এভাবে সম্পর্কে ফাটল ধরবে দুজনের কেউই ভাবেনি। এত দিনের গভীর প্রেম! চেনাজানা মানুষ আচানক এতটা বদলে যেতে পারে? চিরচেনা মানুষ পুরোপুরি অচেনা হতে পারে? হ্যাঁ, এটা ঠিক মানুষ মরে গেলে পচে যায়; বেঁচে থাকলে বদলায়। কিন্তু রানা-রানি এত তাড়াতাড়ি এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসল!
অথচ বিয়েটা হয়েছে অনেক বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে। কত ঝড় তুফান গেছে রানা-রানির মাথার ওপর দিয়ে! কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিল দূরের মানুষ। আড়ালে আবডালে কত কথা। কত গুঞ্জন। কত ষড়যন্ত্র বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য। পকেটের টাকা খরচ করে কয়েকজন নিকটাত্মীয় তো একপায়ে খাড়া হয়েছিলেন। কিন্তু দুজনের কঠিন দৃঢ়তার মাঝে বালির বাঁধের মতো সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেছে। সবাই অবাক হয়ে উপলব্ধি করেছে তাদের প্রেমের গভীরতা। জুটি বাঁধা আর জোট বাঁধিয়ে দেওয়া এক কথা নয়Ñবুঝিয়ে দিয়েছে তারা। এরপরও অনেক ঘটনার ঘনঘটা যে ঘটেনি তা নয়।
বিয়ের অনুষ্ঠানে রানির মাকে গিয়ে একজন বললেন, ‘তোমার মেয়ের হাতে-কানে-গলায় কোনো অলঙ্কার নেই। ছেলেপ কিছু দেয়নি বুঝি।’ আরেকজন এসে বললেন, ‘একটা কথা না বলে পারছি না। ছেলেটা তো বুড়া। তোর মেয়েটা কচি। প্রথম দিনই বাসরঘরে পাঠাবে নাকি। রক্তপাত হবে না তো আবার।’ রানি সব শুনেছিল। তখন মনে মনে বলেছিল, ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি!’ আমার রানা যা দিয়েছে তা যথেষ্ট। তোদের এত ভাবনা কীসের?
এর কিছুণ পরের ঘটনা। বিয়ের অনুষ্ঠানেই রানার মাকে পইপই করে রানির খালা বলে দিয়েছিল-
: বেয়াইন, একটা কথা বলব?
: অবশ্যই, বলুন!
: কিছু মনে করবেন না তো?
: না, না মনে করার কী আছে।
: আজ রাতটা রানিকে আপনার কাছে রাখবেন। কাল সারারাত গায়েহলুদের হাঁকডাকে মেয়েটা কাহিল হয়ে গেছে। গানবাজনা, হৈহুল্লোড়, চেঁচামেচিতে একটুও ঘুমোতে পারেনি। পরদিন থেকে রানার ঘরে দেবেন।’
: সেটা আমিও ভেবেছি। এখনই তো ১২টা বাজে। বাকি রাতটা রানি আমার সঙ্গে শোবে।
রানার মা কথাটা পেড়েছিলেন বউ নিয়ে আসার সময় মোটরযানে। রানা, রানি আর তিনি বসেছিলেন গাড়ির পেছনের আসনে। চালকের পাশে ছিল রানার ছোট বোনের স্বামী।
: তোর খালা শাশুড়ি বলেছেন রানিকে আজ রাতে আমার সঙ্গে রাখতে।
: তা-তো বটেই। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। সেটাই ভালো হবে।
: না তোকে বলছি এ জন্য যে, তাঁরা বিষয়টা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন তো তাই!
: ঠিক আছে তাই হোক!
রাত একটায় বউ নিয়ে বাড়ি পৌঁছা। পোড় খাওয়া রানার মা ছেলের বউকে ঘরে ঢোকালেন অনেক লোকজ আচার মেনেই। ডান পা আগে দিতে হবে। কাঁথা দিয়ে চেপে ধরতে হবে। সবার মুখে একটু একটু চিনি তুলে দিতে বলা রানিকে। বিয়ের শাড়ি বদলে দেওয়া। এরকম কত শত আয়োজন চলছিল রাতভর। একসময় নিস্তেজ শরীর নিয়ে ঘুমকাতুরে রানা শুয়ে পড়েছিল বসার ঘরে সোফার ওপর। এভাবে বিয়ের রাতটি কাটে তাদের।
পর দিন বাসরঘরে রানিকে একা পাবে রানা। এতে দারুণ উত্তেজনা তার ভেতর। মেহমান-নায়রিদের কেউ কেউ বিদায় নিচ্ছেন। ফাঁকা হচ্ছে বিয়েবাড়ি। জলুস কমছে ধীরে ধীরে। রানা একফাঁকে উঁকি দিল রানির ঘরে। বোনেরা সরে গেল রানাকে দেখে। শুরু হলো দুজনের ফিসফিসানি-
: শুভ সকাল, রানি!
: কেমন আছেন? রাতে কোথায় ছিলেন?
: ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
: মাশাআল্লাহ ভালো। কোথায় ছিলেন বললেন না তো!
: বসার ঘরের সোফায়। তা তোমার কেমন কাটল। কিছু খেয়েছ?
: বেশ আছি! একসঙ্গে নাশতা করব বলেছিলাম।
: তাই নাকি। ঠিক আছে এখনি বলছি নাশতা দিতে।
: একটা কথা বলব আপনাকে?
: মাত্র একটা কথা! তুমি হাজারটা কথা বলবে। আমি শুনব।
: সত্যি!
: হ্যাঁ সত্যি!
: ঠিক আছে বলছি। শুনুন তা হলে। ছোট খালামণি বলেছেন বাচ্চাকাচ্চা নিতে না চাইলে কনডম ব্যবহার করতে হবে। আপনি বাজারে গেলে নিয়ে আসবেন?
: ওহ! এ কথা। এগুলো কার জন্য? কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা তো জানি না!
: সর্বনাশ, বলেন কী!
: সত্যি বলছি। আমার এ ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
: অবশ্য আরেকটা উপায় আছে, বলব?
: বলো!
তখনি শোনা গেল ছোটবোনের ডাক, ‘ভাইয়া, টেবিলে নাশতা দিয়েছি। ভাবিকে নিয়ে আসেন!’
এরপর সারা দিন আর একান্তে কথাবার্তা হয়নি। পাড়ার মানুষ বউ দেখতে আসছেন। হাজার হোক শহরের মেয়ে গ্রামে এসেছে। তা ছাড়া বিয়ের কার্ডে বর-কনের ছবি দেখে অনেকে বিশ্বাস করতে পারেননি এত সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে পারে রানা। বিকেলে বাজারে গিয়ে রানা একটি জেলি, একটি সস, কিছু আচার আর এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনল রানির জন্য। রাত নয়টায় আবার ভাতের টেবিলে দেখা।
ঘড়ির কাঁটা একসময় ১০টার ঘর পেরোয়। নিঝুম গাঁয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সুনসান নীরবতা। বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার। মনে হচ্ছে ভুতুড়ে পল্লী। বসার ঘরে রানার বিশাল বইয়ের সংগ্রহ। আছে দৈনিক কাগজ আর অনেক সাময়িকী। আনমনে পাতা উল্টাচ্ছিল রানা। অমনি দরজার আড়াল থেকে ডাক দিলেন মেজভাবি। যাকে আড়ালে রানা ডাকে ‘নবাবজাদি’। মনে মনে বলে ‘হারামজাদি’। মানে বড় হলেও মেজভাবির বয়স রানার অর্ধেকের মতো হবে। সংকোচের কারণে রানার সঙ্গে তেমন কথাবার্তা হয় না। টুকটাক অনিয়মিত কথাবার্তা চলে। বয়স যাই হোক রানার বিশ্বাস মেয়েটা খুব চালু মাল। বেকুব টাইপের হলেও ভেতরে ভেতরে অনেক চালাক সে। সে যাই হোক ‘আসছি’ বলে উঠে পড়ল রানা।
শৌচাগারে হাত-মুখ ধুয়ে তলপেটের চাপ কমিয়ে দুরুদুরু বুকে রানির ঘরে গেল রানা। অর্ণব থেকে কেনা বিয়ের ১২ হাজার ৫০০ টাকার খয়েরি শাড়িটা পরে বিছানায় বসে আছে রানি। বিয়ের অনুষ্ঠানে পার্লারের অতিরিক্ত সাজ রানার মোটেও ভালো লাগেনি। কিন্তু এখন দারুণ লাগছে রানিকে। একটি টেবিলে কয়েকটি মিষ্টি। আপেল, কলা। একটি জগ আর একটি গ্লাস। আলনায় এলোমেলো রানির শাড়ি। ঘরময় চমৎকার সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে। এ গন্ধ কী ছয় বছরের চেনাজানা রানির শরীরের নাকি দামি পারফিউমের! শাড়ির আঁচলটি বিছানো ডানপাশে। সেদিকে ইঙ্গিত করে মুরুব্বিয়ানা কণ্ঠে বলল ভাবিÑ
: পাঞ্জাবি পরে শাড়ির আঁচলে দুরাকাত নামাজ পড়–ন।
: এসবের কী দরকার ছিল। এত দামি শাড়ি। আমার ভারে তো সব পাথর-পুতি-চুমকি নষ্ট হয়ে যাবে।
: এটা নিয়ম। তাড়াতাড়ি নামাজ শুরু করুন।
জো হুকুম বলে শাড়ির আঁচলে দাঁড়াল রানা। নামাজ শেষ করার আগেই দুষ্টু চোখে একপলক তাকিয়ে দরজা টেনে দিলেন ভাবি। এখন ঘরে শুধু দুটি প্রাণী। কে কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাংলা চলচ্চিত্রের মতো এ বাসরে ফুলের সাজ নেই। নেই কোনো জমকালো আয়োজন। তারপরও যেন তারা মহাসুখী। মনে পড়ছে দুজনের তরী কত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ভিড়েছে কূলে। অকূল সাগরে কূল পেয়েছে দুজন। কত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে ঘুরপাক খেতে খেতে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া। একে অপরের কাছে আসা। পরকে আপন করে নেওয়া। কত অপোর প্রহর গুনেছে এ মুহূর্তের জন্য। ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে একসময় রানার দুপায়ে রানির হাতের ছোঁয়া লাগে। পুলকিত হয় রানাÑ
: না না একি করছ!
: ভাবি বলেছেন, সালাম করতে হবে। নইলে স্বামীর অমঙ্গল হয়।
: মঙ্গল-অমঙ্গল প্রকৃতির লীলা। এতে মানুষের কোনো ভূমিকা নেই।
: মা-বাবা-ভাই, আত্মীয়-স্বজন এমনকি শহর ছেড়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি আমাকে দেখেশুনে রাখবেন-কথা দিন।
: তুমি কি বোঝ না, তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়। মাছ যেমন জল ছাড়া বাঁচতে পারে না তেমনি তুমি ছাড়া আমার বাঁচা হবে না।
: সেটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তারপরও আমাকে কথা দিন, প্লিজ!
: কথা দিলাম। তবে তোমাকেও কথা দিতে হবে বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না।
: আমিও কথা দিলাম। জীবন গেলে যাবে কিন্তু বিশ্বাসের অমর্যাদা করব না।
এরপর রানার মনে পড়ে সবুজের কথা। যে বন্ধুটি নাকি বিয়ের পর বউয়ের সারা শরীরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়েছিল। রানা কি তেমনটি করবে। নাকি গল্পগুজব করবে-বুঝে ওঠার আগেই রানি বিছানায় কাত হলো। আসলে বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে থাকতে তার পায়ে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। অমনি রানা পাশের বালিশে হেলান দিয়ে কথা শুরু করতে চাইল। কিন্তু রানির চোখ বোঁজা দেখে দুষ্টুমি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তার ঠোঁট ছোঁয়াল রানির কপোলে। চমকে ওঠল রানি। বলল-
: বাতি না নিভিয়ে কেউ এমন বেহায়াপনা করে!
: আমার বউকে আমি যেমন খুশি তেমন করব। কার কী!
: তাই বলে বাতি না নিভিয়ে! আমার বুঝি শরম করে না।
: ঠিক আছে নিভিয়ে দিচ্ছি।
এরপর উত্তেজনায় কে কী করেছিল, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল কারও মনে নেই। এমনকি সময় কত হয়েছিল তা-ও দেখার গরজ অনুভব করেনি কেউই। এভাবে একদিন বিয়ের একসপ্তাহ ছুটি শেষ হয় রানার। কিন্তু কেউ জানত নাÑরানা রানির আরেক অধ্যায়ের খবর।
রানির বিয়ের ফুল তখনো শুকোয়নি। হাতের মেহেদিরংও মোছেনি। বাসরঘরের স্বাদ বলুন আর সাধই বলুক-খুঁজে পায়নি তারা। রানা অবশ্য বহু কাক্সিত অচেনা পথটি খুঁজে পেতে কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু রানি তো ‘রক্তপাত হবে’, ‘আমি ব্যথা পাচ্ছি’, ‘ও মাগো, ও বাবারে’, ‘দোহাই এখন আর নয়’, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে’ বলে রানাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে। এ লড়াই চলেছে দিনের পর দিন। রানা যতই সক্রিয় হয় মোষের মতো ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয় হতো রানি। রানা সাহস দিতÑ
: রানি কিচ্ছু হবে না। তুমি ভয় পেয়ো না।
: না, এখন নয়। আর কটা দিন যাক। বিশ্বাস করুন খুব কষ্ট পাচ্ছি।
: কী যে বলো না তুমি। দুনিয়ার কোটি কোটি মেয়ে প্রথম প্রথম এসব কষ্ট সহ্য করেছে না!
: না আমি পারব না। প্লিজ।
: তুমি আমাকে বিশ্বাস করো ব্যথা পেলে আমাকে বলবে। আমি আর ব্যথা দেব না।
: আপনি জোর করছেন কেন?
: জোরের বিষয় নয়। তোমাকে কেউ মিথ্যে ভয় দেখিয়েছেন। একবার হয়তো সামান্য ব্যথা পাবে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনকি তুমি তখন আরও বেশি বেশি চাইবে।
: আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ব্যথা পেলে কিন্তু চিৎকার দিব। আপনি ওড়নাটি হাতে রাখুন। মুখ চেপে ধরতে পারবেন।
: তার আর দরকার নেই। তুমি দেখো তোমার ভালো লাগবে। আরাম লাগবে। আর তোমাকে আমি কষ্ট দেওয়ার জন্য এখানে আনিনি।
এভাবে কত দিন, কত রাত গেছে মনের সঙ্গে মনের, বনের বাঘের আগে মনের বাঘের সঙ্গে লড়াই করে। সে কাহিনী দুনিয়ার কেউ জানে না। জানতে চায়ওনি কেউ। এ কথা সত্য এসব গায়ে পড়ে কারও সঙ্গে আলাপ করার মতো বিষয়-আশয়ও নয়।
আসল কাজ ছাড়াই অনেকটা বিনা দোষে প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও লোকলজ্জার ভয়ে প্রতি সকালে øান করেছে রানা। রাতে একসঙ্গে ছিল-এ অপরাধেই যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা-বাবার একমাত্র আদরের কন্যা, রানি বরফশীতল পানিতে গা ধুয়েছে। এতে দুজনেরই সর্দি-কাশি-মাথাব্যথা লেগেই ছিল। কথায় কথায় হাসতে হাসতে কাশত দুজন। তখন রানার বাবা বলতেন, ‘রানা, বউমাকে একপাতা হিসটাসিন এনে দিস!’
রানির শাশুড়ি জোরগলায় জবাব দিতেন, ‘হিসটাসিন বাসায় আছে। কিনতে হবে না।’
এভাবে দিন যায়। সপ্তাহ যায়। মাস যায়। কিন্তু রানার পরে লোকজনের স্বপ্ন পূরণ হয় না। তাঁরা দেখেন রানির ঘরে এলোমেলো প্যাকেটে স্যানিটারি ন্যাপকিন। তাঁরা দেখেন রানির শরীরে কোনো পরিবর্তন হয়নি। রানিকে শুনিয়ে শুনিয়ে শাশুড়ি পড়শিদের বলেন, ‘দোয়া করবেন যেন রানার ছেলে হয়!’
পড়শিরা শাশুড়িকে দেখলেই বলেন, ‘সেজ বউয়ের কী খবর!’
এসব শুনলে রানির মাথা আলুথালু হয়ে যায়। অল্প বয়সে বিয়ে করা উচিত নয়। অল্পতে পোয়াতি হলে বিপদ। অনেকে প্রসবের সময় মারা যায়। হরহামেশা এসব টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। কিন্তু সমাজে এর খুব বেশি প্রভাব পড়ছে কই? মনে কষ্টের দলা পাকে। বুকে কলজেটা মোচড় মারে। কাকের কা-কা রবে শিহরিত হয় রানি। দিন যায় রাত আসে। কখনো একা থাকার জ্বালা আবার কখনো পরের খোঁচার যন্ত্রণা। তিলে তিলে শেষ হয় রানির মুখের হাসি। চিন্তার বলীরেখা দেখা যায় তার সুন্দর কপোলে। কৃষ্ণ তিলকের মতো তাঁর মুখে দেখা দেয় ব্রন। খেতে ইচ্ছে হয় না। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। এভাবে বেঁচে থাকা দায়। একজীবনে এমন দুঃখ পাবে তা রানির ধারণাতেই আসেনি। তার সব স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
আশার কথা, এখনো রানির প্রাণের মানুষটি তো আপন হয়ে আছে। জোর জবরদস্তি তো আর করছে না তার ওপর। শিতি ছেলে বলেই হয়তো দু-আড়াই মাস ধৈর্য ধরেছে। নইলে বাঘ কি হরিণ শিকার করে মাংস না খেয়ে দূরে সরে যায়! খারাপ মানুষ হলে কবেই রানির সব ফাটিয়ে ফেলত। এমনকি প্রবাসী স্বামী হলেও রানি এমনভাবে রেহাই পেত না। বিয়ের প্রথম রাতেই বাসরঘর সাজিয়ে রাখত। তারপর ফিরাতে শোনা যেত খাটের খ্যাঁচ খ্যাঁচ শব্দ। বান্ধবীরা বলত, অনেকে তো নাকি দিনেও ছাড়ত না বউদের। এসব ভাবলে বলা যায়, রানি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। এটা নিশ্চিত তার স্বামী রতœটি তাকে বুঝতে চেষ্টা করে। অবশ্য বড়লোক ঘর এসেছিল রানির জন্য। কিন্তু বড় লোকের ঘরেও তো সুখ নেই। টাকার খেলায় কত নারী অসহায় হয়ে পড়েছে তার কোনো হিসাব নেই। কেউ কেউ আভিজাত্যের গৌরবে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফেরে। কেউ কারণে-অকারণে বউ কিলিয়ে সুখ পায়। আবার কেউ বস্তিবাসীর মতো চারটি বিয়ে করে দাসির মতো ব্যবহার করে। মৌমাছির মতো এক ফুলের মধু খাওয়া শেষ হলে আবার আরেক ফুলের সর্বনাশ করে। নিজের চোখেই তো কত দেখেছে। সংসার বড় কঠিন জিনিস। দুনিয়াটা বড় আজব জায়গা। এখানে কখন কী হয়, কী হতে কী হয় বোঝা বড় দায়। না আর ভাবতে পারে না রানি। কপালে যা আছে তা-ই হবে।
অথচ বিয়ের আগে কত স্বপ্ন বুনেছিল তারা। কত আনন্দ আর হইচই হবে। রাশি রাশি কত হাসি ছড়াবে। মনে রাখার মতো কত গান গুনগুন করবে। শুভাকাক্সী-স্বজনদের আদর সোহাগ আর øেহডোরে আলোকিত হবে চারপাশ। মধুচন্দ্রিমায় যাবে দূরে কোথাও। যেখানে মায়ের শাসন থাকবে না। শাশুড়ির চোখ রাঙানি থাকবে না। শুধু থাকবে শরতের বিকেলের নীল আকাশ, সাগরের নীল জল, পাহাড়ের মতো উঁচু ঢেউ, গহিন বন। আর থাকবে রানা।
ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের যে ফারাক তার সমীকরণ জানা ছিল না রানা-রানির। শুধু ভালোবাসা দিয়ে সুখ ও শোকের মরীচিকার মতো এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকা যায়! কোন পথে গেলে মুক্তি মেলে সেই পথের খোঁজ কে দেবে এ দম্পতিকে। কে দেবে তাঁদের সুখের ঠিকানা যেখানে কোনো বিড়ম্বনা নেই। আসলে তেমন কোনো পথ বা ঠিকানা জানা আছে কারও? প্রতিণ ভাবে রানা-রানি, যারা হতে পারত আরব্য উপন্যাসের চেয়েও ভালো নায়ক-নায়িকা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:৫০