পাখিকে খাঁচায় বন্দী করে রাখলে কেমন ছটফট করে। ঠোঁট দিয়ে খাঁচার বাঁধন কেটে ফেলতে চায়। অবিরাম ডানা দুটি ঝাপটায়। মাথাকুটে সারাণ। মন হয় উদাস। মুক্তবিহঙ্গের মতো আকাশে হেসে খেলে উড়ে বেড়াতে পারে না। গহিন বনের ফলমূল খেতে পারে না। পাহাড়ি ঝরনার স্বচ্ছ পানি পান করতে পারে না। নিজের স্বজনদের আদর সোহাগ মেলে না। পায় না মায়া আর ভালোবাসা। মেলে না এতটুকু শান্তি-স্বস্তি। একদিন মুক্তি মিলবে-এমন আশায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। রাত পোহায়। তারপর রোগে শোকে কাতর হয়ে এক দিন মারা যায়। এ-ই হচ্ছে বন্দীজীবন। পরাধীনতার শৃঙ্খল। যেখানে বন্দী পাখির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা মন্দ লাগার কোনো মূল্য নেই। তাই তো কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৫-১৯১৮) অনেক বছর আগে লিখেছিলেন নিচের পঙ্ক্তিগুলো:
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে
কে পরিবে পায়।
একটা সময় ছিল আমরাও ছিলাম খাঁচায় বন্দী পাখির মতো। এককথায় পরাধীন। আমাদের স্বাধীনতা ছিল না। ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম ছিল না। যোগ্য হলেও ভালো চাকরি দেওয়া হতো না। পদে পদে অবহেলা, অমর্যাদা, অসম্মান করা হতো। অধিকার-বঞ্চিত করে রাখা হতো। আমরা সরকারকে কর-রাজস্ব বেশি দিতাম বটে কিন্তু সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ ছিল না পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি খাতে। তারা আমাদের শোষণ করত। অন্যায়ভাবে দোষ চাপাত। আমাদের দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করত। আমাদের টাকায় তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করত। তারা আমাদের মায়ের ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করতে সচেষ্ট ছিল। তারা আমাদের ঘৃণা করত। মনে করত আমরা তাদের দাস-ভৃত্য।
বলছিলাম পাকিস্তানআমলের কথা। তখন আজকের বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের একটি অংশ। হ্যাঁ, পূর্ব পাকিস্তান। আর পুরো দেশ শাসন করত পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তারা আমাদের ওপর অকথ্য জুলুম চালাত। আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চাইত না। আমরা সাধারণ নির্বাচনে জেতার পরও রাজ্য শাসনের ভার দিতে রাজি হচ্ছিল না। গড়িমসি করছিল। একদিকে আলোচনার নামে ষড়যন্ত্র করছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। অন্যদিকে বাঙালিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দানা বাধছিল। এভাবে এল একাত্তরের মার্চ। উত্তাল মার্চ।
৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিলেন ঐতিহাসিক ভাষণ। বজ্রকণ্ঠের ওই ভাষণ হয়ে উঠল অমর কবিতা। তিনি হয়ে গেলেন কবি। বিশ্বাস হয় না, তবে শোনা যাক কবি নির্মলেন্দু গুণের পঙ্ক্তিমালায়:
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
এই ভাষণ শোনার পর থেকে বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে আগুন ধরে যায়। তাঁরা ইস্পাত কঠিন শপথে তৈরি হতে থাকেন পাক বাহিনীর যেকোনো আক্রমণ-নাশকতা-হামলা প্রতিরোধের জন্য। এদিকে জেনারেল ইয়াহিয়া করল নতুন ফন্দি। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টি করা মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ে বলা হয়েছে
‘গণহত্যার জন্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ তারিখটা বেছে নিয়েছিল। কারণ সে বিশ্বাস করত এটা তার জন্য একটি শুভ দিন।’
ওই দিন বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছিল কালরাত্রি। ঢাকার বুকে পাকসেনারা চালায় ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ। গর্জে ওঠে তাদের কামান, মেশিনগান, রাইফেল, বেয়নেট। বয়ে যায় রক্তের শ্রোত। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি আর দোকানপাট। বাড়তে থাকে শহীদের মিছিল। আহতদের আর্তচিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। ছব্বিশে মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়। তারপরের ইতিহাস সংগ্রাম এবং যুদ্ধজয়ের।