আমরা বাংলাদেশে বাস করি। বাঙ্গালি কালচার সম্পর্কে আমরা ভালোই জানি। যখন শুনি- ইরান,ইরাক, সৌদি আরব প্রভৃতি মুসলিম দেশে মেয়েরা বাহ্যিক পর্দা না করলে তাকে দোররা মারা হয়, তারা স্বাধীন ও মুক্তভাবে ঘরের বাইরে যেতে পারে না, মনকে মুক্ত ও আলোকিত করতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না ও মনের মত সাথী নির্বাচন করলে সাংঘাতিক সামাজিক নিপীড়ন সহ্য করতে হয়, এমনকি পাথর ছুঁড়ে হত্যাও করা হয়; পক্ষান্তরে পুরুষ সন্তানকে যৌন শিক্ষা দেয় বাবা নিজের হাতে হাতে-কলমে, অবাধ বিচরন তাদের তাদের পরিমন্ডলে- তখন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। আবার যখন আমার প্রিয় স্বদেশে প্রিয় পরিচিত রাস্তায় চলি তখন যৌনলিপ্সু হাতের ছোঁয়া, অসভ্য লোভাতুর চাহনি, অশ্লীল বাক্যবান, নারীর চাল-চলনে বাঁধা-নিষেধ, সামান্য সন্ধ্যায় সভ্রম লুন্ঠনকারীর ভয়, পুরুষ সঙ্গীহীন চলায় দ্বিধা, কর্মস্হলে দমিয়ে রাখা ও সস্তা শ্রম প্রদান, অনেক মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও মেধার মূল্য না দিয়ে তথাকথিত ফিগার-রূপের প্রাধ্যান্য দেওয়া- আমি এবং আমরা কষ্ট পায়।
আমরা হলাম মুক্ত ও স্বাধীন মনের নারী ও পুরুষ, আমরা হলাম মুক্ত বুদ্ধির মানুষ এ পৃথিবীর। যে কোনো অনাচার দেখলে আমাদের মন ব্যাথায় ডুবে যায়, যন্ত্রনায় ছটফট করি কিন্ত প্রতিবাদ করতে পারি না; কারণ আমাদের অনেকের সাহস নেই, অনেকের সাহিত্য লেখার মত মেধা নেই, অনেকের মিছিলে যাওয়ার মত পরিস্হিতি নেই, অনেকের নিজের মত প্রকাশের কোন প্লাটফর্ম নেই। সেই দিক থেকে অগ্রদূত হলেন তসলিমা নাসরিন।
বলিষ্ট, লাজহীন, তেজদীপ্ত লেখা। একেক জনের ভাবনা একেক ভাবে ধাবিত হয়। নিজের সমস্যা থেকে উত্তরনের পদ্ধতিও একেক জনের একেক রকম। তিনি চান কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে। অনুনয়-বিনয়ের তিনি ধার ধারেন না। তাই তার লেখায় দেখি- ‘একটি ছেলে যদি রাস্তার পাশে প্রসাব করতে পারে, একটি মেয়ে কেন পারবে না?’ এ জাতীয় কথা- আসলে উনিও জানেন আমরাও জানি কাজটি সভ্যতা পরিপন্থি ও পরিবেশ অবান্ধব। সেটা উনারও কাম্য না। উনি জাস্ট প্রতিবাদ করেছেন বিষয়টি বন্ধের জন্য। উনি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলায় বিশ্বাসী।
এ সমাজে একজন নারী মলাস্ট্রেট হলে সেই নারী লজ্জা পায়। কেন? সে লজ্জা কি তার, না যে এই অন্যায়ের সাথে জড়িত তার? রাস্তায় দেখি সহযাত্রীর লুচ্চামির প্রতিবাদ করলেই সে উল্টো প্রশ্ন করে আপনার গায়ে কি আমি হাত দিয়েছি? কোথায়? সেই সাথে কিছু উৎসুক মানুষ জমা হয় একটু কথার সুড়ঁসুড়িঁ খেতে। খুব কম মানুষ পাওয়া যায় নির্যাতকের বিরুদ্ধে, কিন্ত খুব অবাক করার কথা হলেও সত্য সবাই তার বাড়িতে নির্যাতিতার সাথে বসবাস করেন।
আমি তসলিমার অনেক সমালোচকের কাছে খুব ভালো মানুষ সেজে জিজ্ঞস করেছি কয়টা বই পড়েছেন তার? বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বোঝা যায় পড়েইনি, অন্যের মুখ থেকে শুনে খুব ক্ষিপ্ত ওই নারীর প্রতি। লিপ্ত নানা অরুচিকর আলাপে তার সম্পর্কে। আমাদের সমাজের সাধারন (তথা কথিত উচচ শিক্ষিতরাও) মানুষ তার সম্পর্কে মুখরোচক টপিক বানাতে মজা পান, যেখানে কি-না তাদের লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল।
এ সমাজ কবে লজ্জা পাবে? কবে তাদের অনৈতিক কাজের জন্য গর্ব না দুঃখ করবে? আমি কথা দিচ্ছি সমালোচক বন্ধুরা আপনারা আপনাদের লোভাতুর মন, মুখ, হাত ও চাহুনি সংযত করুন, কথা দিচ্ছি- উনি আর আপনাদের বিব্রত করে কিছু লিখবেন না। তারও দেশান্তরি হয়ে থাকতে ভালো লাগে না। সাধারন মানুষের দুর্দশার সাথী হয়ে এদেশের আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত হতে তারও মন সরে না। একটু ভেবে দেখুন সে সংগ্রাম করছে আপনার মা, বোন, বৌ ও প্রানপ্রিয় কণ্যার জন্য; আপনার অন্যায় স্পৃহায় ছাই দিয়ে। খুব কি সে খারাপ মানুষ? না, আমাদের সকলের বন্ধু?
আর ধর্মের কথা যদি বলেন তাহলে বলবো উনি তথাকথিত ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে। পর্দা বোলতে আপামস্তক আবৃত নয় অসুন্দর চিন্তায় পর্দা দেওয়া। সংযম মানে ত্রিশদিন অভুক্ত থাকা না সবগুলি ইন্দ্রিয়ের সংযমী হওয়ার অভিপ্রায়। কোরবানি অর্থ একইদিনে লক্ষ লক্ষ প্রানী হত্যা নয় বরং প্রিয় অস্তিত্ব ত্যাগের মাধ্যমে মানুষের ভিতরের পশুত্বকে হত্যা করার সংকল্প করা।
ধার্মিক বন্ধুরা হয়তো খুব ক্ষেপে বলবেন মোদ্দা কথাগুলির সবই তারা মানেন। তাহলে কিছু কথা থেকে যায়। বাংলাদেশে ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে ১০ কোটি মুসলমান। ইসলাম ধর্মের মোদ্দা কথা হলো শান্তি ও সততা। তাহলে এত বিশাল শান্তি প্রিয় জনগোষ্টীর দেশে অর্থনৈতিক অসমতা কেন? ক্ষুধার্ত শিশু ডাষ্টবিনের খাবার খায় কেন? এদেশের নারীরা শঙ্কাহীন পথ চলতে পারে না কেন? ভিন্ন মত ও পথ অসহিষ্ণু কেন? কর্মক্ষেত্রে আকাশসম মুনাফার অসততা কেন? চারিদিকে এত অস্হির সমাচার কেন?