অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বলিষ্ঠ উদাহরণ দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। ৬৭ শতাংশ ভোটারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে গণতন্ত্রের বিরাট বিজয়। বিজয়ী দলকে বিজিত দল অভিনন্দন জানাচ্ছে। কারচুপির অভিযোগ নেই, অভিযোগ নেই ক্ষমতার অপব্যবহারের। জনগণের মতামতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিল সব দল। শপথ গ্রহণের আগে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে তৎপর বিজয়ী দলের নেতা। বাংলাদেশে এ রকম নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী পরিবেশ আমরা কবে দেখব? এ নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যারা রাজনীতি করেন তাদের পক্ষে জনতার সমর্থন থাকে সবসময়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করলেও ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে মাত্র নয় মাসের মধ্যে শোচনীয়ভাবে হারতে হয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টির (এএপি) কাছে। আমরা এএপি ও কেজরিওয়ালকে অভিনন্দন জানাই। এএপিকে আবারও দিল্লির মসনদে আসীন হতে সহায়তা করেছে সাধারণ মানুষ। তাদের বিশ্বাস, আম আদমি পার্টি তাদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। কারণ এর আগে কেউ তাদের একজন হয়ে নিু ও মধ্যবিত্ত মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোকে এত জীবনঘনিষ্ঠ করে রাজনৈতিক দাবি হিসেবে তুলে আনেননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। জনকল্যাণমুখী রাজনীতিকদের প্রতি জনগণের সমর্থন থাকবেই। এএপির জয়ের পেছনে রয়েছে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার, পানি ও বিদ্যুৎ বিল কমানোর ঘোষণা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, তরুণদের সম্পৃক্তকরণ এবং টেকসই উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া। মাত্র দু-তিন বছরের একটি রাজনৈতিক দলের বিরল এই সাফল্যের ক্ষেত্রে দলটির অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাশাপাশি নারীদের বিপুল সমর্থন উল্লেখযোগ্য। বিগত কয়েক বছরে দিল্লির রাস্তায় নারীদের নিরাপত্তাহীনতা বিশেষ ধর্ষণের ঘটনা ভারতসহ সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় তুলেছিল। এএপির নির্বাচনী ইশতেহারে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দিল্লির নারীদের নিরাপত্তার বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। নারীদের নিরাপত্তায় উন্নত সড়কবাতি, পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি ১০ হাজার নারী নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন কেজরিওয়াল। এ ছাড়া জলাধার সংরক্ষণ, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি রয়েছে। এসব বিবেচনায় দিল্লির সাধারণ মানুষ এএপি তথা কেজরিওয়ালের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যার ফল সব প্রাক্কলিত হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, কেজরিওয়াল প্রতিপক্ষের তীব্র আক্রমণেও অবিচল ছিলেন তার রাজনৈতিক এজেন্ডার বিষয়ে। তার নমনীয় আচরণ, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ না করা এবং ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার বিষয় ভোটারদের মন জয় করতে সহায়তা করেছে। গণতান্ত্রিক চর্চায় অন্যের মতকে যুক্তি দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এর প্রচলন দেখা যায় না। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল অতীত ইতিহাস বা একে-অন্যকে দোষারোপ করার মধ্যে বেশি সোচ্চার। পরমতসহিষ্ণুতা বা গণদাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার বিষয়টি সাধারণত দেখা যায় না। এ কারণে সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষের এ অনীহা তাদের কোনোভাবেই স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। বরং চলমান সহিংস পরিস্থিতিতে তারা জীবন দিচ্ছে, পঙ্গুত্ববরণ করছে বা আগুনে পুড়ছে। সাধারণ মানুষ দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে কোনো পক্ষেরই সদিচ্ছা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ভারত বা পাকিস্তানে ভাষা বা সাংস্কৃতিক বিভাজনের কারণে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন হলেও বাংলাদেশে প্রায় একই ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির অনুসারীদের বসবাস হওয়ায় সহজে জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ সফল করা সম্ভব। প্রতিবেশী দেশের ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশের দলগুলোর জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।
সালমা আলী, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
See more at: Click This Link