১.
: শোনো, আকতার ভাই ফোন করেছিলেন।
: কী বলেছেন?
: পাপড়ির ছেলে হয়েছে।
: কখন, কোথায়?
: ভোর চারটায়। আগের ক্লিনিকেই।
: অসে্ত্রাপচার নাকি স্বাভাবিক?
: স্বাভাবিক।
: দেখতে যাবে না?
: যাব। অফিস থেকে আধঘণ্টার ছুটি নিয়ে ক্লিনিকে ঘুরে আসব।
: ঠিক আছে। আমাকে যেতে হবে?
: না তুমি গিয়ে কী লাভ? তুমি বাসায় থাকবে। বিশ্রাম দরকার।
: জ্বি আচ্ছা।
২.
: ভাগিনাকে দেখতে গিয়েছিলে?
: হঁ্যা, সকালে ক্লিনিকে ঢু মেরে এলাম।
: বাবুটা কেমন হয়েছে। খুব সুন্দর, তা-ই না?
: হঁ্যা। তোমার রিটা আপু কোলে করে এনেছিল আমার সামনে।
: ভেতরে ঢোকোনি?
: সেখানে আম্মা ছিল!
: উনি এসেছেন?
: সকালে এসেছেন মনে হয়।
: তো ক্লিনিকে আর কারা ছিলেন?
: কেন রিটা। পাপড়ির স্বজনেরা।
: আপনি আম্মুর সঙ্গে কথা বলেননি?
: না, আমার লজ্জা লাগছিল। তা ছাড়া এ মাসে বাড়িতে টাকা দিতে পারিনি তো!
: তাই বলে এত দূর থেকে এসেছেন। কথা বলবেন না! ক্লিনিকে বিল কত এসেছে?
: আট হাজারের মতো।
: সাধারণ প্রসবে এত টাকা!
: আমাদের কী হবে? আলাহই জানেন। লাইনে পানি নেই, জমিদার বলেছেন ড্রাম কিনতে।
: কেন, আলাহ আছেন। কিনবে আর কি!
: শুধু ড্রাম দিয়ে হবে? পঁাচতলার ছাদে টিনের ছাউনির ঘর? বড্ড গরম। একটি পাখাও কিনতে হবে।
: কিনলে চার্জার ফ্যান কিনবে, বিদু্যত্ তো থাকেই না।
: সে তো অনেক দাম। তা ছাড়া চার্জ দেওয়ার মতো বিদু্যত্ থাকবে?
: কিন্তু একটি পাখা না হলে এই গরমে টিকব কেমনে।
: দেখি কী করা যায়। চাচা পাবেন আট হাজার। আগে সেটা শোধ করতে হবে।
: আচ্ছা আমাদের বাবু হলে কেউ দেখতে আসবেন না?
: কী জানি! আসতেও পারেন আবার নাও আসতে পারেন।
: আচ্ছা আমরা কি প্রেম করে খুব অন্যায় করে ফেলেছি?
: না, না। অন্যায় হবে কেন?
: তাহলে ওনারা যে আমাদের বিয়েটা সত্যিকার অর্থে মেনে নিতে পারেননি!
: থাক সেসব কথা। আসলে এ সমাজে প্রেমের বিয়ে এখনো মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি পুরোপুুরি চালু হয়নি।
৩.
: আমাদের যদি মেয়ে হয় নাম রাখব আনুশকা রাহমান প্রাচী। ছেলে হলে আবির রাহমান অভি বা আদি।
: না, আমার ছেলের নাম হবে আদর। আর মেয়ে হলে আদরণী। তোমাকে বলবে আদরের মা...।
: তাইজিন তো তোমাকে জরিনার মা বলে ডাকত! মেজভাবিকে বলত...।
: ওসব তো দুষ্টুমি করত। সত্যি সত্যি নয়।
: তাই নাকি! এখন ধৈর্য ধর।
: আগে তো সন্তান আলোর মুখ দেখুক। এখনো মাত্র তিন মাস!
: তা-তো বটেই। এর মধ্যে কত ঝড়-তুফান অপেক্ষা করছে। আরও সাত মাস কত কষ্ট করতে হবে তোমাকে।
: তাই বলে আগাম পরিকল্পনা করব না?
: কোরো, কে মানা করছে। তবে বেশি ভাববে না, শরীর-মন∏দুটোই আবার খারাপ হবে।
: আমার মেয়ের জন্য ছেলে শিক্ষক রাখব না। এমন কি ওকে একা রেখে কোথাও যাব না। সবসময় আমার সঙ্গে সঙ্গে রাখব।
: কেন?
: সেদিন কাগজে পড়লাম-
বাসায় শিক্ষক আসবে বলে দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে একা রেখে পরিবারের সবাই বাইরে গিয়েছিলেন। এসে দেখেন মেয়েটিকে ওই শিক্ষক ধর্ষণ করেছে।
: শিক্ষকই রাখতে হবে না। নিজেরা পড়াব।
: ওকে পড়াব অনেক নামীদামি বিদ্যালয়ে!
: না, ওকে পড়াব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাতে পড়ালেখার চাপ কম থাকবে।
: না। আমার বাবুকে পড়াব নানুর বাড়ির কাছের কোনো বিদ্যালয়ে। এতে সে আসা-যাওয়ার সময় সেখানে উঠতে পারবে। বিশ্রাম করতে পারবে। আমিও ছেলেধরা, পথ হারানো, ছিনতাইকারী, অপহরণকারীর দুশ্চিন্তা থেকে বঁাচব।
: মোটেই না। নানুর বাড়িতে বেশি গেলে পড়ালেখা গোলায় যায়। তা ছাড়া বেশি ঘন ঘন গেলে আদর পাবে না।
৪.
: শুনছো, পাশের বাসার বাবুটা না সারা দিন কঁাদে।
: কেন কঁাদে? ওর মা-বাবা আদর করে না। খেতে দেয় না বুঝি।
: কেন জানি সারাক্ষণ বাবুটি কঁাদে। আমার মনে হয় বাবুর মা বেশি আদর করছে না।
: ঠিক তা নয়। হতে পারে সংসারের কাজের জন্য বাবুকে বেশি সময় দিতে পারছে না। তা ছাড়া বাবু সামলানো বড় কঠিন কাজ।
: কঠিনের কী আছে?
: ছোট্ট বাবুরা তো কথা বলতে পারে না। ধরো পেটে ব্যথা লাগছে, বাবুটি তো আর বলতে পারে না Èমামণি! আমার পেট ব্যথা করছে।' তাই অনুভূতি প্রকাশের একমাত্র উপায় কান্না করা। তেমনি ধরা যাক∏বাবুর মাথাব্যথা, গিরা উল্টে যাওয়া, প্রশ্রাব করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলা, খিদে লাগা ইত্যাদি কারণে বাবুটি কঁাদতে পারে। এজন্য অভিজ্ঞজনদের সঙ্গে থাকলে বাবুর সুবিধা-অসুবিধা বোঝা সম্ভব।
: এসব ঠিক আছে। কিন্তু অনেকে বাবুকে বকা দেন, ভয় দেখান, নির্মমভাবে মারেন, এমনকি ভয়ানক শাসি্তও দেন।
: এটা অনুচিত। বিদেশে কোথাও শিশুদের শাসি্তর বিধান নেই। সেখানে শিশুদের আনন্দময় শৈশবের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
: গত ১৮ অক্টোবরের (২০০৯) দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় পিনাকি দাসগুপ্তের `মায়ের বকুনির ভয়ে' শিরোনামের সংবাদটি পড়েছ?
: না তো! কী লিখেছে?
: ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে
খেলতে গিয়ে তেলের পট ফেলে দেয় সাত বছরের তিন্না। মা কিছু না বলে তেল মুছতে থাকেন। তিন্না ভেবেছিল তেল মোছা হলে মা বকবেন। এ ভয়ে রাজধানীর মধ্য বাড্ডা থেকে মেয়েটি হঁাটতে হঁাটতে গুলশান, মহাখালী, ফার্মগেট পেরিয়ে পঁেৌছে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তখন রাত ১২টা। এরপর অনেক নাটকীয় ঘটনার পর এফ রহমান হলের ছাত্র রুহুল আমিন ও তার বন্ধু মোস্তাকের হাতে পড়ে তিন্না। পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিন্নার বাবা, বৈশাখী টেলিভিশনে কর্মরত নাজির হোসেন একমাত্র মেয়েকে খুঁজে পান।
: আহারে বেচারি তিন্নার ভাগ্য ভালো। কত দুর্ঘটনাই না ঘটতে পারত। ভাবলে গা শিউরে ওঠে।
: পাশের বাসার রাইসার মা কী করে শুনবে?
: কী করে?
: ছেলেমেয়েরা কোনো দোষ করলে শেৌচাগারের বাতি নিভিয়ে সেখানে আটকে রাখেন। আর ভয়ে তারা কান্নাকাটি করতে থাকে। যতক্ষণ ক্ষমা না চাইবে ততক্ষণ বন্দী থাকে তারা।
: বলো কী! এমন কথা তো আগে কোনো দিন শুনিইনি। একে তো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তার ওপর বাতি নিভিয়ে দেওয়া!
: আমার মেয়েকে আমি কোনো দিন বকা দেব না। এমনকি গায়ে হাতও তুলব না। আপনি কি ওকে বকা দেবেন?
: মাঝেমধ্যে শাসন না করলে কেমন হবে! তখন তো মাথায় উঠে বসবে।
: তাই বলে কিন্তু আমার মেয়েকে বেশি মারতে পারবে না। বকাও দিতে পারবে না। তাকে সবসময় হাসিখুশি রাখতে হবে।
: আগে তো মেয়ে হোক। তারপর দেখা যাবে। কী বলো?
৫.
: মা হচ্ছি বলে আমাকে তো কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাও না।
: এখন কী বেড়াতে পারবে। সামান্য হঁোচট খেলেই কত আপদ-বিপদ ওত পেতে আছে।
: যখন বাবু হবে তখন প্রতি বুধবার আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। আমি বাবুকে বলব, `এই বাবু, তোমার বাপ্পিকে বলো বেড়াতে নিয়ে যেতে।'
: আচ্ছা বেড়াতে নিয়ে যাব। এখন বলো তো আর কি করতে চাও বাবুর উসিলায়।
: আমাকে যখন টম অ্যান্ড জেরি, কিংবা মজার মজার অনুষ্ঠান দেখতে দেবে না তখন বাবুকে বলব, `বাবু! লক্ষ্মী সোনা আমার। তুমি এখন টম অ্যান্ড জেরি দেখবে। বাপ্পি থেকে রিমোটটি নাও তো।'
: আমি যদি রিমোট না দিই!
: বাবুকে চিমটি মেরে কঁাদাব। আর তুমি ভাববে ও রিমোটের জন্য কঁাদছে। তারপর সেটা দিয়ে দেবে!
৬.
: আমাদের সন্তানের নাম দেব-কিন্তু।
: না, ছেলে হলে নাম দেব আবির রাহমান অভি বা আদি, মেয়ে হলে আনুশকা রাহমান ঋতু।
: এসব হবে না। তুমি দেবে মূল নাম মানে আসল নাম।
: আর তুমি দেবে ডাকনাম।
: ঠিক আছে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক ডাক নাম হবে∏কিন্তু।
: বোলো কি! সবাই তোমাকে ডাকবে কিন্তুর বাবা!
: আর তোমাকে বলবে কিন্তুর মা।
: চলো না সদ্ধিান্ত বদল করি।
: কোন সদ্ধিান্ত?
: নাম রাখার ব্যাপারটা।
: মানে?
: তুমি আসল নাম দিলে হয় না!
: তুমি ডাকনাম দিতে চাও?
: হঁ্যা।
: না তা আর হয় না।
: ঠিক আছে আমার জন্য `সোনামণিদের সুন্দর নাম' বইটি নিয়ে আসবে।
: আনব।
৭.
: শুনছো, একটি কথা বলব?
: বোলো! তার আগে মামুন ভাইয়ের হাতপাখাটি নাও। যা গরম পড়ছে।
: আমাকে মাফ করে দিও। আমার জন্য তোমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সব ত্যাগ করতে হয়েছে।
: এসব আমার নিয়তি। আমি তো কারও ক্ষতি করিনি।
: তোমার মা-বাবা-ভাই-বোন সবাইকে বোলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে।
: এসব কথা কেন বলছো?
: আমার মনে হচ্ছে সন্তান প্রসবের সময় মারা যাব।
: তুমি যেখানে ভালো লাগে সেখানে ভর্তি হবে। যে ডাক্তার ভালো লাগে তঁার কাছে যাবে। টাকার জন্য ভাবতে হবে না। সব আমার দায়িত্ব।
: আচ্ছা আমাদের হাতে তো নগদ টাকা নেই।
: তাতে কী হয়েছে অলংকার আছে না? দরকার হলে সব বেচে দেবো।
৮.
: আমার খুব ভয় হচ্ছে। দেখতে দেখতে দিনটা তো কাছে চলে আসছে।
: কোনটি?
: ২৯ এপ্রিল।
: আসলে এটি সঠিক তারিখ নয়। সম্ভাব্য তারিখ। এর আগে বা পরে হবে। তৈরি থাকতে হবে।
: তা বুঝতে পারছি। তবে মনটা না কেমন কেমন করছে। যদি আর ফিরে না আসি?
: অমন কথা মুখে আনবে না। পিজ, আমার জন্য তোমাকে বঁাচতে হবে। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। এখন বিজ্ঞানের যুগ।
: ঠিক আছে আর বলবো না। কিন্তু আমার জন্য দোয়া কোরো। আমাকে দেখতে যাবে?
: কখন?
: নার্সিং হোমে!
: একদিকে চাকরি, বাসা পাহারা দেওয়া, পানি ধরে রাখা, রান্না করা। অন্য দিকে তুমি। দেখি...।