আলতাফ হোসেন
শুনতে ভালো লাগত অমুক লেখকের কথা, তমুক লেখকের কথা। নিভৃতচারী। প্রচারবিমুখ। নিজেরও ইচ্ছা করত, এক, লেখক হওয়ার, দুই, নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ হতে। লেখক অল্পস্বল্প হইনি যে তা বললে সত্য বলা হবে না বোধহয়, তবে আপনমনে, নিজের জগতে যে থাকি তা কেবল লাজুক হবার কারণেই, অপরিচিত থেকে যাবার ইচ্ছায় নিশ্চয় নয়। নিজের ভুবনে এই নিবিষ্ট হয়ে থাকার প্রবণতা হয়তো বাড়তেই থাকত, আমারও তাতে মনোবেদনা ক্রমবর্ধমান হতো না হয়তো, কিন্তু ছোট এই দেশটির মিডিয়া আমাকে তেমনটি থাকতে দিল না। পুরস্কারের ছলে একটুখানি পরিচিতি দেবার ব্যবস্থা করল। ফলে, এ পর্যায়ে এসে আমার লেখক হবার ইচ্ছা যেমন বেড়ে গেছে, অন্যদিকে অন্তর্গত রসায়নজাত যে বিনয় তা-ও যেন কমতে শুরু করেছে। প্রকাশক পরিচিত না হলেও কুরিয়ার সার্ভিসে পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিচ্ছি টেলিফোনে কথা বলে। (এবং আশ্চর্য যে বই ছাপা হয়ে বেরোচ্ছেও তাতে। অবশ্য, কবিতার নয়, গদ্যের বই বেরিয়েছে এভাবে দুটি। ‘কবিতার বই প্রকাশ করা যাবে না’ বলা হয়েছে, যতই-না সমাদর পেয়ে থাকুক কোনো কোনো মহলে কোনো কোনো কবিতার বই লেখকের)।
এই যে একটুখানি ভণিতা তা আবারও (আগেও এমনটি হয়েছে কোনো কোনো তরফ থেকে অনুরুদ্ধ হয়ে) নিজের কথা বলতে বসার কারণেই। নিজের কথা নিলাজ হয়ে আবারও বলতে বসা কবি তথা লেখকই হতে চেয়ে তো।
স্কুলে পড়ার বয়স থেকে (স্কুলে যদিও নিয়মিত পড়া হয়নি) আমার নেশা আটকে ছিল দুটি বিষয়ে : ক্রিকেট এবং বই পড়া। শৈশবের যে সময়টা করাচিতে কেটেছে সে সময়ে নিমগ্ন থেকেছি ক্রিকেটে। বই পড়ার নেশা টের পেয়েছি চাটগাঁয় ফিরে। আমার বাবা ছিলেন রেলওয়েতে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আমার বাবারও ছিল পড়ার অভ্যাস। রেলওয়ের গ্রন্থাগারটি ছিল অনেক বিষয়ের বইতে সমৃদ্ধ। তিনি মূলত ইংরেজি বই আনতেন। ডিকেন্স, পি জি উডহাউজ, ডি এইচ লরেন্স, টি ই লরেন্স, পার্ল এস বাক প্রমুখের বইয়ের কথা মনে পড়ে। আর বাংলা বইয়ের মধ্যে বনফুল, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথের বইগুলির কথাও মনে পড়ে। ঠিক হলো, বাবা একবার বই আনতে যাবেন তো পরের বার লাইব্রেরি-কার্ড নিয়ে আমি বই আনতে যাব। হাজার হাজার বই থেকে পছন্দের বই আনার এই সুযোগ যদি না পেতাম তাহলে কবিতা লেখার নেশা মাথায় চাপত কি না বলা মুশকিল। (অন্য যে কোনো লেখকের লেখায় এমন একটি লাইন দেখলে আমার মাথায় সঙ্গে-সঙ্গে আসত, তাতে কী আর ক্ষতিবৃদ্ধি হতো? ইনভলান্টিরিলি-ই। ভাবনাবিহীনভাবেই।)। রেলওয়ের ওই গ্রন্থাগার (নাম সম্ভবত ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট রেলওয়ে লাইব্রেরী) থেকে অনেক অনেক বই এনে পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রথম দিকটায় স্বভাবতই নীহাররঞ্জন গুপ্ত, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখের ডিটেকটিভ উপন্যাসগুলো পড়া হচ্ছিল। তারপর ওখানেই পেলাম রবীন্দ্রনাথের অনেক বই, পুরানো দিনের নামী পত্রিকা যেমন ভারতবর্ষ, প্রবাসী, শনিবারের চিঠি একসঙ্গে কয়েকটি করে বাঁধানো আকারে। হঠাৎ নজরে পড়ল জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’ নামের কবিতার বইটি। তখনো কবির নামটি আমার অচেনা। কিন্তু পড়তে গিয়ে মজা পেলাম। একেবারেই অন্যরকমের কবিতা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো তো নয়ই, আরও যাদের কবিতা পড়া হয়েছে সেসময় - বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমান এবং আরও কারো কারো পড়া হয়েছে বলে অল্প অল্প মনে পড়ে- তাদেরও কারো মতো নয়। কিছু বোঝা গেল, তো বাকিটা রহস্যময়, দুরূহ। সব মিলিয়ে প্রবলভাবে টানে। দিনে দিনে এমনই আকর্ষণীয় হয়ে উঠল কবিতাগুলি যে ওই বইটি অনেক দিন ধরে রাখব বলে বারবার রিনিউ করে এনেছি। কবিতার প্রতি ভালোবাসা আমার আসলে তখন থেকেই। লেখারও বাসনা জাগল সে সময় থেকে।
চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো- ঘুমে- ঘেয়ো/কুকুরের অস্পষ্ট কবলে/হিম হয়ে নড়ে গেল ও-পাশের পাইস রেস্তরাঁতে,/ প্যারাফিন-লণ্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে/সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;/এইসব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।
বেতন হাজার টাকা মাসে- আর হাজার দেড়েক/পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি:/যদিও সেসব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক/চেয়েছিলো- হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।
শব্দে-চিত্রকল্পে আবহ তৈরিতে এমন অভিনবত্বের দৃষ্টান্ত বাংলা কবিতায় (আমার যতটুকু পড়া ছিল) আগে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। বইটিতে কবিতার পর কবিতায় এমন বা এর চেয়েও অধিক চমকে-দেওয়া ছবি, বার্তা আমরা পেতে থাকি। তখন আমার পক্ষে এসব কবিতা আত্মস্থ করা সম্ভব ছিল না স্বভাবত। এখনো কতটা উপলব্ধিতে আনতে পেরেছি জানি না। এখনো আমরা হাজারো কবি জীবনানন্দকে যথাযথ পড়তে পেরেছি কি না সন্দেহ হতে থাকে।
এ হচ্ছে কবিতার প্রতি আমার আকর্ষণের সূচনা-কথা। কবিতা প্রায়-নিয়মিত লিখতে শুরু করি ষাট সালের দিকে। ছোটদের মাসিকে, বড়দেরও পত্রিকায়। আলাপনী, রঙধনু ও এমনি আরও ছোটদের পত্রিকায়, মোহাম্মদী, বিংশ শতাব্দী (কলকাতার), পাকিস্তানী খবর, ইত্তেফাক এবং আরও অনেক কাগজে আমি লিখতে থাকি ষাটের দশকের প্রথমার্ধ থেকে। ঢাকায় বসবাস ১৯৬৪ সাল থেকে। তখনও এসএসসি দেওয়া হয়নি। বই পড়া ও লেখা চলতে থাকে। ১৯৬৬ থেকে সম্ভবত লিটল ম্যাগাজিনে লিখতে শুরু করা হয়। এ সময় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হায়াৎ মামুদ তাঁদের ছোট কাগজ ‘কালবেলা’য় আমার কবিতা প্রকাশ করেন। মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন কবির, রফিক আজাদ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান এবং স্বাক্ষর, কণ্ঠস্বর গোষ্ঠীর প্রায় সকল লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং এসব সাহিত্যপত্রে ও সাপ্তাহিক, দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতায় অল্পস্বল্প লেখা চলতে থাকে।
ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি।
এ সময় কয়েকজন বিদেশী লেখকদ্বারা খুব প্রভাবিত হই। একজন ছিলেন কলিন উইলসন। এঁর দ্য আউটসাইডার আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। বইটির মলাটে লেখা ছিল অ্যান ইনকোয়েরি ইনটু দ্য সিকনেস অফ ম্যানকাইন্ড ইন দ্য মিড-টোয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি...। বইটি ঢাকায় এলে তরুণ কয়েকজন কবির মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। তড়িঘড়ি বইটি কেনা হয়। আগেই পড়া হয়েছিল আলবের কামু-র দ্য আউটসাইডার বা দ্য স্ট্রেঞ্জার, বস্তুত সেটিই প্রথমবারের মতো তুমুলভাবে আলোড়িত করেছিল। কামু-র বই থেকেই কলিন উইলসন তাঁর বইটির নাম ও আরও অনেক ভাবনা পেয়েছিলেন। যাই হোক, কলিন উইলসন দেখিয়েছেন আউটসাইডার বলতে আসলে কী। আঁরি বারবুসের নরক উপন্যাসের অনামী নায়ক বলছেন, ‘এক প্রচন্ড বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আমি পড়ে গেলাম। এটি এমন এক অবস্থা যে, চারপাশটা যেমন আমি যেন তেমনটা দেখতে পাচ্ছি না। আমি যেন আরও গভীরভাবে, আরও বেশি-বেশি দেখতে পাচ্ছি। ‘আই সি টুউ ডিপ অ্যান্ড টুউ মাচ।’ ফ্রানৎস্ কাফকা-র মেটামরফসিস-ও এ সময়ে পড়া হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এ বইটি পড়ার পর কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এ বছর প্রকাশিত ‘ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ও চামেলি’ বইতে।
বলতে চাওয়া হচ্ছে যে, লেখালিখির সঙ্গে পড়ার সম্পর্র্র্ক খুবই নিবিড়। মানুষ যখন নিজেকে বোঝার চেষ্টা করে (করবেই, যদি সে একটুও সংবেদনশীল হয়), তখনই চারপাশে তাকায়, প্রকৃতি থেকে, মানবপ্রকৃতি থেকে পাঠ নিতে চেষ্টা করে, বইতেও নিজেকে সে খোঁজার চেষ্টা করে। আমরা বলি, বই পড়ে সে প্রভাবিত হয়েছে। ‘প্রভাবিত’ হয় তখনই সে যখন নিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পায় কোথাও। নিজের চিন্তারই সন্ধান পায় অন্যত্র।
পাশাপাশি বাংলা ভাষার লেখকরা তো আশৈশব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেনই। রবীন্দ্রনাথ, বিশেষত তাঁর গল্পে ও গানে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর পুতুল নাচের ইতিকথা ও দিবারাত্রির কাব্য দিয়ে। আরও বহু লেখক। কবিদের মধ্যে জীবনানন্দের কথা বলেছি। আরও বহু কবি।
এবার প্রকৃতিরও ভূমিকার কথা। প্রকৃতির অবদান বোঝাতে প্রত্যক্ষ অবদানের কথাই বোঝানো হতে থাকে অনেকসময়। বলা হয় যে, অমুক প্রকৃতির কবি। রূপসী বাংলার প্রসঙ্গে প্রকৃতি-বর্ণনার কথা ওঠে। কিন্তু পরোক্ষ-প্রভাবের কথা তেমন শুনতে পাওয়া যায় না। মনে হয়, লেখা-বিবেচনায় ‘তোমার বাস কোথা যে পথিক’ জানাও প্রয়োজন আমাদের। প্রকৃতি আমাদের শান্ত ও স্থিতধী করতে পারে, নিরাসক্ত করতে পারে আবার আসক্তিরও কারণ কি হতে পারে না পাহাড়, নদী ও বন? শৈশবে করাচির রুক্ষ প্রকৃতি আমাকে কষ্ট দিয়েছে। লু হাওয়ার অনুভব পাই সে শহর থেকে। নিরুত্তাপ মনে হয়েছিল সেখানকার অনেক মানুষকে। তার ছাপ তো কিছু পড়েছেই নিশ্চয় ভাবনায়। আবার চাটগাঁ-র ব্যাপারটি উল্টো। সবুজ ছিল (এখন তো আর নেই তেমন) টিলাগুলো। গাছপালা পরিচ্ছন্নতর (নোংরা হয়েছে দিনে দিনে)। নদী ছিল সত্যিই স্রোতস্বিনী। মাঝে মাঝে যেতে ইচ্ছা করত ফৌজদারহাট সমুদ্রতীরে, পতেঙ্গার সাগরসমীপে। যেতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গিয়েছি। কয়েকবার। অবশ্য একবারই ওঠা হয়েছিল শীর্ষে। ওইসব দৃশ্যই ফিরে ফিরে আসে। আবার সমুদ্রেও যাওয়া হয়েছে, গভীর সমুদ্রের ওপর দিয়ে, দিনের পর দিন যখন চারপাশটায় আকাশ ছাড়া কিছুই ছিল না। ছিল তো যে জানা ছিল বই থেকে, আর লোকমুখে। দেখতে পাইনি চোখে। অবশ্য হাওরে গিয়ে বা বড় নদীদের মোহনা থেকেও এমন অনুভূতি হয়। গহীন সাগরের নির্জন রাত্রিবেলা মনে পড়ে তো। নিজেকে কখনো মনে হয়েছে লোক না পোক। অন্যদেরও। কত যে পলকা, ঠুনকো যে কত। লাফ দিলেই কি, না দিলেই কি, মনে হয়েছে। চাটগাঁ-র লোকালয়ে ঝড় হয়েছে প্রচন্ড। কয়েকবার। বিধ্বস্ত হয়েছে বাড়িঘর, বৃক্ষরাজি। মনে পড়ে গেছে, পৃথিবী যে ক্ষণিকের, সবটা যে আকস্মিক। ভরসা ও আস্থাযোগ্য নয় কোনোকিছু।
এ লেখা যখন চলছে তখন একটি টিভি চ্যানেলে দেখা গেল কবি অরুণ মিত্র সম্পর্কে বলছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও চিন্ময় গুহ। সত্যিই অসাধারণ ছিল অরুণ মিত্রের বেশ কিছু কবিতা। অরুণ মিত্র তাঁর আশি-পঁচাশি বছর বয়সেও তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কীভাবে ‘আধুনিক’ কবিতা রচনা করে গেছেন দেখে আশা হতো, এতদিনেও যদি কিছু না হয়ে থাকে কবি আলতাফ হোসেনের, তবে সময়ও তো ফুরিয়ে যায়নি, (না কি গেছে?), একদিন কি হবে না?
(ইত্তেফাক সাময়িকী : ১০ এপ্রিল ২০০৯)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৮:২৩