এম্বিগ্রাম হলো এমন এক পদ্ধতিতে কোন শব্দ, শব্দাংশ লেখা বা আকা যাতে লেখাটাকে 180 ডিগ্রী ঘুরালেও একই থাকে। মানে দুইদিক থেকে পড়া যায়। এই দ্বিমুখীতাই এম্বিগ্রামকে অনন্য করে তুলেছে। সাধারন কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
গনিতের '+' চিহ্ন, জার্মান নাজিদের স্বস্তিকা এইগুলোও একধরনের এম্বিগ্রাম।
প্রথম দিকের কথা
সর্বপ্রথম নন-ন্যাচারাল এম্বিগ্রামের কথা জানা যায় ১৮৩৯ সালে শিল্পী পিটার নিউওয়েল কৃত, মার্ক টোয়েন এবং লুইস ক্যারলের শিশুতোষ বইয়ের ইলাস্ট্রেশন থেকে। ১৯০৮ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বৃটিশ মাসিক পত্রিকা ‘দ্য স্ট্র্যান্ড’ এর কিউরিসিটি কলামে এম্বিগ্রামের একটা সিরিজ প্রকাশ করে কয়েকজন লোক দ্বারা কৃত যারা বিশ্বাস করত , এম্বিগ্রামগুলো হল এই বিশেষ কিছু শব্দের বিরল বৈশিষ্ট্য। মিচেল টি লেভিন, যার chump শব্দটা জুন মাসে ছাপা হয়েছিল, তিনি লিখেছিলেন, “আমি মনে করি ইংরেজি ভাষায় এটিই একমাত্র শব্দ যার এরকম বিশেষত্ব আছে (নিজের প্রতি ব্যাপক কনফিডেন্স ছিল বোধহয় লোকটার)”। ক্লারেন্স উইলিয়াম তার bet এম্বিগ্রাম সম্পর্কে বলেছেন, “সম্ভবত ইংরেজী বর্নমালায় B ই একমাত্র অক্ষর যার এমন চিত্তাকর্ষক ব্যতিক্রমী বিশেষত্ব আছে ( তাও ভাল তিনি তার বাক্যের ভিতর ‘সম্ভবত’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন)”।
১৯৬৯ সালে রেমন্ড লোয়ি আবর্তনশীল NEW MAN এম্বিগ্রাম লোগো নকশা করেন, যা আজ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। রবার্ট প্যাট্রিক ১৯৭৬ সালে angel লোগো ডিজাইন করেন যা প্রথমদিকে বেশ উতসাহব্যঞ্জক নকশা হিসেবে কাজ করে।
জন ল্যাংডন এবং স্কট কিম বিশ্বাস করেন তারাই ১৯৭০ সালের দিকে এম্বিগ্রাম আবিষ্কার (invention) করেছেন। এই দুই ব্যক্তিই এম্বিগ্রাম জনপ্রিয় করার পিছনে বড় ভুমিকা পালন করেন। ল্যাংডন তার এম্বিগ্রাম আবিষ্কার সম্পর্কে বলেন, “একরাতে এক বোতল ঠাণ্ডা বীয়ার খেয়ে একটা নতুন প্যাড আর একটা নতুন পেন্সিল এনং এক প্যাকেট মার্লবোরো নিয়ে বসে প্রিয় অর্কেস্ট্রা শুনছিলাম, পরিবেশটা আমাকে আমার প্যাডে heaven শব্দটা লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। লেখাটা এতই প্রতিসম হয়েছিল যে আমি বুঝতে পারি এটা এমনভাবে লিখতে পারব যাতে করে সেটা দুইদিক থেকেই একইরকম ভাবে পড়া যাবে”। তো, তিনি একে ফেললেন। আর তার সাথেসাথেই এক ইতিহাসের গোড়াপত্তন হল। একটা সফল এম্বিগ্রাম জন্ম নিল পৃথিবিতে। তিনি জিনিসটা এত ভালবেসে ফেললেন যে, ব্যাপকভাবে প্রাকটিস করতে শুরু করলেন।
আর এটা তো জানা কথা যে, আলো জ্বললে তার দিকে সবাই আকৃষ্ট হবেই। তো আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে আর্ট টা তার অবাক করা সৌন্দর্য আর বুদ্ধিদীপ্ততা নিয়ে। এইগুলোর স্রস্টাদেরও কদর বাড়তে শুরু করে।
এরপর পর্দায় আগমন ঘটে এমন এক ব্যক্তির যিনি এক ধাক্কায় এম্বিগ্রামকে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দেন যা কিনা সর্বসাধারনের মনে আসন গেড়ে নেয় নিমিষে। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার অতিপ্রিয় ড্যান ব্রাউন। এম্বিগ্রাম এর প্রথমসারির ভক্ত ( লোকটা কিসের ভক্ত না আমি তাই ভাবি)। তো, তিনি তার নতুন বই এঞ্জেলস এন্ড ডেমন্স এর জন্য ল্যাঙ্গডনের কাছে এম্বিগ্রাম চান। ল্যাংডন করে দেন। হাভার্ড প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন নামটা কিন্তু জন ল্যাংডন নামটা থেকে নেয়া হয়েছে (ব্রাউন জন কে কিভাবে মুল্যায়ন করেন তা আশা করি সকলে এতক্ষনে বুঝে গেছেন) । ড্যানের ল্যাংডন সিরিজের সবগুলো বইয়ের সাথে জনের সম্পৃক্ততা আছে এবং আগামী আরো বারটা বইতে থাকবে এমনই জানা গেছে ( রাব নে বানাদে জোড়ি) ।
প্রকারভেদ
এম্বিগ্রাম নানা প্রকারের হতে পারে । নির্ভর করে যে করছে তার উপর। চলুন সাধারণ কিছু প্রকার দেখি-
১. আবর্তনশীলঃ এই এম্বিগ্রামগুলো উপর-নিচ দুই দিক থেকেই একরকম দেখায়। মানে ১৮০ ডিগ্রি ঘোরালেও একই রকম থাকে। এই ধরনের এম্বিগ্রামই সবচেয়ে বেশি করা হয়।
২. প্রাকৃতিক এম্বিগ্রামঃ কিছু শব্দ আছে যেগুলো প্রকৃতিগতভাবে এম্বিগ্রামাটিক, প্রতিসম। নকশায় কোনধরনের পরিবর্তন দরকার হয় না । বিশ্বাস না হলে লক্ষ্য করুন এই শব্দগুলো, "dollop", "suns", "pod" , ১৮০ ডিগ্রী ঘোরান হাতেনাতে ফল পাবেন।
৩. মিরর এম্বিগ্রামঃ আয়না আয়না, দেয়ালের আয়না..... কে বেশি সুন্দর বলনা বলনা !! না, আয়না এখানে কোন অহংকারী নারীর সৌন্দর্য্যের কথা বলে না, বলে শব্দের সৌন্দর্য্যের কথা । কিছু শব্দ আছে প্রাকৃতিক মিরর এম্বিগ্রাম। যেমন: MOM, এই শব্দটার মাথার কাছে একটা আয়না রাখুন আর দেখুন মজা, WOW!!!! (আসলেই ওয়াও), আর পাশে রাখলে যে আম্মু(MOM) সে আম্মুই। bud , আয়নায়ও bud । আবার বিশেষ কায়দায় লেখা যায় যাতে আয়নায় দেখলে রহস্য পরিষ্কার হয়।
৪. ত্রৃমাত্রিক এম্বিগ্রামঃ দুনিয়াটাই ত্রৃমাত্রিক হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং স্মার্ট হিসেবে এম্বিগ্রামেরও তাই হওয়া উচিত। হয়েছেও তাই। এক্ষেত্রে কোন একটা ডিজাইন এমনভাবে করা হয় যেন বিভিন্ন কোন থেকে সেটা আলাদা অক্ষর বা শব্দ দেখায় (ভেরি স্মার্ট)।
৫. চেইন এম্বিগ্রামঃ একটা শব্দ যখন আরেকটার সাথে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত থাকে এবং একটা শিকলের মত থাকে থকে বলা হয় চেইন। দুটো শব্দের মধ্যে অক্ষর যদি সমাপতিত হয় তখন এটা তৈরি হয় ( ঠিকমত বুঝাতে পারলাম না মনে হয়,)।
৬. ফিগারঃ এমন এম্বিগ্রাম যেখানে একটা শব্দের মাঝের ফাকা জায়গাগুলোয় আরেকটা শব্দ তৈরী হয়।
৭. মাল্টি-লিংগুয়ালঃ একই সাথে দুই ভাষার সমন্বয়ে এটা তৈরী হয়। এটা একই দিক থেকে পড়া যেতে পারে আবার ১৮০ ডিগ্রী আবর্তন করেও এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় লাফ দেয়া যেতে পারে (মজার না !!!) ।
৮. অক্সিলেশনঃ চমৎকার একটা জিনিস । একটা শব্দ একই সাথে দুইটা শব্দ হতে পারে । শব্দের কার্ভগুলোকে শুধুমাত্র দুইটা পারস্পেক্টিভ থেকে পড়তে হবে। প্রতিসম না কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত, কি বলেন সবাই!!!
৯. সিম্বায়োটোগ্রামঃ এটা এমন এক প্রকার এম্বিগ্রাম যেখানে একটা শব্দ বা বাক্যকে ১৮০ ডিগ্রী রোটেট করলে সম্পুর্ন নতুন আরেকটা শব্দ বা বাক্য পাওয়া যাবে।
এম্বিগ্রামঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
অন্যান্য অনেক জায়গার মত বাংলদেশেও এম্বিগ্রামের পরিচিতি ব্রাউনের এঞ্জেলস এন্ড ডেমন্সের মাধ্যমে। অনেকেই হয়ত বই পড়ে উৎসাহী হয়ে করার চেস্টা করেছে এবং সফল হয়েছে ।
বাংলা ভাষায়ও এম্বিগ্রাম করা হয়েছে । এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, বাংলা এম্বিগ্রামের প্রথম আবিষ্কারক চমক হাসান (বুয়েট)। তথ্যটার যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। কেননা এ ব্যাপারে কোন দাবী ওঠেনি বা আমার কানে আসেনি।
যাই হোক, বাংলা এম্বিগ্রাম নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন ঢাবি-র চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র মোঃ মোরসালিন। এ পর্যন্ত ৯ ক্যাটাগরিতে ১৫০ এর বেশি এম্বিগ্রাম করেছেন, যার মধ্যে চারটি ক্যাটাগরি ওনার নিজের আবিষ্কার।
এম্বিগ্রাম এবং আমি
আমার সাথে এম্বিগ্রামের পরিচয় ঘটে ২০০৮ সালে ড্যান ব্রাউনের বইয়ের মাধ্যমে। বই পড় শেষ হতেই লেগে যাই এম্বিগ্রামের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধারে। কিন্তু অত সহজে ধরা দিল না সে। কয়েকদফা ব্যর্থতার পর অবশেষে সাফল্য ধরা দিল। মনে আছে, এই উপলক্ষ্যে একটা পার্টীর আয়োজন করেছিলাম। Julian ছিল আমার করা প্রথম এম্বিগ্রাম ।
তারপর নিয়মিত এম্বিগ্রাম করেছি। ইংরেজি,বাংলা, লিংগুয়িস্টিক, ছোট, বড়, মীরর,সিমবায়োটোগ্রাম – নানা শাখায় এম্বিগ্রাম করেছি। বিশাল সাইজের এম্বিগ্রাম করার প্রতি ঝোক ছিল প্রথম থেকেই। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েছি, ঘাটাঘাটি করেছি, কিন্তু বেশি বড় এম্বিগ্রামের দেখা পাইনি। আমার করা সবচেয়ে বড় এম্বিগ্রাম ২৬ অক্ষরের, yes I love Bangladesh very much । আর বড় সিমবায়োটোগ্রাম (একদিকে) human right violation, (অন্যদিকে) please stop it just now ।
ব্রাউনকে উতসর্গ করে ,পিকাসোকে স্মরন করে, নেলসন ম্যান্ডেলা কে শ্রদ্ধা জানিয়ে, জহির রায়হানকে মনে করে বেশ কিছু খতরনাক এম্বিগ্রাম করেছি। করার সময় মজা লাগে তাই এম্বিগ্রাম করি। সৃষ্টির আনন্দে এম্বিগ্রাম করি। আমার করা কিছু এম্বিগ্রাম------
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৮