বিশ্বের অন্যতম অপরূপ সুন্দর দেশ বাংলাদেশ। এই দেশের হাজার হাজার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম ও প্রধান দর্শনীয় স্থান হচ্ছে সুন্দরবন। সুন্দরবন হল বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। যা ইউনেস্কো কর্তৃক 'বিশ্বঐতিহ্যের' স্বীকৃতি লাভ করেছে। কখনো সুন্দরবন ভ্রমনে যাওয় হয়নি। তাই গত ৪ - ৭ ই নভেম্বর ২০১৪ "আইকন ট্যুরিজম" নামক একটি ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে ১১,৫০০/= টাকা প্যাকেজ মূল্যে ঢাকা থেকে সরাসরি লন্ঞে করে সুন্দরবন ভ্রমনে গিয়েছিলাম। ট্যুর অপারেটরটি "সুন্দরবন ট্যুরিজমের" সাথে যৌথ এটি আয়োজন করে। তাদের পরিপাটি লন্ঞ, লন্ঞের পরিচ্ছন্ন কেবিন, চমৎকার আতিথেয়তা, আপ্যায়ন ও ব্যবস্থাপনা আমাদের মুগ্ধ করেছে। পেলিকেন-১, এই লন্ঞে করে আমরা সারা সুন্দরবন ঘুরে বেড়িয়েছি।
এই সময় সুন্দরবন যাওয়ার অন্যতন অারেকটি কারণ হচ্ছে - ৬ ই নভেম্বর ছিল ভরা পূর্ণিমায় সুন্দরবনের দুবলারচরের রাশ উৎসব / রাশ মেলা / রাশ পূর্ণিমা উৎসব। এদিন প্রায় সারাবছর জনমানব শূন্য থাকা এই চরটিতে হাজার হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী সহ অসংখ্য পর্যটন ভিড় জমান। রাশ মেলা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হলেও, সকল ধর্মের মানুষ উৎসবটি উপভোগ করতে এই সময় সুন্দরবনের দুবলারচরে আসে। শুধু তাই নয়, আমরা ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও পেয়েছি যারা সমূদ্র পথে এখানে এসেছে পূর্ণ্যস্লান করতে।
এই ভ্রমণটি সরাসরি ঢাকা থেকে নদী পথে হওয়ায় অনেক ধরনের মজার ও রোমন্ঞকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর ছিল। বাংলাদেশ যে নদীমাতৃক দেশ দেশের দক্ষিণান্ঞলে না গেলে বোঝাই যাবে না। অনেকগুলো নদীর সাথে পরিচয়, নদীগুলোর বুকের মধ্যে দিয়ে পর্যটন লন্ঞে ভ্রমণের মজাই অন্যরকম। যে নদী গুলোর সাথে পরিচয় হল সেগুলো হল - বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মেঘনা, কীর্তখোলা, সুগন্ধা, গাবখান, সন্ধ্যা, কালছা/কাটছা, বালেশ্বর, হরিণঘাটা, সুন্দরবনের সুপতিখাল, কটকা খাল, পশুর নদী, রূপসা নদী। নদী, নদীর তীর, নদীর পানি, জোয়ার-ভাটা, কচুরিপানা, মাছ ধরার নৌকা, ট্রলার, কার্গো, যাত্রীবাহী লন্ঞ, ফেরীঘাট ইত্যাদি নদীর সৌন্দর্য্যকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। গাবখান নদী।
রবি মোবাইল অপারেটরের এই বিজ্ঞাপন চিত্রে দেখেছিলাম লন্ঞের চরে আটকা পড়ার বিষয়টি। এই যাত্রপথে সুন্দরবনের সুপতি প্রবেশ পয়েন্টের কাছাকাছি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজারের কাছাকাছি এলাকায় হরিণঘাটা-বালেশ্বর নদীর মাঝামাঝিতে নদী আড়াআড়ি ভাবে পাড়ি দেয়ার সময় একটি ডুবোচরে আমাদের লন্ঞটি আটকা পড়ে। লন্ঞটিকে ডুবোচর থেকে উদ্ধার করার জন্য লন্ঞের মাস্টার লন্ঞটিকে পিছনের দিকে নেয়ার চেষ্টা করলে, হঠাৎ করে লন্ঞের বেয়ারিং নষ্ট হয়ে যায়। সাথে সাথে লন্ঞটি সম্পূর্নরূপে বন্ধ হয়ে যায়। তখন ট্যুর অপারেটর অামাদের সামনে রায়েন্দাবাজারের কাউকে ফোন দিয়ে একটি ট্রলার আনতে বলেন এবং প্রায় আধ ঘন্টা পর একটি ট্রলার আমাদের লন্ঞের নিকট আসে। ততক্ষণে লন্ঞের বেয়ারিংটি মাস্টার ও ড্রাইভার মিলে খুলে ফেলেছে। ট্যুর অপারেটর (বাবুল ভাই), লন্ঞের মাস্টার ও ড্রাইভার সহ বেয়ারিংটি নিয়ে রায়েন্দাবাজারের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন এবং বলে গেলেন ঘন্টা খানেকের মধ্যে বেয়ারিংটি ঠিক করে ফিরে আসবেন। আমরা সুন্দনবনগামী সকল যাত্রীরা তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। তখন বিকাল প্রায় সাড়ে চারাটা।
ইতিমধ্যেই আমরা চারদিকে খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করলাম অনেক দূরে নদীর তীর। ভাটার টানে ডুবোচরটি ততক্ষণে স্পস্ট হয়ে উঠল। কোন যাত্রীবাহী বা মালবাহী লন্ঞ বা কার্গোর দেখা পাচ্ছি না। অনেক দূর দিয়ে দু-একটি ট্রলার মাঝেমাঝে চলাফেরা করছে। সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে আসছে। নদীর মধ্যে সবাই সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম।
চারদিকে হালকা হালকা অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পূবাকাশে হালকা করে চাঁদের দেখা মিলল।
কিন্তু ততক্ষণে সাড়ে পাঁচটা কি ছয়টা বেজে গেল। আমাদের মানে কিছুটা ভীতির সণ্ঞার হতে লাগল। বাবুল ভাইকে ফোন দেয়া শুরু হয়ে গেল। বাবুল ভাই জানালো - বেয়ারি মেরামত হয়ে গেছে, কিন্তু তারা যে ট্রলারে করে গেছে, সেই ট্রলারটি নষ্ট হয়ে গেছে। ততক্ষণে রাত প্রায় সাতটা কি সাড়ে সাতটা। আমাদের ভয় অারো বেড়ে গেল। কারন লন্ঞে আমাদের সার্ভিসে নিয়োজিত পাঁচজন ছেলে (যারা আমাদের মত ঐ জায়গা সম্পর্কে অপরিচিত) ছাড়া পরিচিত আর কেউ নেই। সবাই বলাবলি করতে লাগল - এই জায়গায় যদি এখন আমরা জলদস্যুদের শিকারে পরিনত হই তাহলে কি হবে! এই ভয়ে সবার মনে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ আমাদের লন্ঞের কাছাকাছি একটি ট্রলারের শব্দে সবার মধ্যে ভাল ভাবেই ভয় তৈরী হল। এর মধ্যেই বাবুল ভাইকে আমরা ফোন দিলে বাবুল ভাই জানালো - তারা অামাদের লন্ঞর কাছাকছি চলে এসেছে। তখন সবাই হাফ ছেড়ে বাাঁচলো। অবশেষে অমরা রাত সাড়ে নয়টার দিকে উদ্ধার হলাম।
এরপর পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমরা কটকায়। ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি সুর্যোদয় উপভোগ করলাম।
নদীর তীরের জঙ্গলে হরিণের এলোপাথাড়ি বিচরণ দেখতে খু্বই সুন্দর লাগলো।
তারপর চা-বিস্কিট খেয়ে কটকার জঙ্গল ভ্রমণে বের হলাম।
কটকা সৈকত,
হরিণের পাল,
টাইগার পয়েন্ট,
আইলা-সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ বন,
সুন্দরী গাছ ও
গোলপাতার গাছ সহ সব কিছুই উপভোগ করলাম।
কটকা ভ্রমণ শেষে লন্ঞে ফিরে খিচুড়ি আর ডিমের কোর্মা দিয়ে সকালের নাস্তা সারতে সারতে দুবলারচরের উদ্দেম্যে রওনা দিলাম। আর পথে ছয় ঘন্টার ভ্রমণে সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে লাগলাম। পথে বড় বড় বক, স্বারষ, চিল, সহ অসংখ্য পাখির দেখা মিলল।
কোকিল চর, তিন কোনা চর সহ অসংখ্য স্পট দেখতে দেখতে মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল।
দুবলারচরের জেলেদের মৌসুমী আবাসস্থল অর্থাৎ গোল পাতার ঘর ও ঘরের সামনে শুটকি শুকানোর দৃশ্য ও শুটকির গন্ধ খু্বই চমৎকার লাগছিল। তারচেয়ে বেশি ভাল লাগল রাশমেলা স্থলে যাওয়ার পথে দুবলারচরের বিচের সূর্যাস্তের ছবি।
রাতের বেলায় লন্ঞ চলে এলো হাড়বাড়িয়ায় ইকো ট্যুরিষ্ট স্পটে। অবশেষে সেখানে দেখা পলাম বাঘের পয়ের ছাপ। হাড়বাড়িয়ার মিঠা পানির পুকুর ও পুরো জঙ্গলটি খু্বই মনোমুগন্ধকর ও রোমান্ঞকর।
হারবাড়িয়া থেকে দুপুরের আগেইস চাঁদপাই জেলেপাড়া পাড়ি দিয়ে চলে এলাম করমজল হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রে। সেখানের হরিন ও কুমিরের পাশাপশি দেখা মিলল
বাঘের কঙ্কাল, জঙ্গলের সাপ,
গাছে বানর সহ অনেক পাখ-পাখালির ডাক।
করমজল ভ্রমণ শেষে করে মংলা পোর্ট, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নৌ ঘাটি ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও পশুর নদীর তীর দেখতে দেখতে বিকাল চারটায় খুলনা শহরের রূপসা নদীর ঘাটে এসে আমাদের ভ্রমণ শেষ করলাম।
খুলানায় আসার পর বাবুল ভাই আমাদের জানালো রাত সাড়ে নয় টায় অমাদের বাস। তাই হঠাৎ করেই আমরা চার জনে মিলে ২০০০/= টাকায় একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ও ইউনেস্কো ঘোষিত আরেকট বিশ্বঐতিহ্য 'ষাট গম্বুজ মসজিদ' ও বাগেরহাটের প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত খান জাহান আলী (র.)'র মাজার দেখতে গেলাম। খুবই সুন্দর লাগল এই দুটি স্পট।
সন্ধ্যায় খুলনা শহরে এসে দেখি রয়েলের মোড়ে শহরবাসীর উৎসব। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে খুলনাতেই ঐদিন টেস্ট সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সাবাশ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আর আমরাও জয় করলাম অনিন্দ্য সুন্দর, অপরূপ সুন্দরবন।
যদি সময় সুযোগ থাকে তো এখনই বেড়িয়ে আসুন সুন্দরবন। খুবই সুন্দর বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন। (ভ্রমনিচ্ছুকদের জন্য "আইকন ট্যুরিজম" প্যাকেজ ট্যুর অপারেটরের মোবাইল নম্বর: ০১৮১৮-৬০৩৯৪৮)।