১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। একজন সাধারণ যোদ্ধার অসাধারণ কীর্তির সাক্ষী দিনটি। নিজের জীবন দিয়ে শত্রুপক্ষকে কুপোকাত করার এমন ঘটনা খুব বেশি শুনিনি আমরা। আর তাই জাতি এ মহান বীরকে শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব দিতে ভুল করেননি। বলছিলাম বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের কথা।
হামিদুর রহমানের জš§ ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। তাঁর গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার সীমান্তবর্তী খোরদা খালিশপুর। বাবা আব্বাস আলী মণ্ডল আর মা মোসাম্মাৎ কায়সুন্নেসার সংসারে ছিল অভাবের ঘনঘটা। হামিদুর শৈশবে ভর্তি হন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু ওই যে বলছিলাম অভাব, সেই কারণেই তাঁকে বিদ্যালয় ছাড়তে হয়। গ্রামের আলো বাতাসে ঘুরে-ফিরে হেসে-খেলে পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করে বেড়ে ওঠেন তিনি। (সূত্র: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রকাশিত শিশু বিশ্বকোষ চতুর্থ খণ্ড)
এভাবে আসে ১৯৭১। বাঙালির ইতিহাসে রক্তঝরা অধ্যায়। আবার বলা যায় সোনালি অধ্যায়। যাই হোক, হামিদুর রহমান ওই বছরের ২ ফেব্র“য়ারি যোগ দিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। তাঁকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিণের জন্য। এভাবে আসে পঁচিশে মার্চ কালরাত্রি। নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী। বাঙালি সৈন্যরা প্রতিবাদে সশস্ত্র লড়াই শুরু করেন। হামিদুর রহমানও ওই বাহিনীতে যোগ দেন। একফাঁকে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে হামিদুর রহমান হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ছিলেন জেড ফোর্সের সদস্য।
সেই দিনটির কথা। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চলছেন। উদ্দেশ্য সিলেটের শ্রীমঙ্গলের ১০ মাইল দেিণ পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি দখল করা। ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছে সবাই দেখলেন একটি হালকা মেশিন গান (এলএমজি) থেকে ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ। ওই মেশিন গানটি যেকোনো উপায়ে নিষ্ক্রিয় করতে না পারলে পুরো অভিযান বৃথা। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম ডাকলেন সিপাহি হামিদুর রহমানকে। ‘জীবন বাজি, স্যার’ বলে হামিদুর রহমান কী করতে হবে ভালোভাবে বুঝে নিলেন। এরপরের ঘটনাটি আমরা পড়ব ড. মাহবুবুল হকের বীরশ্রেষ্ঠদের কথা বইয়ের ২২ পৃষ্ঠা থেকে-
`অধিনায়কের আদেশ পেয়ে রক্ত তাঁর টগবগ করে উঠল। খুব সাবধানে শত্রুর চোখ এড়িয়ে বুকে হেঁটে তিনি এগিয়ে চললেন মেশিন গানটার দিকে।
এক মিনিট, দুমিনিট, তিন মিনিট...বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল। সিপাহি হামিদুর রহমান শত্রুর কাছে এসে পড়লেন। দেখলেন, এল. এম. জি-টার পেছনে রয়েছে দুজন শত্রুসেনা। একা দুজনকে কব্জা করতে পারবেন তো? এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন তিনি। কিন্তু মনে পড়ল অধিনায়কের নির্দেশ পালনের প্রতিশ্রতি `জীবন বাজি, স্যার।' মুহূর্তেই হামিদুর রহমান গুলি চালাতে চালাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রু দুজনের ওপর। শত্রু দুজন নিহত হল। কিন্তু তিনিও শত্রুর গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
শত্রুর মেশিন গান থেমে গেল। সাড়া পড়ে গেল মুক্তি সেনাদের মধ্যে। ঝড়ের গতিতে তারা দখল করে নিল দুর্ভেদ্য ধলই সীমান্ত ঘাঁটি।'
এ বীরশ্রেষ্ঠকে প্রথমে প্রতিবেশী দেশ ভারত সীমান্তের আমবাসা গ্রামে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতা লাভের ৩৬ বছর পর তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে এনে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনরায় দাফন করা হয়।
সিপাহি হামিদুর রহমানের এ আÍত্যাগ ভোলেনি জাতি। তাঁকে দিয়েছে বীরশ্রেষ্ঠের সম্মান। তিনি আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠের একজন।
অনেকটা নীরবেই চলে গেল তাঁর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। সরকারি কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ঝিনাইদহের হাট-খালিশপুরে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান কলেজ কর্তৃপ, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতি সংরণ পরিষদ ও তাঁর পরিবার এ বীরকে স্মরণ করেছে। প্রায় দুবছর আগে এ মহান বীরের নিজ গ্রামের নাম খোর্দ্দ-খালিশপুরকে হামিদনগর করে সরকার। কিন্তু তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত করা হয়নি। জানা গেছে, গেজেট না পাওয়ার অজুহাতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এখনো আগের নামটিই ব্যবহার করছে। (সূত্র: প্রথম আলো ২৮ অক্টোবর ২০০৯)
আশা করব বীরের গ্রামটির নতুন নামকরণ সার্থক হবে। সবাই সচেতন হবেন নামটি ব্যবহারে।
আমরা এ বীরশ্রেষ্ঠের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। ##