কি বলতে চাইছেন ?
আমি আপনার বাম পাশের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
হায় আল্লাহ, তুমি আমাকে বাঁচাও। এবার বুঝি গণধোলাই খেতে হবে আমার। শেষ পর্যন্ত তুমি আমার কপালে এমন অপবাদ রেখেছিলে ? কি ভুল করেছিলাম আমি?
আপনি কোন ভুল করেননি। ভুল যা করার করেছিলাম আমি। তাই এবার আর ভুল করতে রাজি নই। আপনাকে মনে মনে শয়নে স্বপনে গত ছয় মাস যাবত খুঁজে চলছি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আপনাকে না পেলে অন্য কাউকে আমার ডান পাশ্বে স্থান দেব না। প্রথম যেদিন আজকের এই সময়ে আপনাকে এখানে পেয়েছিলাম আমি সেই সময়টি নিয়মিত মেনে চলছি গত ছয় মাস যাবত। এয়ার্পোট না দাড়িয়ে হাজী ক্যাম্পের এখানে দাড়িয়ে থাকি। বেঙ্গল মটরস্ গাড়ি ছাড়া অন্য কোন গাড়িতে আমি যাতায়াত করি না।
এটা আমার ধ্যান বলুন আর প্রার্থনা বলুন। আমার নিকট সব একটাই। আপনাকে খুঁজে বের করা। আপনি যদি আমার সাথে দুর্ব্যবহার করেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে কাছে পাবার জন্য আমি অনেক কিছুই করতে পারি। যতই আপনি অভিনয় করুন না কেন আজ পেয়েছি আজ আর ছাড়ব না। আল্লাহর সম্মতি যদি নাই থাকতো তাহলে ছয় মাস পর কেন আপনাকে সেই গাড়িতে ঠিক একই সময়ে পেলাম।
আচ্ছা, চলুন আপনার বাসাই যাই। যেহেতু আপনি আমাকে নিয়ে এমনটাই ভাবতে শুরু করেছেন তাহলে তো আপনার সম্পর্কে আমার জানতে হবে তাই না।
শুনুন আপনি আমাকে আমার বাসায় রেখে চলে আসতে চাইছেন ? কোন লাভ নেই। বাসার সবাইকে আমি বলে রেখেছি। আমি আমার পরিবারের একমাত্র সন্তান। আমার কোন ক্ষতি তারা চাইবে না। তবে এটা ঠিক তারা ভেবেছিল আমি আপনাকে পাবো না। আমি আপনাকে ভুলে যাব বলে আপনার ছবি আমি অঙ্কন করে আমার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছি।
দেখ তুমি ভুল পথে হাটছো। আমার চাল চুলো কোন কিছুই নেই।
উচ্চস্বরে হেসে হেসে, তাহলে আরো ভাল। এবার সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া গেলো। কোন ঝামেলা থাকার অবকাশ রইলো না।
নিরুপায় হয়ে রাস্তায় গণধোলাই থেকে বাঁচতে মৌমিতার সাথে রুদ্র আমিন মৌমিতার বাড়িতে উপস্থিত হলো। মৌমিতা যা যা বলেছে সম্পূর্ণ সত্য। মৌমিতার পরিবারের সবাই মৌমিতার কথাই শোনে। রুদ্র আমিনের আমীন বলা ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। তাই রুদ্র আমিন, শুধু আমীন, আমীন বলে গেল।