(১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারন অনুসন্ধানে গঠিত হামূদুর রহমান কমিশনের আংশিক রিপোর্ট পাকিস্তানে ২০০১ সালে সরকারিভাবে প্রকাশিত হয় (এই সম্পর্কিত আমার পূর্বের পোস্টটি দেখুন) ।এটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধ ও গনহত্যা ও পাকিস্তানের ভাঙনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার জন্য জন-সাধারনের চাপ বাড়তে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, লেফটেনান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে rediff.com এর মালিকানাধীন সর্বাধিক প্রচারিত ইন্দো-আমেরিকান সংবাদপত্র India Abroad এ একটি সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন।এখানে তিনি অনেক স্পর্শকাতর কথাই অকপটে স্বীকার করেন, অনেক গোপন তথ্য প্রকাশ করেন, আবার তাকে বা তার অধীন ইস্টার্ন কমান্ডের প্রতি তোলা অভিযোগগুলো কৌশলে এড়িয়ে যান।এই সাক্ষাতকারটি পরবর্তীতে তিনি মারা যাওয়ার একদিন পর ০২ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ তারিখে rediff.com তাদের আন্তর্জালের পাতায় পুনরায় প্রকাশ করে।বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য নতুনভাবে উদ্যোগ শুরু হওয়ায়, প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে দুর্লভ এই ইংরেজী সাক্ষাতকারটি বাংলায় অনুবাদ করে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম।)
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে উপুর্যপরি,হতচকিত আক্রমণ ও অগ্রাভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পতন ঘটায় এবং বাংলাদেশকে মুক্ত করে।ভারতের এই অন্যতম ক্ষিপ্রতর ও উজ্জ্বলতম সেনা অভিযান শুধু পাকিস্তানকে ভাঙেনি, পাশাপাশি দেশটিকে উপহার দি্যেছিল এক চিরস্থায়ী লজ্জা।
পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম বাংলাভাষীদের উপর দমন অভিযান শুরু করে যারা অধিকতর স্বায়ত্বশাসন চাইছিল, এর ফলে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধের কারনে সামরিক অভিযানের ভয়ে পূর্ব থেকে পলায়নপর ১০ মিলিয়ন বাঙ্গালি শরণার্থীকে ভারতবর্ষ আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছিল।পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জম্মু ও পাঞ্জাবে অবস্থিত ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণের নির্দেশ দিলে উত্তেজনা চরমে পৌছায়।এর সমুচিত জবাব দিতে ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন।
১৩ দিন পরে লেফটেনান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্ত্বাধীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্নসমর্পন করে।পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্ব জেনারেল নিয়াজির অধীনে থাকায়, যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য তাকে দায়ী করা হয় এবং ১৯৭৫ সালে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারন করা হয়।যুদ্ধ শেষ হলে পাকিস্তানে যে হামূদুর রহমান তদন্ত কমিশন গঠিত হয়, তার আংশিক রিপোর্ট সরকারীভাবে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে যদিও জেনারেল নিয়াজির কোর্ট-মার্শাল হওয়া উচিত বলে সুপারিশ করা হয়, অবশ্য তাকে কোনো ধরণের বিচারের মুখোমুখি হতে হয় নি।
তিন দশক পরে, অসুস্থ, ৮৬ বছর বয়সী জেনারেল নিয়াজি নিজেকে নির্দোষ প্রমানের জন্য স্বেচ্ছায় কোর্টমার্শালে বিচারের মুখোমুখি হতে চেয়েছিলেন।
তৎকালীন ভারতবর্ষের পাঞ্জাব প্রদেশের মিয়ানওয়ালির নিকট বালো-খেল গ্রামে ১৯১৫ সালে জন্ম নেওয়া জেনারেল নিয়াজি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ২৪টি মেডেল পেয়েছিলেন।তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমান্ডের নেতৃত্ত্বে ছিলনঃ ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরূদ্ধে যুদ্ধে ৫ পাঞ্জাব, পাকিস্তান কর্তৃক কাশ্মির ও সিয়ালকোট দখল অভিযানের সময় ১৪ প্যারা ব্রিগেড।তিনি করাচি ও লাহোরের সামরিক প্রশাসক ছিলেন।
জেনারেল নিয়াজি যিনি গত সোমবার মারা গিয়েছেন , ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে rediff.com এর মালিকানাধীন সর্বাধিক প্রচারিত ইন্দো-আমেরিকান সংবাদপত্র India Abroad এ একটি সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। এই দুর্লভ সাক্ষাতকারটি নিয়েছিলেন আমির মির।
হামুদূর কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ হবার পর নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে, রিপোর্টের সুপারিশ যা জন-সাধারণের সমর্থ্ন পাচ্ছে, ১৯৭১ সালের পরাজয়ের জন্য যে সব সামরিক অফিসার দায়ী তাদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
আমি জন-সাধারণের দাবীকে সমর্থন জানিয়ে বলছি, যারা বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর যেসব সদস্য পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কটের জন্য দায়ী, তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত।পরাজয়ের পর পাকিস্তানে ফিরে আমি স্বেচ্ছায় কোর্ট-মার্শাল প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে চেয়েছিলাম।কিন্তু সেসময়ের সেনাবাহিনী প্রধান টিক্কা খান আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।সে প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে চায় নি।এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে যুদ্ধ পরিচালনায় জেনারেল হেডকোয়্যাটারের অযোগ্যতা ও রিজার্ভ সেনাবাহিনী্র কমান্ডার হিসেবে টিক্কার ভূমিকা প্রকাশ হয়ে যেত।সত্য বলতে কি, হামুদূর রহমান কমিশনের সামনে আমাদের আত্ন-রক্ষার অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছিল, কিন্তু কোর্ট-মার্শালের সময় এটা অস্বীকার করা যায় না।
পাকিস্তান আর্মি অ্যাক্ট অনুসারে আপনি আপনার স্বপক্ষে এক জন প্রত্যক্ষদর্শীকে জেরা করতে পারেন, ডাকতে পারেন, বিশেষ করে যখন আপনার চরিত্র ও সম্মান ঝুঁকির মধ্যে থাকে।এই ধরনের সুযোগ জেনারেল হেডকোয়্যাটারের(GHQ) দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে দেয়, তাই আমাদের কখনই কোর্ট-মার্শাল হবে না।যদি কখনও কোর্ট-মার্শাল হয়ও, আমি সহজেই অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবো।কমিশন আমার এই যুক্তির প্রতি সম্মতি প্রকাশ করেছে যে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আমাকে আত্ন-সমর্পণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
আপনি বলেছেন, কমিশন আপনার এই যুক্তির প্রতি সম্মতি প্রকাশ করেছে যে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আপনাকে আত্ন-সমর্পণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু মোশারফের সময়ে প্রকাশিত রিপোর্টে এই পরাজয়ের জন্য আপনিসহ কয়েকজন জেনারেলকে দায়ী করা হয়েছে?
যদি আমি এই বড় বিয়োগান্তক ঘটনার জন্য দায়ী হই, কেন আমার কোর্ট-মার্শাল হল না, যদিও টিক্কা আমাকে ক্ষতি করতে চেষ্টা করেছিল?সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েই টিক্কা, কাসুরে আমার জন্য বরাদ্দকৃত সীমান্তে দুইটি স্কয়ার(ব্যরাক) বাতিল করে দেয়।১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে এক ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত বিবৃতিতে টিক্কা বলেছিলেন, “আমরা লে. জে. এ এ কে নিয়াজির বিরূদ্ধে এমনকি কোনো সম্ভাব্য উপাদান খুঁজে পাই নি যিনি ভারতীয় কমান্ডার লে. জে. জগোজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্ন-সমর্পন করেছিলেন, কারন তিনি আত্নসমর্পনের জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে থেকে অনুমতি পেয়েছিলেন।কিন্তু আমরা তাকে সেনাবাহিনীতে আর ফিরিয়ে নেই নি এবং সকল স্বাভাবিক সুবিধাদিসহ নির্বাহি আদেশে তাকে অবসর দেওয়া হয়।”
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ঢাকার পতনের জন্য রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এককভাবে দায়ী এবং আপনি শুধু তার নির্দেশ অনুসরন করেছেন?
না। ইয়াহিয়া খান ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটের জন্য আরো কয়েকজন জন ব্যক্তিবর্গ সমানভাবে দায়ী ছিল যাদেরকে রিপোর্টে দায়ী করা হয় নি।কমিশন কিছু ব্যক্তি বা ফ্যাক্টর সম্পর্কে প্রকৃত সত্যের জট খুলতে পারে নি, যা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনকে শক্তি যুগিয়েছে এবং যা জিন্নাহর অখন্ড পাকিস্তানের চূড়ান্ত ভাঙনের কারন।
রিপোর্টটিতে উপসংহার টানা হয়েছে এই বলে, আত্ন-সমর্পনের জন্য কোনো নির্দেশ ছিল না।যদিও আপনার অঙ্কিত (ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার হয়ে) “আপনার দৃষ্টিতে নিদারুণ হতাশার বেপরোয়া চিত্রে”, উর্ধতন কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র তখনই আপনাকে আত্নসমর্পন করার অনুমতি দিয়েছিলেন, যদি প্রয়োজন হয়।রিপোর্ট বলছে, আপনি সেই নির্দেশ অমান্য করতে পারতেন, যদি আপনি মনে করতেন আপনি ঢাকাকে রক্ষা করতে পারবেন।
আমি শপথ করে বলতে পারি, ইয়াহিয়ার কাছে থেকে আমাকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আত্ন-সমর্পনের জন্য, কিন্তু আমি তখনও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম।এমনকি আমি সংবাদও পাঠিয়েছিলাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাই।তথাপি, জেনারেল আব্দুল হামিদ খান এবং এয়ার চীফ মার্শাল রহিম আমাকে টেলিফোন করে নির্দেশ দেন, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ জেনারেল হেড কোয়্যাটার(JHQ) থেকে যে সংকেত(Signal) এসেছে, সেই অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করি, কারন পশ্চিম পাকিস্তান তখন বিপদাপন্ন ছিল।এই সময় আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় অস্ত্র-বিরতিতে রাজী হওয়ার জন্য, যেন সৈন্যদলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
কমিশন প্রমান পেয়েছে, আপনার সৈন্যদল পূর্ব পাকিস্তানে লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত ছিল, এই ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ড হাতে নেওয়ার পর পরই আমার কাছে সৈন্যদল সম্পর্কে অসংখ্য রিপোর্ট আসতে শুরু করে, এরা বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে অকারনেই লুট, অগ্নিসংযোগ, হত্যায় জড়িত হয়ে পরছে, যা আমার কাছে পরিষ্কারভাবে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম বলে মনে হয়েছে।পরিস্থিতির গভীরতা অনুভব করে, ১৫ এপ্রিল ১৯৭১ সালে চিঠির মাধ্যমে আমার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করি, যে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা উল্লেখ করি।আমি পরিষ্কারভাবে লিখে জানাই, অনেকগুলো ধর্ষনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানিরাও এ কর্মকান্ড থেকে মুক্ত নন।আমি আমার উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাই, অফিসাররাও এই ধরনের ঘৃণ্যকাজে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তথাপি, বার বার সতর্কবানী ও নির্দেশনা সত্ত্বেও, স্ব স্ব কমান্ডারগন এই বিশৃঙ্খল অবস্থার লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হন। এই প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সৈন্যদলের যুদ্ধ করার দক্ষতাকে হ্রাস করে দেয়।
একজন মিলিটারি কমান্ডার হিসেবে আপনার ব্যর্থতাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই অপমানজনক আত্ন-সমর্পনের দায়-দায়িত্ব আপনি কি নেবেন?
আমাদের ৪৫,০০০ ট্রুপ্(সৈন্যদল) লড়েছিল ভারতের আধা মিলিয়ন ট্রুপ, লাখ লাখ মুক্তি মুক্তিবাহিনী (বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা যারা ভারতের সমর্থনপুষ্ট ছিল) এবং সর্বপরি বৈরী এক বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে।প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য আমাদের প্রায় ৩০০,০০০ ট্রুপের প্র্য়োজন ছিল।তখন আমরা ইতঃপূর্বে মূল ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন হয়ে পড়েছিলাম, তারপরেও বিরতিহীনভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
যদি হামূদ মনে করে থাকেন আমরা বন-ভোজনে গিয়েছিলাম, তাঁর আমাদের সাথে যোগ দেওয়া উচিত ছিল।আমি স্পষ্ট বলতে চাই, পূর্ব পাকিস্তানে আমার অধীনস্ত সেনাবাহিনী সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে।প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল এক অদম্য ক্ষমতার লড়াই যা ১৯৭১ সালে এই সঙ্কট তৈরী করেছিল, বিশেষকরে যখন বন্দুকের নল ক্ষমতা হস্তান্তরের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
১৯৭১ সালের এই সঙ্কট ছিল ইয়াহিয়া, মুজিব (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা, শেখ মুজিবুর রহমান) এবং ভুট্টোর (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, জুলফিকার আলী ভুট্টো) মধ্যে চলা অদম্য ক্ষমতার লড়াইয়ের ফল।ইয়াহিয়া চেয়েছিল ক্ষমতা ধরে রাখতে আর ভুট্টো চেয়েছিল ক্ষমতায় বসতে।শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ স্পষ্ট বিজয় অর্জন করেছিল, সরকারের উচিত ছিল তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।ভুট্টোর অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা বাগাড়ম্ভর ছাড়া কিছুই ছিল না, তিনি যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।যদি মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হত, তবে পাকিস্তান অখন্ড থাকত।এটা খুব দুঃখজনক, কমিশন ভুট্টোকে সব ধরনের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
১৯৭১ সালের সঙ্কটের জন্য দায়ী জেনারেলদের জন-সম্মুখে বিচারের জন্য কমিশন সুপারিশ করেছিল।জেনারেল টিক্কা , সাহিবজাদা ইয়াকূব আলী খান(ইস্টার্ন কমান্ডের সাবেক কমান্ডার) এবং রাও ফরমান আলীকে(নিয়াজির উপদেষ্টা) অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তারা কি নিরপরাধ ছিল?
কমিশনের রিপোর্টে এভাবে এই তিন জনকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টিতে আমি একমত হতে পারছি না।এটা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যপার, পাকিস্তান ভাঙার জন্য টিক্কা, ইয়াকূব এবং ফরমানকে দায়ী করা হয় নি।প্রকৃতপক্ষে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে ইয়াকূবের নিষ্ক্রিয়তাই পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তুলেছিল।ইয়াকূব প্রত্যকটি ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা তৈরী করে তাঁর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে পালিয়েছিলেন, অথচ তাঁর এই নীতি বিবর্জিত কাজগুলোকে গোপন করা হয়েছে।জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো উচিত।ইয়াহিয়া তাঁর পদ-মর্যাদা অবনমন করেছিলেন।পরবর্তীতে ভুট্টো তার পদ-মর্যাদা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত করেন।সেনাবাহিনীর দায়িত্ব থেকে পলায়নের জন্য কী বড় পুরস্কার!
হামূদুর কমিশন তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন, এভাবেই যারা শ্ত্রুর সাথে লড়াই করার পরিবর্তে পালিয়েছিল, পদত্যাগ করেছিল, যাদের কারনে পরিস্থিতি আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল, তাদেরকেই পুরস্কিত করা হয়।একইভাবে, এই রিপোর্টে টিক্কার নাম উল্লেখ করা হয় নি, যদিও ২৫ মার্চে তাঁর বর্বরচিত ভুমিকার জন্য তাঁকে কসাই নামে ডাকা হত।কমিশন তাঁর হায়েনার মত বর্বরচিত অপরাধগুলোকে এড়িয়ে গেছে।
রাও ফরমান আলীও দায়ী, তিনি ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন।
ভুট্টো সরকার হামূদুর রিপোর্টকে কেন জন-সম্মুখে প্রকাশ করে নি?
ভুট্টো রিপোর্টটি প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছিলেন, কারন পাকিস্তান ভাঙার জন্য তিনিও সমানভাবে দায়ী ছিলেন।ভুট্টোর সমর্থনপুষ্ট সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি এই রিপোর্টটি পরীক্ষা নিরিক্ষা করে দেখে রিপোর্টটিকে জন-সম্মুখে প্রকাশ না করতে সুপারিশ করেছিলেন।পরবর্তীতে ভুট্টো ক্ষমতার অপ-ব্যবহার করে এটিকে ইচ্ছেমত পরিবর্তন করে ৩৪ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টে পরিনত করেন।
আপনি জোর দিয়ে বলছেন হামূদুর রিপোর্ট ত্রুটিপূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট এবং ভুট্টো কর্তৃক প্রভাবান্বিত।অপর দিকে, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন তাঁরা কেউই ঢাকা সঙ্কটের জন্য দায়ী জেনারেলদের কোর্ট-মার্শাল চান বলে মন হয় না।এই ক্ষেত্রে, আপনি কি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য দৃঢ় কোনো প্রস্তাবনা দিতে পারেন?
১৯৭১ সালের সঙ্কটের প্রকৃত কারন খুঁজে বের করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে, এজন্য অধিক ক্ষমতাসম্পূর্ণ একটি নতুন কমিশনের নিয়োগ প্রদান করা প্রয়োজন।এই তদন্তটি সেনাবাহিনী প্রধানের সভাপতিত্বে হওয়া উচিত। দুটি সিন্ডিকেট এক সাথে কাজ করবে।
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা তদন্ত কাজ হবে, এতে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য বের হয়ে আসবে। একটি সামরিক তদন্ত হওয়া উচিত প্রকৃত সত্য খুঁজে বের করার জন্য, কিভাবে এবং কেন একটি ছোট, ক্লান্ত ও দুর্বলভাবে সজ্জিত ইস্টার্ন গ্যারিসনকে (ইস্টার্ন কমান্ড) তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়েছিল সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে এবং পশ্চিম গ্যারিসন যারা পর্যাপ্ত সৈন্য ও রসদ নিয়েও কেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারল না, যার কারনে যুদ্ধে পরাজীত হতে হয়েছিল এবং মাত্র দশ দিনেরও কম সময়ে দেশের ৫৫,০০০ বর্গমাইল ভূমি হারাতে হয়েছিল।
১৯৭৪ সালে ভারতীয় বন্দীদশা থেকে পাকিস্তানে ফেরার পর, পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট বিষয়ে যখন আমি রিপোর্ট প্রস্তুত করছিলাম, জেনারেল হেড কোয়্যাটার(GHQ) এর সূত্র থেকে স্পষ্ট একটি ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম পূর্ব কমান্ডকে একটি বিস্তৃত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল; এবং এর সিনিয়র কমান্ডারদের পূর্ব পাকিস্তান হারানোর জন্য দায়ী করে বলীর পাঁঠা বানানো হয়েছিল।আমার প্রাথমিক সন্দেহ কয়েক বছরের মধ্যেই দৃঢ় প্রত্যয়ে পরিনত হয়, আমি এই অধ্যায়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি, বহু লোকের সাথে আলোচনা করেছি যারা জানতো কিভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে জেনারেল হেড কোয়্যাটার(GHQ), হাই কমান্ডের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পূর্ব কমান্ডের সাথে প্রতারনা করেছিল, কুট-কৌশলের আশ্রয় নিয়ে পূর্ব কমান্ডকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে এটা এতই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ভারতীয় মেজর জেনারেল শাহ বেগ সিং আমাকে বলেছিলেন, “আপনার আশা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে, স্যার।তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই অধ্যায়ের জন্য আপনি ও আপনার কমান্ডকে দায়ী করা হবে।” এর ফলে আমি নিশ্চিত হলাম, পূর্ব পাকিস্তানের ভাঙন ছিল স্পষ্টতই একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ।
পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরী করা হয়েছিল, এই যুক্তির স্বপক্ষে আপনি কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন?
মুজিবের ১৯৭০ সালের বিজয়কে ইয়াহিয়া ও ভুট্টো তিক্তভাবে নিয়েছিল, কারন এর ফলে ইয়াহিয়াকে রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে হত এবং ভুট্টোকে অপজিশন বেঞ্চে বসতে হত, যা ছিল তাদের উচ্চাকাঙ্খার পরিপন্থী।তাই এই দুইজন একত্রে ভুট্টোর নিজের শহর লারকানায় বসে একটি পরিকল্পনা আঁটে, যা পরবর্তীতে লারকানা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিতি পেয়েছিল।ন্যাশনাল অ্যাসেম্বেলির অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা, আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথকে কূটনৈতিকভাবে রুদ্ধ করা, ভীতি-প্রদর্শন করা, চক্রান্ত ও সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা ছিল এই পরিকল্পনার অংশ।
এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছিল ‘এম এম আহমেদ প্ল্যান’, ইয়াহিয়াকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে বহাল রাখা ও ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী করা ছিল যার লক্ষ্য, এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানকে কোনো উত্তরসূরি সরকার ছাড়াই ত্যাগ করা।অ্যাসেম্বেলি অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা পর (যা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল) এটা বয়কট করার জন্য রাজনীতিবিদদের উপর চাপ ছিল।এর কারন দেখানো হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে, তাই এটি বাতিল করা উচিত।
শেষ পর্যন্ত, চক্রান্তকারী এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছিল।
আপনি কি মনে করেন না, এখন সময় এসেছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার মত-পার্থক্যগুলো দূর করা এবং জন-সাধারনের মঙ্গলের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ সংলাপের আয়োজন করা?
আমাদের কখনই ভারতকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।একটি শক্তিশালী পাকিস্তানের ধারনা কোনো ভারতীয় সরকার কখনই মেনে নিতে পারে নি এবং তারা সব সময় আমাদের দেশটাকে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে।পূর্ববর্তী নজির থেকে দেখা যায়, ভারত সব সময়ই পাকিস্তানের ক্ষতি করেছে।ভবিষ্যত্বে যদি তারা আবার কখনও সুযোগ পায়, পাকিস্তানের ক্ষতি করা থেকে কখনই নিবৃত হবে না।এমনকি বর্তমানে ভারত কাশ্মিরে হাজার হাজার ট্রুপ রেখেছে, জঙ্গী দমনের নামে নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করছে।
এমনকি পাকিস্তান কোনোভাবেই ভারতের সাথে শান্তিপূর্ন সংলাপে বসতে পারে না, যদি না ভারত লিখিতভাবে এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, কাশ্মির বিরোধটি তারা “জাতিসংঘ রেজুলেশন” এর মাধ্যমে সমাধান করবে।
যদি সুযোগ আসে, কাশ্মির বিরোধের শান্তিপূর্ন সমাধানের জন্য নেওয়া বর্তমান এই কূটনৈতিক উদ্যোগে আপনি কি কোনো ভূমিকা রাখবেন?
না। আমি কখনই ভারতের সাথে এটা চাইবো না।আমি এখন খুবই বৃদ্ধ, যুদ্ধ করার মত অবস্থা নেই, তবুও জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ড দিতে এখনো প্রস্তুত আছি।