কপাল দোষে কখনো কখনো এমন রূপসী মায়াময়ী মেয়ে কেরানির ঘরে জন্ম নেয়। যৌতুক দেবার সামর্থ্য তাঁর ছিল না, বিয়ে নিয়ে বড় কোনো প্রত্যাশাও ছিল না তাঁর, না ছিল কোনো ধনী, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সাথে চেনা-জানা, মন দেওয়া-নেওয়া, ভালোবাসা বা বিয়ের উপায়; তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ছাপোষা কেরানির সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব এলে, সে বিয়েতে মত দিয়ে দেয়।
মেয়েটি সাদামাটাভাবে জীবন যাপন করত, কেননা এর চেয়ে বেশি কিছু করার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে ছিল খুবই অসুখী, যেন কোনো স্বর্গের দেবী নিঃস্ব হয়ে ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছে। তাঁর এমন পরিবারে বিয়ে হয়েছে যেখানে রূপ, লাবণ্য ও সৌন্দর্যের জন্য না আছে কদর, না আছে মর্যাদা, শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দেয়া, লালন-পালন করা, সংসার দেখাশুনা করাই যেন সবকিছু। মেয়েদের ক্ষেত্রে অকৃত্রিম কমনীয়তা, সহজাত লাবণ্য আর তুখোড় প্রজ্ঞাই কেবল দিতে পারে তাঁদের মর্যাদার পরিচয়, আর এ গুনগুলো একটি বস্তির মেয়েকেও দেশের সবচেয়ে সম্মানিত মহিলার সমতুল্য করে তুলতে পারে।
মেয়েটি নিঃসীম যন্ত্রণায় সবসময় কাতর হয়ে থাকত, ভাবত তাঁর জন্ম হয়েছিল বুঝি আভিজাত্য আর বিলাসিতায় জীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য। ঘরের দীন হীন অবস্থা, বিষণ্ণ দেয়াল, বিবর্ণ চেয়ার আর বিশ্রী পর্দাগুলোর জন্য সে যেন দুঃখে মরে যেত। এইসব বিষয়গুলো তাঁকে প্রতি নিয়ত যন্ত্রণা দিত, অপমানিত করত, যদিও তাঁর সম-মর্যাদার অনেক মেয়েই এ বিষয়ে আদৌ সচেতন ছিলেন না। লিটল ব্রিটনের মেয়েটি, যে তাঁর ছোট্ট বাড়িটায় কাজ করতে এসেছিল, ওর নানা গল্প তাঁর মনকে উসকে দিত হৃদয়-ভাঙা শত আক্ষেপ আর আশাহীন স্বপ্নে। সে কল্পনার জাল বুনত একটা শান্ত সুনিবিড় চিলেকোঠার; প্রাচ্যদেশীয় রঙিন, পশমি, কারুকার্য খচিত কাপড়ে ঢাকা তাঁর ঘরের দেয়াল, আসবাবপত্র; লম্বা লম্বা ব্রোঞ্জের ঝাড়বাতিতে আলোকিত ঘর; অতিথি অভ্যর্থনা আর খাবার টেবিলে পরিবেশনের জন্য বিশেষ পোশাক পরিহিত দুজন বড় মাপের খানসামা, যারা ঘুমোবে বড় বড় দুটি আরাম কেদারায়, পাশের চুল্লি থেকে আসা উষ্ণতায় যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরবে তাঁরা। মেয়েটি স্বপ্ন দেখত সুপ্রাচীন রেশমে সজ্জিত বড় একটা অতিথিশালার; সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার আর অমূল্য সব অলঙ্কারে সজ্জিত ঘর; মনোমুগ্ধকর ও সুগন্ধীতে পূর্ণ ছোট ছোট অভ্যর্থনা ঘর যেখানে অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধব ও বিখ্যাত কিংবা অত্যন্ত কাঙ্খিত সব মানুষদের নিয়ে আয়োজন করা হবে ছোট ছোট পার্টি, যাদেরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করলে অন্য সব মেয়েরা যেন হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে।
তিন দিনের ব্যবহৃত টেবিল-ক্লথে ঢাকা গোল-টেবিলে বসে যখন মেয়েটির স্বামী খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে স্যুপের বাটির ঢাকনা খুলতে খুলতে বলছিল, “আহা! স্কচ স্যুপ! এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে?”, মেয়েটি সেসময় তাঁর স্বামীর মুখোমুখী বসে স্বপ্নের জাল বুনছিল রুচিকর খাবারের, ঝলমলে রুপোর বাসন-কোসনের, দেয়াল জুড়ে সাজানো রেশমি কাপড়ের ক্যনাভাসে আঁকা প্রাচীন লোক-গাঁথা, মায়াময় অরণ্যের রূপকথার সব পাখি; সে কল্পনায় জমকালো পাত্রে সুস্বাদু সব খাবার পরিবেশন করছিল, গুন গুন করে গান গাইছিল, যেন কেউ ট্রাউট মাছের গোলাপি মাংস কিংবা তিতিরের ডানা খেতে খেতে রহস্যময় মিষ্টি হাসি নিয়ে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে আছে।
মেয়েটির ভালো কোনো পোশাক নেই, গহনা নেই, নাহ! কিছুই নেই। অথচ সে এই জিনিসগুলোকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত; সে অনুভব করত, এ সবের জন্যই যেন তাঁকে বানানো হয়েছে। সে চাইত খুব সুখী হতে, চাইত ঈর্ষার পাত্রী হতে, অন্যের কাছে পরম আকাঙ্খিত, মনোহারিনী হয়ে থাকতে।
স্কুলে পড়াকালীন সময়ের পুরনো এক ধনী বান্ধবী ছিল মেয়েটির, যার বাড়িতে বেরানোর আমন্ত্রণ এলে সে নানা ছলে এড়িয়ে যেত, কেননা বাড়িতে ফিরে নিদারুণ মর্মপীড়ায় দগ্ধ হত সে। প্রচণ্ড দুঃখে, অনুতাপে, হতাশায় আর যন্ত্রণায় সে সারাটা দিন ফুঁপিয়ে কেঁদে চোখের জল ফেলত।
***
বড় একটা খাম হাতে নিয়ে, এক দিন সন্ধ্যায় তাঁর স্বামী জয়োল্লাস করতে করতে বাড়ি ফিরলেন।
“দেখো, কী নিয়ে এসেছি তোমার জন্য”, সে বলল।
মেয়েটি দ্রুত খাম ছিঁড়ে ছাপানো কার্ডখানা বের করল, সেখানে এই শব্দগুলো লেখা ছিল-
“শিক্ষামন্ত্রী ও মাদাম রামপোনিউ ১৮ জানুয়ারি, সোমবার সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয়ে মসিয়েঁ ও মাদাম লইজেল এর সদয় উপস্থিতি কামনা করছেন”।
মেয়েটির স্বামী ভেবেছিল সে উল্লাসে মেতে উঠবে, কিন্তু তার পরিবর্তে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে দাওয়াত কার্ডটি টেবিলে ছুড়ে ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
“এটা দিয়ে কি করতে বল আমাকে?”
“কেন, সোনা, আমি ভেবেছিলাম তুমি অনেক খুশি হবে। এত বড় আয়োজনে তুমি কখনো যাও নি। এটা পাওয়ার জন্য আমি প্রচণ্ড কষ্ট করেছি। প্রত্যেকেই এটা পেতে চেয়েছিল, কিন্তু এটা ছিল নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য, অফিস সহকারীদের মধ্যে খুব অল্প কয়েক জনই এটা পেয়েছে। বিখ্যাত সব মানুষদের দেখা পাবে সেখানে তুমি”।
মেয়েটি তাঁর স্বামীর দিকে ক্রোধোন্মত্ত চোখে তাঁকিয়ে অধৈর্য্য নিয়ে বললেন,
“আর কী ভেবেছ তুমি, এই অনুষ্ঠানে আমাকে কী পরে যেতে হবে?”
সে এই ব্যপারটা নিয়ে কিছু ভাবে নি, তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“কেন, যে পোশাকটা পরে তুমি থিয়েটারে যাও। আমার কাছে ওটা দেখতে অনেক সুন্দর লাগে.......”
স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে সে চুপ হয়ে গেল, নিজেকে খুব বোকা ভাবতে ইচ্ছে করছিল তাঁর, কি বলবে বুঝতে পারছিল না সে। বড় বড় দুই ফোঁটা জল চোখের কোণ বেয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলল মুখের কোণের দিকে।
“কী হয়েছে তোমার? কী হয়েছে তোমার?”, তোতলাতে তোতলাতে বলল সে।
মেয়েটি তীব্র প্রচেষ্টায় তাঁর প্রচণ্ড দুঃখটাকে দমন করল, ভেজা গাল মুছে শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,
“নাহ! কিছু হয় নি আমার। আমার তো শুধু পোশাক নেই, তাই পার্টিতে যেতে পারছি না। তুমি বরং কার্ডটি তোমার কোনো বন্ধুকে দিয়ে দাও, যার স্ত্রী সাজলে আমার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর দেখায়”।
কষ্টে লইজেলের হৃদয় ভেঙে গেল।
“এদিকে দেখো মাথিল্ডে”, সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “একটা মানানসই পোশাকের দাম কত পরবে, যা তুমি অন্য অনুষ্ঠানেও পরতে পারবে, খুব সাধারণ মানের একটা পোশাক?”।
মাথিল্ডে বেশ কয়েক সেকেন্ড ভাবল, হিসেব করে দেখল মূল্য কত হতে পারে, আর ভয়ে ভয়ে এও ভাবল অঙ্কটা বেশি হয়ে গেল কিনা, যেন হিসেবি কেরানি তা শোনার সাথে সাথেই অসম্মতি দিতে না পারে।
শেষ পর্যন্ত সে কিছুটা দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিল,
“আমি ঠিক জানি না, তবে মনে হয় চারশ ফ্রাঁতে হয়ে যাবে”।
লইজেলের মুখ কিছুটা মলিন হয়ে গেল, ঠিক এই পরিমান ফ্রাঁ সে জমিয়ে রেখেছিল একটা বন্দুক কেনার জন্য, ইচ্ছে ছিল আগামী গৃষ্মে তাঁর বন্ধুদের সাথে নাঁটেরে সমভূমিতে ছোট একটা শিকারে বের হবে, প্রত্যেক রবিবারে তাঁর বন্ধুরা সেখানে লার্ক পাখি শিকারে যায়।
তা সত্ত্বেও সে বলল, “ঠিক আছে, তোমাকে আমি চারশ ফ্রাঁ দেব। কিন্তু তোমাকে এই টাকাতেই খুব সুন্দর একটা পোশাক কিনতে হবে”।
পার্টির দিন এগিয়ে আসে, আর মাদাম লইজেলকে বিষণ্ণ, অস্থির ও উদ্বিগ্ন দেখায়। অবশ্য, তাঁর পোশাক তৈরী ছিল। এক সন্ধ্যায় তাঁর স্বামী জানতে চাইল,
“তোমার কি হয়েছে বলতো? গত তিন দিন ধরে তোমাকে খুব অস্বাভাবিক লাগছে”।
“আমার অবস্থা একদম যাচ্ছে-তাই, পরার মতো কোনো অলঙ্কার নেই, না আছে একটা হার”, মাথিল্ডে উত্তর দিল, “আমার দিকে কেউ তাঁকিয়েও দেখবে না। আমার বরং পার্টিতে না যাওয়াই ভালো”।
“ফুল পরতে পারো”, লইজেল বলল, “বছরের এই সময়টাতে ফুল দেখতে বেশ লাগে। দশ ফ্রাঁ দিয়ে তুমি দুই তিনটি চমৎকার গোলাপ পেয়ে যাবে”।
মাথিল্ডেকে বোঝানো গেল না।
“না...এত ধনী নারীদের মাঝে নিজেকে দরিদ্র হিসেবে দেখানো, এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই”।
“তুমি কত বোকা!” বিষ্ময় নিয়ে তাঁর স্বামী বলল, “যাও, মাদাম ফরেস্টায়ের সাথে দেখা করে কিছু অলঙ্কার ধার চাও। তোমার সাথে তাঁর যে সম্পর্ক, তুমি ধার চাইলে সে না দিয়ে পারবে না”।
মাথিল্ডে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলল।
“ঠিক বলেছ। আমি তো আগে কখনো ভেবে দেখি নি”।
পরের দিন সে তাঁর বান্ধবীর সাথে দেখা করে তাঁর সমস্যাটা জানালো।
মাদাম ফরেস্টায়ের তাঁর ড্রেসিং-টেবিলের কাছে গিয়ে বড় একটা বাক্স তুলে নিল, মাদাম লইজেলের কাছে এনে খুলে বলল, “বেছে নাও, বন্ধু”।
প্রথমে সে কিছু ব্রেসলেট দেখল, এরপর একটা মুক্তোর হার, নিপুণ হাতে তৈরী অপরূপ সুন্দর রত্নখচিত স্বর্ণের ভেনিসীয় ক্রুশ দেখল। অলঙ্কারগুলো পড়ে আয়নার সামনে নিজেকে মেলে ধরে দেখল কেমন মানায়, দ্বিধায় পড়ে গেল সে, না পারছিল ওগুলো রেখে দিতে, না ফিরিয়ে দিতে। অলঙ্কারগুলো রাখতে রাখতে জানতে চাইল,
“আর নেই এগুলো ছাড়া?”
“আছে তো। তুমি নিজেই দেখো না। আমি জানি না কোনটা তোমার সব চেয়ে বেশি পছন্দ হবে”।
মাথিল্ডে হঠাৎ কালো রেশমি কাপড়ে মুড়ান একটা বাক্সে চমৎকার একটা হীরের হার আবিষ্কার করল; হারটি পাওয়ার সুতীব্র আকাঙ্খায় তাঁর বুকে ধুক ধুক কাঁপন শুরু হল। সেটি তোলার সময় তাঁর হাত কাঁপছিল। হারটি গলায় জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে পুলকিত হয়ে উঠল সে।
এরপর, সে কিছুটা দ্বিধা আর ভয় নিয়ে জানতে চাইল,
“তুমি কি আমাকে এটি ধার দিতে পারবে, শুধু এটিই?”
“হ্যা, অবশ্যই”।
মাথিল্ডে খুশিতে তাঁর বান্ধবীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে সজোড়ে আলিঙ্গন করল এবং তাঁর অলঙ্কারটি নিয়ে ফিরে এল।
পার্টির দিন চলে এল। মাদাম লইজেল সার্থক। উপস্থিত মেয়েদের মধ্যে সে সবচেয়ে সুশ্রী, রুচিশীল, মার্জিত, হাসি-খুশী আর আনন্দে উচ্ছ্বল। সকল পুরুষই তাঁর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইল, তাঁর নাম জানতে চাইল, আর তাঁর সাথে পরিচিত হতে চাইল। সব প্রতিমন্ত্রীই তাঁর সাথে নাচতে আগ্রহ দেখাল। মন্ত্রী তাঁকে লক্ষ্য করলেন।
মাথিল্ডে পরমানন্দে পাগলের মতো নাচলেন, মনের সুখে পান করলেন, কোন কিছুর জন্য ভাবনা নেই তাঁর, রূপ-লাবণ্যের জন্য বিজয়োল্লাস, সাফল্যের অহঙ্কার, সুখের মেঘে ভেসে যাওয়া, এই সব তাঁকে এনে দিল সার্বলৌকিক প্রণতি আর প্রশংসা, তাঁর মনের সকল বাসনা আজ পূর্ণতা পেল, তাঁর নারী হৃদয়ে এ পূর্ণ জয় বড় মধুর!
প্রায় সকাল চারটার দিকে মাথিল্ডে পার্টি-রুম থেকে ফিরলেন। তাঁর স্বামী আরো তিনজনের সাথে যাদের স্ত্রীরাও আনন্দ-ফুর্তিতে সময় পার করছিলেন পার্টিতে, ছোট একটা পরিত্যক্ত রুমে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢুলু চোখে অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাড়ি ফেরার জন্য মাথিল্ডের জন্য আনা পোশাক সে তাঁর কাঁধের দিকে ছুড়ে দিলেন, প্রাত্যহিক সাদাসিধা পোশাক, যার দৈনতা এই নাচের পোশাকের সৌন্দর্যের সাথে বড়ই বেমানান। মাথিল্ডে এ ব্যপারে সচেতন ছিলেন, তাই দ্রুত ফিরে আসার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন পাছে দামী পোশাক পরা অন্য মহিলারা তাঁকে দেখে ফেলে।
লইজেল তাঁকে থামালেন।
“একটু অপেক্ষা কর। খোলা জায়গায় দাঁড়ালে তোমার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আমি ক্যাব আনতে যাচ্ছি”।
কিন্তু মাথিল্ডে তাঁর কথা না শুনে খুব দ্রুত সিঁড়ি মাড়িয়ে নিচে নেমে এলেন। রাস্তায় এসে তাঁরা কোন ক্যাব পেলেন না; খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন, দূর দিয়ে যাওয়া ক্যাবের ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে ডাকলেন।
হতাশাগ্রস্ত হয়ে তাঁরা সীন নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলেন, আর ঠক ঠক করে শীতে কাঁপছিলেন। অবশেষে তাঁরা জাহাজঘাটের কাছে পুরনো একটা নৈশ গাড়ি পেলেন, যেগুলো প্যারিসে শুধু রাতের আঁধার নেমে এলেই দেখা যায়, যেন দিনের আলোয় এদের জরাজীর্ণতা দেখাতে এরা লজ্জা পায়।
গাড়িটি তাঁদেরকে র্যো দ্যে মার্টিয়ার্সের দরজায় পৌছে দিলে, তাঁরা বিষণ্ণভাবে তাঁদের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টের দিকে হেঁটে চলে গেল। মাথিল্ডের জন্য এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু লইজেল ভাবছিল, তাঁকে অবশ্যই কাল সকাল দশটায় অফিস ধরতে হবে।
মাথিল্ডে তাঁর কাঁধ পর্যন্ত ঢেকে রাখা পোশাকগুলো খুলল, যেন সে আয়নার সামনে বসে নিজেই তাঁর মহিমাটুকু উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু হঠাৎকরেই সে আর্তনাদ করে উঠল। তাঁর গলায় হারটি আর নেই।
লইজেল ইতোমধ্যে তাঁর অর্ধেক পোশাক খুলে ফেলেছে। মাথিল্ডের কাছে জানতে চাইল, “কী ব্যাপার বলো তো?”
মাথিল্ডে চরম হতাশা নিয়ে তাঁর দিকে ফিরল।
“আ... আ... আমি মাদাম ফরেস্টায়েরের হারটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”
লইজেল মহাবিস্ময় নিয়ে মাথিল্ডের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো।
“কী!... অসম্ভব!”
মাথিল্ডের পোশাকের ভাঁজে, কোটের ভাঁজে, পকেটে, সব জায়গায় তাঁরা খুঁজে দেখলেন। কোথাও হারটি পেলেন না।
লইজেল বলল, “তুমি কি নিশ্চিত, বলরুম থেকে বের হয়ে আসার সময় হারটি তোমার গলায় ছিল?”
“হ্যা, মন্ত্রণালয়ের হলরুমে থাকতে ওটা আমি ছুঁয়ে দেখেছিলাম।”
“কিন্তু তুমি যদি রাস্তায় হারাতে, ওটা পড়ার শব্দ আমরা শুনতে পেতাম।”
“হ্যা। সম্ভবত পেতাম। তুমি কি ক্যাবটির নম্বর রেখেছিলে?”
“না। তুমিও খেয়াল করনি, তাই না?”
“না।”
তাঁরা বিহ্বল হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শেষ পর্যন্ত, লইজেল তাঁর পোশাক আবার পরলেন, বললেন, “আমি বের হচ্ছি, যেসব জায়গায় আমরা হেঁটেছি তার সবখানেই যাবো, দেখি হারটি পাওয়া যায় কিনা।”
লইজেল বেরিয়ে পড়লেন। মাথিল্ডে সন্ধ্যার পোশাকগুলো পরে রইলেন, বিছানায় যাওয়ার শক্তিটুকু হারিয়ে, নিরুত্তাপ আর চিন্তাশূন্য হয়ে, চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলেন।
কোথাও খুঁজে না পেয়ে, তাঁর স্বামী সাতটার দিকে ফিরলেন।
লইজেল পুলিশ স্টেশনে গেলেন, পত্রিকা অফিসে গেলেন, পুরস্কার ঘোষণা করলেন, ক্যাব কোম্পানিগুলোতে গেলেন, যা করা সম্ভব তার সবটুকুই করলেন, যেদিকে বিন্দুমাত্র আশার আলো দেখলেন, সেদিকেই ছুটলেন।
মাথিল্ডে সারাটা দিন অপেক্ষা করলেন, এই ভয়ানক বিপর্যয়ে সেই একই রকমভাবে বিহ্বল হয়ে।
বিষণ্ণ ও মলিন মুখে লইজেল রাতে বাড়িতে ফিরলেন; সে কিছুই খুঁজে পায় নি।
“তুমি এখনই তোমার বান্ধবীকে চিঠি লেখ”, লইজেল মাথিল্ডেকে বলল, “আর তাঁকে বলবে, তুমি তাঁর হারের আঙটা ভেঙে ফেলেছ এবং এটি মেরামত করতে পাঠানো হয়েছে। এতে করে, এটা নিয়ে ভাবার কিছুটা সময় অন্তত আমরা পাবো।”
মাথিল্ডে তাঁর স্বামীর নির্দেশনা মতো লিখলেন।
***
সপ্তাহ শেষে তাঁরা হারটি ফিরে পাওয়ার সব আশা হারিয়ে ফেলল।
এই কয়দিনে যেন লইজেলের বয়স পাঁচ বছর বেড়ে গেছে। সে বলল, “হারটি কিভাবে বদলে দেয়া যায়, আমাদের এখন তাই ভাবতে হবে।”
পরের দিন তাঁরা হারটির বাক্সের ভিতরে লেখা জুয়েলারি দোকানের ঠিকানায় বাক্সটি নিয়ে গেলেন। লইজেল হারটির মূল্য কেমন হতে পারে, কত দিনে দিতে পারবে, এসব নিয়ে দোকানীর সাথে আলোচনা করলেন।
“এই হারটি আমি বিক্রি করি নি, মাদাম; আমি স্রেফ এর আঙটা সরবারহ করতে পারি।”
এরপর তাঁরা একটার পর একটা জুয়েলারি দোকানে গেলেন, আগেরটির মতো দেখতে আরেকটি হার খুঁজলেন, তাঁদের স্মৃতি থেকে সেটার বর্ণনা দিয়ে দোকানীর পরামর্শ চাইলেন, তীব্র অনুতাপ আর মনঃকষ্টে দুইজনকেই অসুস্থ দেখাচ্ছিল।
পলা-রয়্যালের একটি দোকানে তাঁরা হীরের একটি হার খুঁজে পেলেন, দেখতে ঠিক আগেরটির মতই যা তাঁরা খুঁজছিলেন। এর মূল্য ছিল চল্লিশ হাজার ফ্রাঁ। দোকানি তাঁদেরকে এটা ছত্রিশ হাজার ফ্রাঁতে দিতে চাইলেন।
তাঁরা দোকানীকে অনুরোধ করল, যেন এটা আগামী তিন দিনের মধ্যে বিক্রি করা না হয়। আর দোকানীর সাথে এই সমঝোতায় এলেন, ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার আগেই যদি তাঁরা হারিয়ে যাওয়া হারটি খুঁজে পান, তবে দোকানী এটি চৌত্রিশ হাজার ফ্রাঁতে আবার ফিরিয়ে নেবেন।
লইজেলের কাছে আঠার হাজার ফ্রাঁ ছিল, যা তাঁর বাবা রেখে গিয়েছিল। সে ভাবল, বাকিটা সে ধার করবে।
সে ধার করল, এক জনের কাছে থেকে পেল এক হাজার ফ্রাঁ, অন্য জনের কাছে পাঁচশত ফ্রাঁ, পাঁচ লুই এখানে, তিন লুই সেখানে। সে দলিল জমা রাখল, সর্বনেশে সব চুক্তি করল, সুদের কারবারি আর সকল জাতের মহাজনদের কাছে থেকে ঋণ নিল। সে তাঁর সমগ্র অবশিষ্ট জীবনটাকেই বন্ধক রাখল, পরিশোধ করতে আদৌ পারবে কিনা না জেনেই এমন একটা দলিলে স্বাক্ষর করার ঝুঁকি নিল, যন্ত্রণাকাতর ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়ার কথা ভেবে মর্মাহত হল, গভীর দুর্দশায় পড়ার আশঙ্কা নিয়ে, সকল ধরণের শারীরিক বঞ্চনা আর মানসিক পীড়নের সম্ভাবনা নিয়ে, সে নতুন হারটি আনতে গেল, জুয়েলারি দোকানের কাউন্টারে ছত্রিশ হাজার ফ্রাঁ জমা দিল।
যখন মাদাম লইজেল হারটি মাদাম ফরেস্টায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন, তিনি তাঁকে কর্কশ কণ্ঠে বললেন, “তোমার আরো আগে ফিরিয়ে দেয়া উচিত ছিল; আমার এটি প্রয়োজন হতে পাড়ত।”
মাথিল্ডে বাক্সটি খুলল না, সে তাঁর বান্ধবীকে খুব ভয় পাচ্ছিল। যদি হার বদল সে লক্ষ্য করে, কি ভাববে সে? কি বলবে সে? সে কি তাঁকে চোর মনে করবে না?
***
মাদাম লইজেল শোচনীয় দরিদ্রদশার ভয়ঙ্কর জীবনের সাথে পরিচিত হতে লাগলেন। একেবারে শুরু থেকেই তাঁর দায়িত্বটুকু সে সাহসের সাথে পালন করে চললেন। এই ভয়ানক ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। সেই পরিশোধ করবে। কাজের লোক ছাটাই করা হল। তাঁরা তাঁদের ফ্ল্যাট পাল্টালেন; ছাদের নিচে একটা চিলেকোঠা নিলেন।
সে পরিচিত হতে লাগল গৃহের ভারী ভারী কাজকর্মের সাথে, রান্নাঘরের ঘৃণ্য কাজগুলোর সাথে। সে বাসনকোসন ধুয়ে দিত, তাঁর সুকোমল সুশ্রী আঙ্গুল আর গোলাপী নখগুলো দিয়ে পাতিলের চর্বি এবং কড়াইয়ের নিচে লেগে থাকা ময়লা পরিস্কার করত। সে ময়লা বিছানার চাদর, অন্তর্বাস, শার্ট আর থালাবাসনের ক্লথ ধুয়ে তারের উপর ঝুলিয়ে দিত রোদে শুকানোর জন্য; প্রত্যেক দিন সকালে সে ডাস্টবিনের ঝুড়ি নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসত, পানি টানতে গিয়ে একটু পর পর থামত শ্বাস নিতে। গরিব মহিলার মত পোশাক পরে, কাঁখে ঝুড়ি নিয়ে সে ফলবিক্রেতা, মুদি দোকানী, মাংস বিক্রেতার কাছে যেত, দর কষাকষি করত, অপমানিত হত, তাঁর কষ্টার্জিত টাকার প্রতিটি আধা-পেনি বাঁচানোর জন্য যেন যুদ্ধ করত।
প্রত্যেক মাসের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হত, নতুবা সময় বাড়ানোর জন্য নতুন ঋণ নিতে হত।
তাঁর স্বামী সন্ধ্যায় বণিকের হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ করতেন, আর প্রায় রাতেই প্রতি পৃষ্ঠা দুই পেনি-আধা পেনি হিসেবে পাণ্ডুলিপি নকলের কাজ করতেন।
এইভাবে জীবন চলল দশ বছর।
দশ বছর শেষে সকল ঋণ পরিশোধ হল, সবকিছু, সুদের কারবারির সব টাকা, পুঞ্জিভূত সব চক্রবৃদ্ধি সুদ।
মাদাম লইজেলকে এখন বৃদ্ধ দেখায়। সে অন্য সব গরিব পরিবারের মহিলাদের মত সবল, শক্ত সামর্থ্য আর স্থূলকায় হয়ে উঠেছে। তাঁর চুলগুলো এলোমেলো, অপরিপাটি, স্কার্ট কুচকে গেছে, হাতদুটি লাল হয়ে গেছে। সে কথা বলে কর্কশ কণ্ঠে, মেঝে পরিস্কার করার সময় পানি পুরো মেঝেতে ছলকে পরে। কিন্তু মাঝেমাঝে, তাঁর স্বামী যখন অফিসে থাকে, সে জানালার পাশে বসে, অনেক দিন আগের সেই সন্ধ্যার কথা ভাবে, সেই বলরুম যেখানে সে দেখতে ছিল খুব সুন্দর, সকলের কাছে অনেক রূপমুগ্ধ।
কি ঘটত, যদি সে সেই হারটি না হারাত? কে জানে? কে জানে? জীবনটা কত বিস্ময়কর, কত পরিবর্তনশীল! কত অল্প কিছু প্রয়োজন একটা জীবন ধ্বংস করে দিতে অথবা বাঁচাতে?
সপ্তাহ ধরে পরিশ্রমের কাজ শেষে নিজেকে চাঙ্গা করার জন্য এক রবিবারে, সে চ্যাম্প-এলিসির পাশ দিয়ে হাঁটতে বের হল। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, এক মহিলা একটি শিশুকে সাথে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। সে মাদাম ফরেস্টায়ের, এখনও তরুণী, এখনও রূপবতী, এখনও আকর্ষণীয়।
মাদাম লইজেল নিজের অনুভূতির সাথে বোঝাপড়া করছিলেন। সে কি মাদাম ফরেস্টায়েরের সাথে কথা বলবে? হ্যা, নিঃসন্দেহে। কতটুকু মূল্য সে দিয়েছিল, এখন সব বলবে তাঁকে। কেন নয়?
মাদাম লইজেল তাঁর দিকে এগিয়ে গেল।
“শুভ সকাল, জেনি।”
মাদাম ফরেস্টায়ের তাঁকে চিনতে পারল না, একজন গরিব মহিলা শুরুতেই এত অন্তরঙ্গভাবে সম্বোধন করছে দেখে সে বিস্মিত হল।
“কিন্তু... মাদাম...” সে তোতলামি করছিলেন, “আমি আপনাকে চিন্তে পারছি না... আপনি নিশ্চয় কোন ভুল করছেন।”
“না... আমি মাথিল্ডে লইজেল”।
তাঁর বান্ধবী আর্তনাদ করে উঠলেন।
“ওহ!... বেচারি মাথিল্ডে, তুমি কতটা বদলে গেছ!...”
“হ্যা, তোমার সাথে শেষ বার দেখা হবার পর, আমি কিছু কঠিন সময় পার করেছি; অনেক দুঃখ-কষ্ট... সব তোমার জন্য।”
“সব আমার জন্য!... কি ছিল তা?”
“তোমার মনে আছে সেই হীরের হারের কথা, মন্ত্রণালয়ের বল পার্টিতে পরার জন্য আমাকে ধার দিয়েছিলে?”
“হ্যা। তারপর?”
“তারপর, এটি আমি হারিয়ে ফেলি।”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছ? কেন, তুমি তো ওটা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে?”
“আমি তোমাকে ঠিক ওটার মতই আরেকটি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আর গত দশ বছর ধরে, তার জন্য আমরা মূল্য দিয়ে আসছি। তুমি উপলব্ধি করতে পারবে, সেটা আমাদের জন্য সহজ ছিল না; আমাদের কোন টাকা পয়সা ছিল না... তারপরও, অবশেষে এটি পরিশোধ হয়ে গেছে, আর এজন্যই আমি আনন্দিত”।
মাদাম ফরেস্টায়ের তাঁকে থামালেন।
“তুমি বলছ, আমারটি বদলে দিতে তোমরা হীরের হার কিনেছিলে?”
“হ্যা। তুমি কি সেটি লক্ষ্য কর নি? ওটি দেখতে প্রায় একই রকম ছিল।”
মাদাম লইজেল আত্নতৃপ্তি নিয়ে মৃদু হাসলেন, নির্মল সে সুখ।
মাদাম ফরেস্টায়ের গভীরভাবে নড়ে উঠলেন, মাদাম লইজেলের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
“ওহ! বেচারি মাথিল্ডে! কিন্তু আমারটি ছিল মেকি। এর মূল্য বড় জোড় পাঁচ শত ফ্রাঁ!....”
মূল গল্পটি এখানে পড়ুন ।