শৈশবকে আমার কাছে এখন জীবনের স্বর্ণসময় মনে হয়। বিশেষ করে আমার মেয়েটাকে যখন দেখি ও ওর ইচ্ছামত সব করছে, কোন চিন্তা নেই টেনশন নেই। মনের আনন্দে সারাদিন খেলছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি মজার জীবন! মনে হয় আবার যদি ঐ বয়সে ফিরে যাওয়া যেত।
ব্লগার সুফিয়া আপুর পোস্ট দেখেছিলাম শৈশবের ঈদ নিয়ে লেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। সময় স্বল্পতায় লেখা হয়ে উঠেনি। আজ যতটুকু মনে পড়ছে তাই শেয়ার করছি সবার সাথে।
রোজার ঈদ সাধারণত আমরা ঢাকায় করতাম। ঢাকায় আমাদের আত্মীয় স্বজন বলতে কেউই ছিলনা, সবাই দেশের বাড়ীতে থাকে। ছোটবেলায় একটা আফসোস খুব কাজ করত মনে। আমার সমবয়সী অনেককে দেখতাম কেউ তার মামা বা খালা বা চাচা ফুফুদের কাছ থেকে গিফট পাচ্ছে। আমার আম্মু আব্বু দুজনই ভাই বোনদের মধ্যে বড় ছিল বলে আম্মু আব্বুকে দেখতাম সবার জন্য কিছু না কিছু কিনছে। আমাদের কেউ কিছু গিফট করতনা । এজন্য মন খারাপ হত বলে আম্মু চেষ্টা করতো অল্প টাকায় হলেও দুটো বা তিনটা জামা কিনে দিতে। তাতেই আফসোস দূর হত অনেক।
ঈদের দিন পর্যন্ত জামা কাপড় জুতা লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তো মনে হয় অনেকেরই ছিল। কেউ যেন সাধের ঈদের জামা জুতো দেখতে না পারে তার জন্য কোথায় কোথায় না লুকোতাম জামা কাপড়।
চাঁদ রাতে আমার জন্য খুব মজার একটা ব্যাপার ছিল মার্কেটে যাওয়া। টিভিতে মাগরিবের নামাজের পর যখন ঘোষণা দিতো যে আগামীকাল ঈদ তখন আমাদের দুই ভাই বোনের লাফালাফি শুরু হয়ে যেতো। আর এরপরেই যখন “ওমন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ” এই গান শুরু হত তখনতো মনে হত আমাদের হৃদয়ের সাথে সাথে আমাদের রক্তকণিকাগুলোও যেন সব লম্ফঝম্ফ দেয়া শুরু করতো। গান শেষ হলেই মার্কেটে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে যেতো। বাসার কাছেই তালতলা মার্কেট ছিল বলেই খুব সহজেই যখন খুশী তখন যেতে পারতাম। মার্কেটে হয়ত কেনার কিছুই বাকী থাকতোনা তবুও যেতে এতো ভালো লাগতো! আর ভালো লাগতো মানুষের চোখে মুখে আনন্দ দেখতে। অযথাই ঘণ্টাখানেক ঘুরাঘুরি করে হয়তো কিছু কাচা ফুল বা ঘর সাজানোর জন্য কিছু কিনে বাসায় চলে আসতাম। বাসায় এসে যতটুকু পারতাম আম্মুকে সাহায্য করতে চেষ্টা করতাম। বেশী কিছু না পারলে সোফার কাভার চেঞ্জ করতাম আর বসার ঘরটাকে কিভাবে সাজালে একটু দেখতে বেশী ভালো লাগবে সে চেষ্টা করতাম। তারপর মনের আনন্দে ঘুম।
ঈদের সকালে ভাইয়া আব্বু নামাজে চলে গেলে সব বিছানার চাদর পাল্টে দিতাম। তারপর বসার ঘর সুন্দর করতে ফিনিশিং টাচ দিতাম। যতক্ষণ নিজে সাজুগুজু করে বের না হতাম বাসা থেকে ততক্ষণ চলতো কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারান্দায় এসে মাঝে মাঝে দেখা যে কে কে বের হচ্ছে বাইরে কে কিভাবে সাজল কেমন জামা পরলো। কি ছিল সেইসব দিন! অন্যের সাজুগুজু দেখার মধ্যেও কি অনাবিল আনন্দ কাজ করত মনে।
ছোট থাকতে আমার একটা অভ্যাস ছিল প্রতি ঈদে জামার সাথে একটা ছোট ব্যাগ কিনতাম, উদ্দেশ্য ছিল সেই ব্যাগে সালামি জমানো। এসব এখন মনে পড়লে লজ্জা পায়। যাদের বাসায়ই যেতাম আন্টি বা আংকেল স্থানীয়দের সালাম দিতাম দলবল সহ। আর সালাম করে অপেক্ষা করতাম কখন সালামী দিবে ঘুরাঘুরি শেষে হিসাব চলতো কার কত সালামী জমা হয়েছে। ছোটবেলায় খুব বোকা ছিলাম আমি। ভাইয়া প্রায়ই ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার জমানো টাকা সব নিয়ে যেতো আর আমি আমার টাকা দিয়ে কিছুই করতে পারতাম্না। এভাবে ঘুরাঘুরি করে এলাকার মধ্যেই সমবয়সী যারা ছিল তাদের বাসায় বাসায় গিয়ে আড্ডা মারা সেমাই বা অন্য খাবার খাওয়া এভাবেই কেটে যেতো ঈদের দিন। আর সন্ধ্যায় হয়তো আম্মুর সাথে বের হয়ে আবার চলতো আরেক প্রস্থ ঘুরাঘুরি।
কোরবানীর ঈদে গ্রামের বাড়ী যেতাম। তাই কোরবানির ঈদে মজা হত বেশী। সেই স্মৃতিই বেশী মনে পড়ে। তখন গ্রামে যাওয়াটা এতো ঝামেলা মনে হতনা কেন যেন, মনে হয় অনেক আনন্দে থাকতাম আর তখন তো নিশ্চিন্ত জীবন আমাদের। ট্রেনে যেতাম সব সময়। সকালে ট্রেনে উঠতাম ৭ টায় আর নোয়াখালী পৌঁছে যেতাম ১টা ৩০ এর মধ্যেই। পুরো যাত্রা পথে কোন ক্লান্তি কাজ করতনা। মজা করে দুই ভাই বোন ট্রেনে ঘুরে বেড়াতাম কিছু সময় আবার কিছু সময় জানালার পাশে বসে আশেপাশের সব দৃশ্যের পেছন দিকে ছুটে চলা দেখতাম। আর ষ্টেশনে ষ্টেশনে ট্রেন থামলে এটা সেটা খাওয়া দাওয়াতো চলতই। এভাবেই সময়টা ফুরিয়ে যেতো। আর গ্রামে গিয়ে আরও মজা হত। নানা নানী দাদা দাদী সবার আদর আমরা পেয়েছি অনেক দিন বড় ছেলেমেয়েদের সন্তান ছিলাম বলে। যে বাড়িতেই যেতাম সেখানেই একটা উৎসব উৎসব আমেজ থাকতো সব সময়। আমাদের বাড়ী যাওয়ার খবর পেয়ে খালারা ফুফুরা চলে আসতো বাড়ীতে। বাড়ী ভর্তি মানুষজনে সারা দিন চলত আড্ডা দেয়া আর মজা করা।
সেসব ঈদ অনেক মিস করি এখন। আমার সন্তানকে তেমন ঈদ দেখাতে পারিনা বলেও আফসোস হয়। এতো সহজ সরল ভাবেও যে জীবনকে অনেক আনন্দপূর্ণ করা যায় এমন বাস্তবিক শিক্ষা এই প্রজন্ম কখনোই পাবেনা মনে হয়।
সবার ঈদ আনন্দে কাটুক এই দোয়া করি। ঈদের আগাম শুভেচ্ছা রইলো।