পিছন ফিরে দেখা
বিশ্বে ব্যাংক ব্যবসা প্রসার লাভ করেছিল যীশু খ্রীষ্টের জন্মের আগে গ্রীসে উপসানলয়ে। নিরপত্তার কারণেই উপসানলয়গুলো ছিল ব্যবসা বানিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। পরবর্তীতে ইতালীর লোম্বার্ডি নামের এক জায়গায় ইহুদি মহাজনরা বাজারে বেঞ্চে বসে অর্থের লেনদেন শুরু করে। এই বেঞ্চ বা ’ব্যাংকো’ শব্দ হতেই ব্যাংক শব্দের উৎপত্তি। তবে সেই ব্যাংক ব্যবসা কিন্তু এখনকার মত ছিল না। তারা স্বর্ণ, রৌপ্য, অন্যান্য অলংকার, মূল্যবান জিনিষপত্র ও অর্থ নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণ করত। অনেক সময় তারা টাকা পয়সা ধারও দিত। আমাদের এখানেও ব্যাংকিং ব্যবসা এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল।
বাঙ্গালী বাংক-ব্যবসায়ীদের পূর্ব পুরুষ হচ্ছে সুবর্ণ বণিকরা। মূলত সোনার ব্যবসায়ীদেরই সুবর্ণ বণিক বলা হতো। ব্যাংক ব্যবসার ক্ষেত্রে তারা কেবল বেঞ্চ নিয়েই বসে থাকত না বরং তারা সাংগঠনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সে সময় এই বণিকরাই ছিল সবচেয়ে ঐশ্বর্য ও প্রভাবশালী। তবে সমাজের উচ্চ বর্ণরা তাদের এই প্রভাব মেনে নিতে একেবারেই ইচ্ছুক ছিল না। এ কারণে দ্বন্দ্ব ছিলই। তা সত্বেও তাদের এই প্রভাব মধ্যযুগ পর্যন্ত বজায় ছিল। এর পরেই প্রভাব প্রতিপত্তি কমতে থাকে ব্যাংক ব্যবসায় অবাঙালীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। কথিত আছে বাংলার শাসক বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯) যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুবর্ণ বণিকদের কাছে টাকা ধার চেয়েও পাননি। ক্ষুব্ধ বল্লাল সেন সমাজ কাঠামোকে এই ব্যবসায়ীদের সমাজের নীচু পদ মর্যাদা দেন। তারা এ অবস্থা মেনে নিতে পারেনি। এ সময় থেকে তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকেও বঞ্চিত হয়। নানা ভাবে সামাজিক প্রতিরোধের মধ্যেও পড়ে যায়। ফলে তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে নিজেদের রা করতেই বেশী মনযোগ দেয়। এ পর্যায়ে তারা ব্যাংক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হারায়। তারপরেও ব্যাংক ব্যবসায় সুবর্ণ বণিকদের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই চলে যেতে দু’তিন শতাব্দী লেগে যায়।
হিরানন্দ সাহু মাড়োয়ার অঞ্চল থেকে পাটনায় এসেছিলেন ১৬৫২ সালে। তিনি সেখানে ব্যাংক ব্যবসা শুর করেন। তিনিই প্রথম ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের ঋণ দেয়া শুরু করেছিলেন। এভাবেই ইংরেজদের সাথেও তিনি পরিচিতি লাভ করেন। হিরানন্দের সাত ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মানিক চাঁদ ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় আসেন ও বাংক ব্যবসা শুরু করেন। মুর্শিদকুলি খাঁ তার প্রশাসনিক কেন্দ্র ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করলে মানিক চাঁদ মুর্শিদাবাদেও ব্যাংক ব্যবসার কুঠি স্থাপন করেন। এখানেও তার ব্যবসা জমে উঠে। তার ব্যবসা পাটনা, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ ছাড়াও হুগলী, বেনারস ও কলকাতায়ও প্রসার লাভ করে। এই পরিবার ছিল সেসময়ে ব্যাংক ব্যবসার অপ্রদ্বিন্দ্বী। ১৭১৪ সালে মানিক চাদেঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার হন ফতেহ চাঁদ। তিনি ১৭২২ সালে জগৎ শেঠ উপাধি লাভ করেন। এর আগেই অবশ্য তিনি ১৭১৭ সালে মুর্শিদাবাদের নওয়াবের টাকঁশালের ভার পান। সে সময় জগৎ শেঠ পরিবার ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও ঐশ্বর্যশালী, এমনকি ইউরোপের ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও। তাদের এই প্রভাব বজায় থাকে পলাশী যুদ্ধ পর্যন্ত। এর পর থেকেই তাদের অবস্থা নীচে নামতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তাদের ব্যবসা মূলত হুন্ডি ও সুদ ব্যবসায় সীমিত হয়ে পড়ে।
জগৎ শেঠ ষড়যন্ত্র করে যে ইংরেজদের এনেছিলেন, তাদের কারনেই তার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। মূলত ইউরোপীয় ব্যাংকাররা এ দেশে আসতে শুরু করলে তাদের হাতেই ব্যাংক ব্যবসা চলে যায়। ব্যাংক ব্যবসা মুর্শিদাবাদ থেকে চলে যায় কলকাতায়। এ সময় ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের কারণে সর্বত্র ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং-এর ব্যাপক প্রসার লাভ করতে শুরু করে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ব্যাংক অব সুইডেন (১৬৫৮-১৬৬৮), ব্যাংক অব ফ্রান্স (১৭১৪-২০) এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (১৮৯৪)। কলকাতায়ও প্রতিষ্ঠিত হতে তাকে অনেক মার্কেন্টাইল ও এজেন্সী হাউজ। এগুলোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে ইংরেজরা ছাড়াও ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা। তবে ১৮১৩ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একচেটিয়া বানিজ্যের অধিকার হারানোর পর এই হাউজগুলো আর টিকে থাকতে পারেনি। দেখা গেছে ১৭৭০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে কলকাতাতেই ১১টি ব্যাংক এবং ১৮৪৬ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে লন্ডনের ৯টি ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছবি: বাংলাদেশের প্রথম ৫ টাকার নোট।