২৭ শে আগস্ট ২০১১ এর রাত লায়লাতুল কদরের রাত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। এদেশের আনুমানিক ৩০% মানুষ অশিক্ষিত, ৩০% অর্ধ শিক্ষিত ও বাকী ৪০% শিক্ষিত। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এদেশের ৯০% মানুষ নিজে না পড়ে না বুঝে অন্যকে অনুসরণ করে ধর্ম পালন ও রাজনীতি করে। যা একটি রাষ্ট্রকে কুপমন্ডকতার দিকে ঠেলে দিতে যথেষ্ট।
ধর্ম একটি সামাজিক জীবন দর্শন। ধর্মীয় গ্রনহ একটি সামাজিক জীবন বিধান। মুসলিমদের সেই বিধানটি লেখা হয়েছিল ১২৬০ বছর আগে। ধার্মিকেরা দাবি করে লায়লাতুল কদরের রাতে এটি অবতীর্ণ হয় পৃথিবীতে। সে যাই হোক, আমি বলতে চাই এই বই ১২৬০ বছর আগে যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে লেখা এত বছর পর ও এতদুর ভৌগলিক অবস্হানে একইভাবে কি সেটা কার্যকর থাকতে পারে?
আমরা ৯০% ধর্ম প্রাণ মানুষ মূল ধারার নিজ ভাষায় রুপান্তরিত ধর্মীয় বইয়ের সুক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করে ধর্ম পালন করলে একেকটা মানুষ সমৃদ্ধ মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠতাম, হয়ে উঠতাম চিন্তায়, শিক্ষায়, আচার-আচরণে এক সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী। ধর্ম ব্যাক্তি আত্মাকে সমৃদ্ধ করে। উন্নত আত্মা ন্যায়-অন্যায় কে সনাক্ত করতে পারে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্হান নেয়।
একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে, তেমনি ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষও থাকে সেখানে। তাই একটি দেশ যদি একগোষ্টির ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে পরিচালিত হয় তাহলে অন্য গোষ্টি বঞ্চিত হয় অনেক নাগরিক ও মানবিক অধিকার থেকে। সভ্যতার পরিক্রমায় পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র এবং প্রত্যেক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আছে বিভিন্ন পরিচালনা পদ্ধতি। রাষ্ট্রকে ধর্মীয় দৃষ্টিভংগি দিয়ে পরিচালনা করা ঠিক হবে না। কারণ একটু আগেই বলেছি (যে একই রাষ্ট্রে অনেক ধর্মের মানুষের বাস)। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে। যে দৃষ্টিভঙ্গিতে সকলে তার যোগ্যতা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় জীবন-যাপন করবে।
আমার চারপাশে দেখি মানুষের ধর্ম পালনের জন্য অনেক ব্যস্ততা। ব্যস্ততাগুলি এমন- ব্যাবসায়ী দুমদাম করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে নামাজ পড়তে যাচ্ছে ফিরে এসে ৫ টাকার দ্রব্য ৫০ টাকায় বিক্রি করছে, আমলারা জবরসস্তির পয়সা যত্নে তালা বন্দি করে এবাদত করতে যাচ্ছে, ধনী দরিদ্র প্রতিবেশীর সম্পদ জব্দ করে আত্মশুদ্ধতার জন্য প্রার্থনা করছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই ধর্মের পাটি থেকে উঠেই অশ্লীলতা করছে, আরাধনা শেষে নারী সজ্জিত হছে উত্তেজক বেশে। ধার্মিক রাজনীতিবিদ ধর্মের ঢাল মাথায় নিয়ে মিথ্যাচার, রাষ্ট্র ও মানুষের সম্পদ লুট করছে। আমার কথা হলো- এই মানুষগুলির মধ্যে ধর্মঙ্গান অল্প কিছু থাকলেওতো তারা এরুপ করতে পারতো না। এই ঙ্গান তাদের নেই। তাহলে তারা মূর্খের মত ছুটছে কেন? কলুষিত করছে কেন একটি প্রয়োজনীয় জীবন বিধান কে? এ অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তথাকথিত মুসলমানেরা আবার অনেক ক্রেজি এব্যাপারে। ধর্মীয় সমালোচনা তারা একটুও সহ্য করতে পারে না । গতানুগতিক জীবনধারার বাইরে তারা একটুও তারা ভাবতে চাই না। এটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই তাদের যে সমালোচনায় আসল গূঢ় তত্ত্ব বের হয়ে আসে।
আমি আসলে উপরোক্ত কথাগুলি লেখার জন্য বসিনি। আমি বলতে চাই এই রাতের কিছু অভিঙ্গতার কথা। ২৭ শে আগস্ট ২০১১ রাত ৯ঃ৪৫ লায়লাতুল কদরের রাত। ঘরে ঘরে ধর্ম পালনের ধুম পড়ে গেছে। কথিত আছে এই রাতে পবিত্র কোরাণ অবতীর্ণ হয়েছে তাই এই রাতে এবাদত করলে অনেক নেকী পাওয়া যাবে যা পরকালে অনেক সুখের পরিবেশ তৈরী করবে। আমার বাড়ীতেও সেই পরিবেশ। আমার মা ঘোষণা দিলেন টিভি বন্ধ করে এবাদত করতে। আমরা এবাদত করি না তাই আমাদের মনে শান্তি নেই। তখন দেশ টিভিতে তারেক মাসুদের উপস্হাপনায় মৌসুমী ভৌমিকের আমার ‘কিছু কথা ছিল’ অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব শুরু হবে। এর আগে দু’টি পর্ব হয়েছে। শেষ পর্বটা দেখার জন্য আমি অনেক উদ্গ্রীব। বাসার পাশে মসজিদে চিতকার শুরু হয়েছে, ঘরে মায়ের শাসন। আমি চুপি চুপি এক ঘরে যেয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে প্রোগ্রামটা দেখছি। দরজা দিয়েছি মায়ের জন্য আর জানালা দিয়েছি মসজিদের শব্দের জন্য। এরকম শব্দ দূষণ আল্লাহও সহ্য করতে পারেন না। যা মানুষের জন্য অকল্যাণকর তা কোন ধর্ম হতে পারে না। অনুষ্ঠানটি শেষ হলো রাত ১১ টায়। শেষ হলো “যশোর রোড” গানটি শোনাতে শোনাতে। অনেকক্ষণ একা একা চুপ করে বসে থাকলাম। কান্না পাচ্ছিল আমার। শুতে গেলাম ঘুম আসে না। মনের মধ্যে আক্ষেপ বাড়ি খাচ্ছে বার বার। ১৫ কোটি মানুষের দেশে ১ লাখ মানুষও কি দেখেছে এই অনুষ্ঠানটি? এদেশে ধর্ম পাগল মানুষ সৃষ্টি হচ্ছে জ্যামিতিক হারে আর ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ কমে যাচ্ছে গানিতিক হারে। ১ সেকুলার মানুষ ১০ সেকুলার মানুষ তৈরী করতে পারছে না কেন? পরকালের আরাম আয়েশের লোভ মানুষের এত যে সামাণ্য নিরপেক্ষ কথা তারা ভাবতেও চায় না। তারা বোঝে না স্বর্গ- নরকের অবস্হান কোথায়, আল্লাহ কি, কোথায় সে থাকে। কবির ভাষায়- ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক / কে বলে তা বহু দূর/ মানুষেরই মাঝে স্বর্গ- নরক/ মানুষেতে সূরাসূর।’ এভাষা তারা বোঝে না। তাদের বেহেস্তের বাহারি আরামের লোভ। এত লোভী মানুষকে কি তাদের তথাকথিত আল্লাহ মাফ করবেন? সাধারণ মানুষ মনে করেন আল্লাহ বাস করেন আসমানে অর্থাত আকাশে বা শূণ্যতায়। তারা একটুও বুঝতে চায় না আল্লাহ সকল মঙ্গলের মধ্যে, সকল সুন্দরের মধ্যে বর্তমান।
এই বিশাল জনগোষ্টির চিন্তায় যদি পরিবর্তন আনা না যায় তাহলে এ সমাজ আরো পিছাবে অবধারিতভাবেই। তাই আমার কান্না পাচ্ছিল তারেক মাসুদের জন্য। তিনি ধর্মান্ধ মানুষকে ধর্মের যুক্তি ব্যাবহার করে তাদেরকে যুক্তিবান মানুষে পরিণত করতে চাচ্ছিলেন। মানুষকে মানুষের পথ দেখাতে চাচ্ছিলেন। পিছনে না সামনের দিকে এগুনোর পথ। তার অস্ত্রও ছিল ভয়াবহ। ভিসুয়াল মিডিয়া। যার মাধ্যমে খুব অল্প সময়ে খুব বেশি পেনিট্রেট করা যায় মানুষের মস্তিষ্কে। যে যুগে মিডিয়া ৯৯% মানুষকে রঙ চং এর ভেল্কি লাগিয়ে বর্তমান ভুলিয়ে মেধা ও মানবিকতা শুণ্য ভবিষ্যতে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে তারেক লাঙ্গলের হাতল টি ধরেছিলেন শক্ত ও যুতসইভাবে কিন্ত ফলা সামাণ্য মাটি ভেদ করে সম্পূর্ণ ভূমি অকর্ষিত রেখে চলে গেলেন খুব তাড়াতাড়ি। এ ক্ষতি কি আমরা পোষাতে পারবো খুব তাড়াতাড়ি? ঋণাত্মক গানিতিক হিসাব কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের সমাজ কে? মৌসুমীর মতই বলতে হয় – কূপমন্ডুকতা ঠেকাও মানুষের দল!
কষ্ট হচ্ছিল মৌসুমির জন্য। একজন প্রকৃত বন্ধু হারালো সে। মৃত্য পর্যন্ত তাকে এ যন্ত্রণা এ অপূর্ণতা বহণ করতে হবে। এ কষ্ট উনি সইবেন কিভাবে? এক স্রষ্টার ধ্বংস, এক সংস্কারকের ধ্বংস। তার পরিপূরক স্রষ্টার ধ্বংসে ধ্বংসস্তপের চাপা ওজন ঠেলে উনি কি বের হয়ে আসতে পারবেন? দাঁড়াতে পারবেন আবার? আবার সৃষ্টি করতে পারবেন দুই বাংলার মানুষের জন্য মমতার সন্তান ‘যশোর রোড’ এর মত কিছু? মুহম্মদ না থাকলে যেমন মুসল্মান জাতির সৃষ্টি হতো না তেমনি তারেক না থাকলে যশোর রোড গানটি তৈরী হতো না। মৌসুমীর ভিতরের সৃষ্টিকে অনুরোধ করে বের করে এনেছেন তারেক। কারণ, উনি হিরা চিনতেন।
যে মানুষ পর্দার অন্তরালে থেকে মানুষের জন্য উদ্দাম ছুটে ঙ্গানগর্ভ কাজ করে যান নিরবধি, যে মানুষ কর্পোরেট বাণিজ্যের শিকারে পরিণত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তার সৃষ্টিকে প্রচার করতে দ্বিধাণ্বিত, যে মানুষ রং মেখে সং সাজার ঘোর বিরোধী, যে মানুষ সাদা-সিদা আটপৌরে বেশে ও মনণে জীবন কাটাতে চান, যে মানুষ তার কাজের মধ্যে ধ্যাণ করেন, যে মানুষ প্রচার বিমুখ, যে মানুষ মানুষের দুর্দশার চিত্রে চোখের মূল্যবান লোনা পানি ঝরান - সে মানুষকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। সেই মানুষটি হলেন মৌসুমী ভৌমিক। এই মানুষ কে আমি খুব বেশী জানি না। এ অনুষ্ঠান থেকেই যতটুকু জানলাম। তবে তার গান শুনি ২০০২ সাল থেকে। খুব আপনার মানুষ মনে হয় তাকে। মনে হয় আমার মনের কথাট উনি পুরোটাই বলে ফেলেছেন। আশ্চর্য হয়ে যাই তার চিন্তার সাথে, তার অনুভূতির সাথে আমার অনুভূতির একাত্মতা দেখে। তাই বলি এত সফিস্টিকেটেড মানুষ কিভাবে সইবেন এমন বন্ধু হারানোর ব্যাথা। এতো শুধু মানুষ হারানোর ব্যথা না এ হলো আগামী দিনের সুন্দরের পথের পথ প্রদর্শক হারানোর জ্বালা। কারণ, মুহম্মদ যেমন সমাজ সংস্কারক তারেক, মৌসুমী ও তাদের অনুগামীরাও এ যুগের সমাজ সংস্কারক, প্রগতিশীল দলের পথ প্রদর্শক।
তবে যাই হোক, মৌসুমী ভৌমিক, ক্যাথরিন মাসুদ ও তাদের সহযোদ্ধাদের শুধু শোক না করে এরকম মনণশীল মানুষ খুঁজে বের করার অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ, এ পথটি আপনারাই চেনেন, জানেন অনেক গুণীজনকে।
আর শ্রদ্ধেয় মৌসুমী ভৌমিকে বলি আপনার সৃষ্টিগুলিকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিন। তা-না হলে সৃষ্টি হবে কি করে নতুন চিন্তাশীল মানুষ, আমাদের মনের মত মানুষ? যে মানুষগুলি চিরায়ত কুসংস্কারের শক্ত দেওয়াল ভাঙ্গবে, আলোর দিশা দেখাবে আমাদের উত্তরসূরীদের।