তখন পাঠশালার চৌকাঠে পা মাড়ানো হয়নি। বাসার পাশ দিয়েই ছিল রাজপথ। বারান্দায় উঁকি দিলে দুই পাশের দুই বাস স্ট্যান্ড পরিষ্কার দেখা যায়। সারাদিন অসংখ্য যান্ত্রিক/অযান্ত্রিক যানবাহনের সারি দৌড়ে চলেছে। রাস্তায় তখন অধিকাংশই টেম্পু, মিনিবাস, বেবিট্যাক্সি আর রিকশা। ট্রাকও ছিল। তবে, কার-জিপের সংখ্যা স্পষ্টতই কম। সবচেয়ে বিচিত্র ছিল রংবেরঙএর টেম্পু। ছোট চাকা, বড় চাকা, ট্যারা-ব্যাকা... আবার, বিআরটিসির লাল রঙ্গা বাস, সামনের দাঁত ভাঙ্গা দো'তলা বাস, হলুদ ছাদওয়ালা/সাদা ছাদওয়ালা মিনিবাস। এরই মাঝে একদিন দুপুরে হঠাৎ দেখলাম দানবাকৃতির একটা বড় বাস সামনের দিক থেকে এসে সোজা চলে গেল। এত এত গাড়ির ভিড়ে এই জিনিস তো আগে দেখিনি। আবার, আর সব বাসের মত স্টপেজে দাঁরালও না। যেন রাজার মত আসল, আবার সেভাবেই কারও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আপন গতিতে প্রস্থান! ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইজ দা লাস্ট ইমপ্রেশন! মনে হল আজকের দিনের বোইং সেভেন ফোর সেভেন আকৃতির মত। পরের দিন সারাদিন অপেক্ষায় থাকলাম। এভাবে তিন চার দিন অপেক্ষার পর আরেকদিন দেখা পেলাম আবার! অনেকটা আকাশে কাকের ভিড়ে যেমন কদাচিৎ একটা-দুইটা চিলের দেখা মিলে। ততদিনে নামটাও জেনে ফেলেছি, মুড়ির টিন! সাথে আরও জেনেছি, এই রাস্তার রাজা এই রুটে নিয়মিত চলে না, কখনও হয়তবা প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করে।
তখনই মনে উকি-ঝুকি দিতে শুরু করল, একদিন চড়তেই হবে এই মুড়ির টিন খ্যাত রাস্তার রাজার বুকে। দিন গুনতাম, কখন আসবে উপলক্ষ্য। কিন্তু হায়, ভাগ্য যখন সহায় হয়না, শত সবুরেও আর মেওয়া ফলেনা। যখন যেখানেই গন্তব্য থাকে না কেন, কাকতালীয়ভাবে তা এই রাজকীয় বাহণের আওতার বাইরেই থেকে যেত। দিন যায়, মাস যায়, এমনকি বছরও। তবু হাল ছাড়িনি। অবশেষে একদিন এল সেই মহেনদ্রক্ষন! এত দিনে বুঝি ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চেয়েছেন! গ্রান্ড প্যারেন্টের বন্ধুস্থানীয় একজনের বাসায় যাচ্ছি সন্ধ্যায়। গন্তব্য শহরতলী হওয়ার সুবাদে যাবার সময় না হোক, অন্তত ফেরার সময় পূরণ হবে এতদিনের অপূর্ণ সাধ! কিন্তু হায়। কোন্ এক কুক্ষনে কর্কশ হর্ন বাজিয়ে হাজির হল পিতাজির কর্মস্থলের কুতসিৎ দর্শন এক মাইক্রোবাস।
তার পরও হাল ছাড়িনি। আবার আশায় বুক বাঁধলাম। হয়ত একদিন! অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। একদিন মামা আসল ঢাকায়। কি কি সব জরুরি কাজে। তিন দিন থাকবে, খুবই ব্যাস্ত। টাইট শিডিউল। ঘটনাচক্রে ভিসার মেয়াদ একদিন বেড়ে গেল। শেষদিন প্রায়শ্চিত্তের সূরে বলল, একটা দিন আমার জন্য বারদ্দ। কিন্তু চিড়িয়াখানা বা শিশুপার্ক; কোনওটাতেই মনঃস্থির করতে পারলাম না। তখনও একটা ক্ষীন আশা, এমন কোথায় কি যাওয়া যায়, যেখানে গেলে পাব আমার চির সাধের মুড়ির টিনে আরোহণের সুযোগ! যা হোক, উদ্দ্যেশ্যহীন ঘুরোঘুরি চলল নতুন-পুরান ঢাকা মিলিয়ে অনেক যায়গায়। যানযটবিহীন সেই আমলে ৪০০বছরের ঐতিহ্যের ঢাকা দিনের একভাগেই সিংহভাগ দেখে ফেলার সুযোগ ছিল। পড়ন্ত সন্ধার সামান্য আগে গুলিস্তানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছি শেষ গন্তব্য বাড়ি ফেরার বাহন ধরতে। আমার চোখ দু'টো তখন এদিক-সে'দিক খুঁকে ফিরছে রাজকীয় মুড়ির টিন। এই শেষ সুযোগ। বলা তো যায় না, সব ভাল তার...! অ্যাডভেঞ্চার ঢাকা পর্বের শেষটা যদি মনমত হয়েই যায়!
কিন্তু হায়। হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল, যখন থালা আকৃতির সামনের চাকা বিশিষ্ট একটা টেম্পু ধেয়ে এসে থামল আমাদের সামনে...
ধীরে ধীরে সেই ইচ্ছাটা ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হতে লাগল। তারপর একদিন ছেড়েই দিলাম এই শহর। আধদশক পর যখন আবার ফিরলাম, ততদিনে সেই সাধ প্রায় মৃত।
এখন হাজারও যন্ত্রযানের ভীড়ে আর খুজে ফিরিনা সেই মুড়ির টিন। ডারউইনের বিবর্তনবাদ সত্য প্রমাণ করে যা আজ শুধুই স্মৃতি। রাজকীয় সেই ডাইনোসরের বদলে রাজপথ দখলে নিয়েছে কতশত মার্সিডিজ বেঞ্জ, ভলভো। শুধু নাই আমার দেখা বোইং-747
_______________
ছবিঃ গুগল থেকে নেয়া।