এসএসসি পাসের পর দীর্ঘ অবসর রানা আলমের (ছদ্মনাম)। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর ঘোরাফেরার মধ্যে দিনগুলো কাটছে। এমনি সময় এক প্রবাসী বন্ধু এল দেশে। ঢাকা থেকে এল আরেক বন্ধু। তারা বায়না ধরল রানাকে একটি নতুন জিনিস খাওয়াবে। তাদের নানা প্রলোভনে অবশেষে রানা রাজি হলো। তিনবার হেরোইন স্ল্যাশ করাল। রানা গাল ভরে বমি করে দিলেন। দ্বিতীয় দিন আর আড্ডায় যেতে চাইল না রানা। তখন তারা বলল, `তিন দিন পর মজা বুঝবি।' তৃতীয় দিন হেরোইনের আগে ফেনসিডিল খাইয়ে দিল তারা। চতুর্থ দিন ঘরের বের হলেন না রানা। পঞ্চম দিন প্রবাসী বন্ধুটি খবর পাঠাল, সে বিদেশ চলে যাচ্ছে রানা যেন তার সঙ্গে দেখা করে। দেখা করতে গেলেই জোর করে আবার হেরোইন সেবন করানো হলো। সপ্তম দিন রানাকে কদমতলির অভিশপ্ত বরিশাল কলোনির বড় বাড়ি নিয়ে গেল তারা। হেরোইন কেনার জায়গা, দরদাম সব শিখে নিলেন রানা। তারপর নিজেই কিনতে লাগলেন ২০ টাকায় হেরোইনের পুরিয়া। নিজের মাদকাসক্তির প্রথম দিনগুলোর কথা বললেন রানা।
অবশেষে এল কলেজ ভর্তির মেৌসুম। সরকারি সিটি কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন। কিন্তু সেখানে পড়াশোনার চাপের কথা শুনে ভর্তি হলেন পাহাড়তলী কলেজে। কিছু টাকা কলেজে জমা দিয়ে বাকি টাকা খরচ করলেন হেরোইনের পেছনে। একসময় পাড়ার লোকদের বিরাগভাজন হলেন। তারা জড়িয়ে দিলেন একটি হত্যা মামলায়। নেশার পুরিয়া নিয়ে আসার সময় গ্রপ্তোর করল পুলিশ। জেলে ছিলেন টানা তিন মাস। পরে অনেক চষ্টো করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) থেকে মুক্ত হলেন তিনি। তখন রানার বাবা বললেন, `তোমার আর পড়াশোনা করে কাজ নেই। তুমি আমার ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দাও।' এরপরের কাহিনি শুনুন রানার মুখেই: `এ সময় বাবার ব্যবসার একটি অংশ দেখাশোনা করতাম আমি। কাজ একটি প্রতিষ্ঠানে অর্ডার সাপ্লাই করা। হাতে আসতে লাগল টাকা। নেশাও জমতে লাগল বেশ। একা একা নেশা তো আর জমছে না দেখে বন্ধু জোটালাম জনা বিশেক। একদিন প্রতিষ্ঠানের মালিক আমার পকেটে হেরোইনের পুরিয়া দেখতে পান। এক ঘণ্টার মধ্যে সব বিল পরিশোধ করে বলে দিলেন আর যেন ওই প্রতিষ্ঠানের ত্রিসীমানায় না যাই। ব্যবসাটা হাতছাড়া হলো দেখে বাবা অনেক গালাগাল দিলেন। বললেন, আমি বাসায় খেতে-পরতে পারব কিন্তু কোনো খরচার টাকা পাব না। চোখেমুখে অন্ধকার দেখলাম। ধারদেনা করে নেশার খরচ জোগাড় করতে লাগলাম। একসময় ধার নেওয়ার মতো লোক খঁুজে পেলাম না। বাধ্য হয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি নিলাম। দুই বছর কাজ করলাম। একদিন সেই চাকরিও গেল।'
কীভাবে ফিরে এলেন সুস্থ জীবনে?
রানা বলেন, ``পোশাক কারখানার চাকরি চলে যাবার পর একদিন বড় ভাই পতর্ুগাল থেকে ফোন দিলেন। বললেন, `তোমার জন্য কি আমি দেশে আসতে পারব না?' আমি বললাম, `আমি আবার কী করলাম!' তিনি বললেন, `তুমি যা করে বেড়াচ্ছ তাতে আর মান তো বাকি নেই কিছু। আমার বন্ধুর এক ভাই তোমাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তুমি সেখানে ভর্তি হলে আমি দেশে আসব।' রাজি হয়ে গেলাম। ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর বেলা আড়াইটায় আমাদের পাড়ারই এক ছেলে সিএনজি অটোরিকশায় করে নিয়ে গেল সিলিমপুরের আর্ক মাদকাসক্তি পুর্নবাসনকেন্দ্রে। গিয়ে দেখলাম সবাই ফুটবল খেলছে। ইমতিয়াজ ভাই আমাকে রিসিভ করলেন। পরদিন সকাল নয়টায় আমার চুল কামিয়ে দেওয়া হলো। চার মাস টানা রুটিন কাজ চলল। ধীরে ধীরে আলোর পথে ফিরে এলাম। বুঝতে পারলাম, ভুল পথে পা বাড়িয়েছিলাম। অমানুষ হয়ে যাচ্ছিলাম। এখন প্রায় চার বছর সুস্থ আছি। সুখে আছি। ভালো আছি।'
পরিবারের সদস্যরা কি বিশ্বাস করলেন আপনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলেন?
রানার জবাব, `প্রথম দুই বছর তঁারা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। পরে আমার আচরণ, বিবেক-বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা, আন্তরিকতা দেখে তঁারা বিশ্বাস করলেন। এখন তো পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার ওপর।'
আমাদের আলোচনার প্রায় শেষ পর্যায়ে রানা বললেন, `আসলে যারা মাদকাসক্ত তারা অন্য জগতে চলে যান। নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। তঁারা ভালো-মন্দ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সর্বনাশা নেশার জন্য যেকোনো কাজই করতে পারেন। তাই সমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে সচেতনতা সৃষ্টির।'