আমাদের অগোচরে বদলে যাচ্ছে সব কিছু৷ শুধু অগোচরে নয়, চোখের সামনেই বদলে যাচ্ছে কত কী! হয়তো কেউ কেউ খেয়াল করেছেন৷ আবার অনেকে খেয়াল করছেন না৷ হতে পারে অমনোযোগিতা কিংবা ব্যস্ততার কারণে ফুরসত না মেলা৷ যাই হোক, সময় এবং নদীর স্রোতের মতো পরিবেশ-প্রতিবেশের বিবর্তন-পরিবর্তনও থেমে নেই৷ এটাই সত্য আমাদের দেখা বা না দেখার ওপর সব কিছু সমূলে বদলে যাওয়া নির্ভর করছে না৷ পথিক যেমন পথ সৃষ্টি করে তেমনি টিকে থাকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য এগিয়ে যেতে হচ্ছে সবাইকে৷
আমরা কি ল করেছি খবরের কাগজের পরিবর্তনগুলো৷ এই পরিবর্তনের মূল দায়িত্বটা কাঁধে নিয়েছিলেন সাংবাদিকেরা৷ নিরন্তর পড়াশোনা, বিদেশভ্রমণ, অভিজ্ঞতা-সঞ্চয়, কর্মশালা, প্রচেষ্টা আর পরীা-নিরীার মধ্য দিয়ে একালের সাংবাদিকতা ফুল, ফল আর সৌরভে বিকশিত হচ্ছে৷ সদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, সাফল্যের দিকে৷ যুগের সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে নিজেদের যুগোপযোগী করে নিয়েছেন-নিচ্ছেন তাঁরা৷ সংবাদ সংগ্রহ, সম্পাদনা, নথি সংরণ, উপস্থাপনা, মুদ্রণ-পরিবেশন আর বিপণনে আসছে বৈচিত্র্য৷ এর মূলে কাজ করছে কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদ৷ সংবাদপত্র (প্রিন্ট মিডিয়া) কিংবা প্রচারমাধ্যম (ইলেকট্রনিক মিডিয়া) দুটির বিকাশে সমানে কাজ করছে তথ্যপ্রযুক্তি৷ এতে হু হু করে বাড়ছে পাঠক-দর্শক৷ এককথায় গ্রাহক৷ আর যে গণমাধ্যমের গ্রাহক বেশি তার বিজ্ঞাপন বেশি, আয় বেশি, কদরও বেশি৷ এমন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদেরও আর্থিক ও প্রকৃত আয় তুলনামূলক বেশি৷ তাঁদের জীবনযাত্রার মান, মাথাপিছু আয় এবং সামাজিক প্রতিপত্তিও বেশি৷ এখানেই শেষ নয়, সমাজ-রাষ্ট্রে সেই গণমাধ্যমের প্রভাবও বেশি৷ এখন যে দেশে গণমাধ্যম যত বেশি শক্তিশালী-সাহসী সে দেশ তত দ্রুত উন্নততর হচ্ছে৷
আগে সংবাদপত্র বের করা হতো দেশসেবার জন্য, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের জন্য৷ এখন সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে শিল্প হিসেবে৷ পুঁজি খাটাব লাভ পাব_এমন ল্যে অবিচল সংবাদপত্রের মালিকেরা৷ লাভের প্রতিযোগিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংবাদপত্রসেবী৷ আগে সংবাদপত্রে কাজ করতেন সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্য, সেবার মনোভাব নিয়ে৷ ভাবনাটা এমন ছিল_দেশকে কিছু দেব৷ সমাজ আর সমাজের মানুষকে আলোর পথে পরিচালিত করব৷ যাবতীয় অশিা, অসংগতি, কুসংস্কার, অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার-নির্যাতন, চুরি-ডাকাতি, দুর্ভোগ, লাঞ্ছনা, সন্ত্রাস-অপরাধ নির্মূল করব লেখনী দিয়ে৷ এখন সাংবাদিকতা একটি লোভনীয় পেশা, স্বপ্নের চাকরি৷ বলা যায়, সোনার হরিণ৷ সাংবাদিকদের অকল্পনীয় প্রভাব বিস্তার তো আছে, তবে আসল সাংবাদিকেরা তেমন হম্বিতম্বি করেন না৷ তাই তো অখ্যাত কোনো কাগজের একটি কার্ডের মালিক হতে অনেক যুবক-তরুণকে মরিয়া হতে দেখি এ দেশে৷ তা ছাড়া একটু নাম কামালেই উচ্চবেতন, গাড়ি, বাড়ি, প্রতিপত্তি হাতছানি দিচ্ছে 'আয় আয়' বলে৷ অনেক কার্ডধারী সাংবাদিককে চিহ্নিত করা হয় রং দিয়ে৷ যেমন: হলুদ সাংবাদিক!
এখন আধুনিক সাংবাদিকতার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে অর্থ৷ অর্থ আছে তো কেনা যায় সর্বাধুনিক ছাপাখানা, সম্প্রচার যন্ত্র, দারুণ সব ব্রান্ডের কম্পিউটার, আধুনিক আসবাব, দ্রুতযান, ক্যামেরা, ফোন আর ইন্টারনেটসহ প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তি৷ নিয়োগ দেওয়া যায় প্রতিভাবান সম্পাদক, তুখোড় সাংবাদিক, সাহসী আলোকচিত্রী, শিল্পী, গবেষক, প্রদায়ক, কলামলেখক, আইনজীবী আর চৌকস কর্মকর্তা-কর্মচারী৷
আমাদের দেশে সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটেছে প্রধানত স্বাধীনতার পর থেকে৷ এক দিনে বা রাতারাতি পুরোপুরি বদলে যায়নি৷ ধীরে ধীরেই উত্তরণ ঘটেছে এ শিল্পের৷ আগেকার সাংবাদিকতা আর এখনকার সাংবাদিকতায় তফাতটা আকাশ আর পাতালের মতোই৷ যদি স্বাধীনতা অর্জনের আগের ও পরের কয়েকটি সংবাদপত্রের পাতা দেখার সুযোগ মেলে তবে বিষয়টি পষ্ট হবে৷ আমূল পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হবেন যে কেউ৷ কী ছাপা, কী কাগজ, কী অঙ্গসজ্জা, কী সংবাদ লেখা ও পরিবেশনের কায়দা_সব েেত্র এসেছে বৈচিত্র্য, চমকের ওপর মহাচমক৷ এসেছে বৈপ্লবিক জোয়ার৷ এখন রঙে, লেখায় আর রেখায় পাঠকের কাছে লোভনীয় হয়ে উঠেছে আধুনিক সংবাদপত্রগুলো৷ দেখলেই হাত বাড়াতে ইচ্ছে করে৷
আধুনিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিযোগিতা চলছে ভেতরে বাইরে৷ ভেতরের প্রতিযোগিতা পাঠকের অজানাই থেকে যায়৷ একটি পত্রিকা প্রকাশের পেছনে কত জনের শ্রম, মেধা, ঘাম জড়িত তা প্রতিষ্ঠানে নিবিড়ভাবে জড়িতরাই শুধু জানেন৷ সম্পাদক, প্রকাশক, বার্তা সম্পাদক, বিভাগীয় সম্পাদক, প্রতিবেদক, আলোকচিত্রী, প্রতিনিধি, সংবাদদাতা, সহসম্পাদক, সম্পাদনা সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, কার্যালয় সহকারীরা তো আছেনই আরও আছেন বিজ্ঞাপন ও বিপণন বিভাগের শত শত মানুষ৷ আছে সংবাদপত্রের এজেন্ট আর হকারদের অপরিসীম ভূমিকাও৷ অথচ পাঠকের পরিচিত শুধু সম্পাদক, প্রকাশক, প্রতিবেদক, আলোকচিত্রী আর লেখক-কলামলেখকেরা৷ কারণ তাঁদের নাম ছাপা হয় প্রতিদিনের কাগজে৷ বাকিরা সাধারণ পাঠকের অগোচরেই থেকে যান চিরকাল৷
বাইরের পরিবর্তনগুলো প্রতিফলিত হয় সংবাদপত্রের পাতায়৷ আর এ েেত্র ভালোমন্দের বিচার করেন পাঠক৷ কারণ পাঠক নগদ টাকায় কাগজ কিনে তারপর পড়েন৷ সংবাদ যদি পপাত দোষে দুষ্ট হয়, সাংবাদিক যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে লেখেন, কোনো বড় ঘটনা যদি এড়িয়ে যাওয়া হয়, দেশ-সমাজকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করা হয়, অশ্লীলতার জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়া হয়, কাল্পনিক মনগড়া কাহিনি তৈরি করা হয়, অপরাধীর সঙ্গে যদি কাগজের কারও ঘনিষ্ঠতা বা সখ্য থাকে, কাগজকে যদি রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় কিংবা দলীয় প্রচারপত্রে পরিণত করা হয় তবে সেই পত্রিকা পাঠক হারায়৷ পাঠক কমে গেলে বিজ্ঞাপন কমে যায়৷ আর বিজ্ঞাপন না পেলে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের লোকসানই হয়৷ কারণ এখন জাতীয় দৈনিকগুলোর মুদ্রণ খরচই পড়ে গায়ে লেখা দামের দুই-তিনগুণ বেশি৷ এভাবেই চলে আসছে সংবাদপত্রগুলোর উত্থান-পতন৷ একই অবস্থা বেসরকারি টেলিভিশন বা বেতারের েেত্রও৷ যার দর্শক কম তার বিজ্ঞাপনও কম৷ আয়ও কম৷ এ েেত্র বিজ্ঞাপনদাতা বা বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো অনেক সময় পরীা করেন কোথায় বিজ্ঞাপন দিলে কেমন সাড়া মেলে৷ বেশি পাঠক-দর্শকের কাছে বিজ্ঞাপন পেঁৗছানোর পর ওই পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়৷
আসলে আধুনিক সাংবাদিকতা বোঝার জন্য আমরা একজন মফস্বল সাংবাদিকের কাজের প্রতি নজর দিতে পারি৷ আগে একজন সাংবাদিক কোনো ঘটনার খবর পেতেন লোক মারফত৷ থানা, উপজেলা কার্যালয়, হাসপাতাল, হাটবাজারে ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করতে হতো৷ এখন মুহূর্তে মুঠোফোনে নিজের এলাকায় কী ঘটছে তা জানতে পারছেন৷ শুধু দরকার মানুষের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ৷ যাঁর যত বেশি সোর্স তিনি সাংবাদিক হিসেবে তত বেশি সফল হবেন, চমক দেখাতে পারছেন৷ এ েেত্র কোনো সংবাদ না পাওয়ার শঙ্কা থাকে না৷
এবার দেখা যাক সংবাদ পাওয়ার পর তিনি কীভাবে লেখেন৷ আগে তিনি নোটবই থেকে ভালো কাগজে লিখে নিজে শহরে এসে পত্রিকার কার্যালয়ে এসে জমা দিতেন কিংবা লোক মারফত প্যাকেট পাঠাতেন৷ প্যাকেট পাঠানো হতো ডাকযোগে কিংবা কুরিয়ার সর্ভিসে৷ এভাবে একদিকে সময়পেণ, অন্য দিকে অর্থনাশ হতো৷ এরপর এলো ফ্যাক্স করার আমল৷ এতে অস্পষ্টতার কিংবা লাইন ফ্রি না পাওয়ার বিরক্তি ছিলই৷ এখন একজন সাংবাদিক নিজের ডেস্কটপ কম্পিউটার বা ল্যাপটপে (পিসি) সংবাদ নিজে কম্পোজ করছেন৷ আগে ক্যামেরায় ছবি তুলে সেই রিল বা নেগেটিভ কিংবা জেলা শহরে গিয়ে ছবি পরিষ্কার করে সেই ছবি জামা দিতে হতো৷ এখন ডিজিটাল ক্যামেরায় সাংবাদিক ছবি তোলেন একের পর এক৷ তারপর কম্পিউটারে সেই ছবি ঢোকান৷ সেখানে বড় করে দেখেন, ছবি বাছাই করেন৷ ফটোশপে পরিমার্জন করেন৷ নিচে ছবির পরিচিতি লেখেন৷ তারপর সেই ছবি ও সংবাদ ই-মেইল করছেন নিজের প্রধান কার্যালয়ে৷ ডিজিটাল ক্যামেরা না থাকলেও বেশি মন খারাপের দরকার নেই৷ মুঠোফোনে ছবি তুলেও অনেকে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন৷ এ কাজে স্থানীয় কম্পিউটারের দোকান বা সাইবার ক্যাফেগুলো দারুণ ভূমিকা রাখছে৷ সংবাদটি পাওয়ার পর সহসম্পাদক ফোন করেন প্রতিনিধিকে৷ সংযোজন, বিয়োজন বা কারও বক্তব্য দরকার হলে নিয়ে নেন তিনি৷ পরদিন সেই সংবাদ ছাপা হয়ে সুদূর ঢাকা বা জেলা শহর থেকে পেঁৗছে যাচ্ছে ওই মফস্বলে৷ এভাবে সাংবাদিকতা এখন অনেক গতিশীল হয়েছে৷ এই গতিশীলতা বেসরকারি টেলিভিশন বা এফএম রেডিওর েেত্র আরও বেশি৷ মুঠোফোনেই দেওয়া হচ্ছে সংবাদ৷ মুহূর্তেই চলে যাচ্ছে অনএয়ারে৷ ইন্টারনেট স্বল্পসময়ে চলে যাচ্ছে ফুটেজ৷ আগে ফুটেজ পাঠাতে হতো বিমানে করে৷ অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো প্রচারমাধ্যম কমর্ীদের৷ এখন কাজ হয়েছে সহজ, দ্রুততর এবং নিশ্চিত৷
সামনে হয়তো আরও আরও গতিশীল হবে সাংবাদিকতা৷ সুন্দর হবে কাজের পরিবেশ৷ সুন্দর হবে সমাজ-দেশ৷ তবে সাংবাদিকদের তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে আগ্রহী হতে হবে৷ দ হতে হবে৷ তবেই পুরোপুরি সাফল্য আসবে৷
আল রাহমান: লেখক ও সাংবাদিক (০৯.০২.২০১০)