পৃথিবীতে সব মানুষকেই বিভিন্ন সময়ে নানা মানসিক চাপ বা পীড়ন (Stress) মোকাবেলা করেই বেঁচে থাকতে হয়। পৃথিবীতে একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যার কোন না কোন সমস্যা নেই, যার কারণে সে মানসিক চাপে ভোগে না। প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া বা ডিভোর্স, প্রিয়জনের মৃত্যু, অসুস্থতা বা কোন সমস্যা, আর্থিক দৈন্য, সন্তানের পড়াশোনার চাপ বা বখে যাওয়া, বেকারত্ব, ভুল বোঝাবুঝি বা স্বার্থের কারণে কারো সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়া, নিজের কোন ব্যর্থতা বা অপ্রাপ্তি, বিভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলা (যেমন - কাজের চাপ বা বদলি, শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সাথে বনিবনা না হওয়া, ব্যবসায় লোকসান, কারো সাথে শত্রুতা, দূর্ঘটনায় অঙ্গহানি, পেশাগত কারণে পরিবার ছেড়ে থাকা, একাকীত্ব) ইত্যাদি হাজার কারণে আমরা মানসিক চাপ অনুভব করি। মানসিক চাপ আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অনেক মানুষ খুব সহজেই এই মানসিক চাপ সামাল দিতে পারেন। যাঁদের আত্মবিশ্বাস বেশী, তাঁরা মানসিকভাবে খুব সবল হন। ফলে যেকোন নেতিবাচক অবস্থা মোকাবেলা করতে তাঁদের সমস্যা হয়না। তাঁরা তীব্র মানসিক চাপেও ভালো থাকেন, ভেঙ্গে পড়েন না।
অন্যদিকে, যাদের আত্মবিশ্বাস কম, যারা স্বার্থপর ও অনুদার (সবসময় নিজের সুবিধার কথা ভাবেন এবং অন্যের সুবিধার কথা ভাবতে চাননা) , সারাজীবন পরনির্ভরশীল, অলস, অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ বা নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ কম, মানসিকভাবে খুব দূর্বল ও ভীতু প্রকৃতির, বিপদে শান্ত থাকতে পারেননা, সামান্য সমস্যাতেই ভেঙ্গে পড়ে হূলুস্থুল বাধান।
কিছু কৌশল আছে যেগুলো জানা থাকলে মানসিক চাপ কমাতে বা দূর করতে সেগুলো আপনাকে ভীষণভাবে সাহায্য করবে। যথা :
১। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক চাপ জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হবার কারণ হলো আমাদের ইগো। ইগোর কারণেই আমরা নিজের দোষকে লঘু ও অন্যের দোষকে বড় করে দেখি। ইগোর কারণেই আমরা সবসময় প্রত্যাশা করি, অপরপক্ষ আগে সমস্যা মেটাতে এগিয়ে আসুক বা সরি বলুক। তাই ইগো ত্যাগ করুন। আপনি নিজে কোন দোষ বা ভুল করলে নির্দিধায় আগে সরি বলুন। তৎপর হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সমস্যার সমাধান করুন। কারণ মানসিক চাপ সবার দেহ ও মনের জন্য ক্ষতিকর।
২। যে সমস্যা, সম্পর্ক বা পরিস্থিতি আপনার মানসিক চাপের কারণ এবং যার সমাধান সম্ভব নয় (যেমন - স্বামী যৌতুক লোভী বা নির্যাতক হলে, স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়ায় আসক্ত হলে, মাদকাসক্ত হলে ইত্যাদি), তাহলে সে সমস্যা, সম্পর্ক বা পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক হোন। যে সম্পর্ক আপনাকে কষ্ট দেয়, শুধুমাত্র সামাজের নিন্দার ভয়ে সে সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয়না। কিছু পরিস্থিতি বদলানো যায়না (যেমন - প্রিয়জনের মৃত্যু), মেনে নিতে হয়। তাই তাড়াতাড়ি মেনে নিন। মনে রাখবেন, কারো জন্যই, কোন কিছুর জন্যই জীবন থেমে থাকেনা।
৩। মন থেকে মেনে নিন যে, সমস্যা সবার জীবনে হতেই পারে এবং কোন সমস্যাই চিরস্থায়ী নয়। মানসিক চাপে বিচলিত না হয়ে স্থির থাকুন এবং কার্যকর সম্ভাব্য সমাধান বেছে নিতে প্রয়োজনে কোন প্রিয়জন, বন্ধু বা এক্সপার্টের সাহায্য নিন।
৪। বেকার বসে থাকলে মানসিক চাপের তীব্রতা বাড়ে। তাই আপনার পছন্দের যেকোন কাজে (যেমন - গান শোনা, বই পড়া, সিনেমা দেখা, লেখালেখি করা, ছবি আঁকা, বন্ধু বা প্রিয়জনের সাথে কথা বলা, বেড়ানো বা একসাথে কোথাও আড্ডা দেয়া, শপিং করা, বাড়ী সাজানো, আপনার পছন্দের কোন খাবার রান্না করা, সাজগোজ করে পছন্দের কোন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, বাগান করা ইত্যাদি) নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন করুন, দূরে কোথাও বেড়াতে যান। কখনও কখনও কিছু সময়ের জন্য মানুষের একা থাকা বা নিজেকে সময় দেয়া জরুরী। তাতে পরিস্থিতি বুঝতে সুবিধা হয় এবং একঘেঁয়েমি কাটে। আপনি তাতে সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য মানসিক শক্তি ফিরে পাবেন। পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক খাবার, শরীরচর্চা করে নিজেকে ফিট রাখা, নিয়মিত নিজের বিনোদনের জন্য কিছু করা, কারো প্রতি ক্ষোভ জমিয়ে না রেখে সবসময় হাসিখুশী থাকা - এগুলো মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
৫। বুদ্ধিমান মানুষরা কোন না কোন কৌশল বের করে যেকোন সমস্যার সমাধান করে ফেলেন। তাই মানসিক চাপ সামলাতে আপনার বুদ্ধিকে কাজে লাগান। ভেবে বের করুন, আপনার মানসিক চাপের কারণ কি এবং সে চাপ থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাব্য উপায়গুলো কী কী? তারপর উপায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়টি প্রয়োগ করে সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে মানসিক চাপ দূর করুন।
৬। যে অবস্থা আপনার মানসিক চাপের জন্য দায়ী, সেটির বিপরীত অবস্থা নিয়ে ভাবুন। (যেমন - অত্যাচারী স্বামীর অবর্তমানে আপনি এখন যেমন আছেন, তারচেয়ে ভালো থাকতে পারবেন কিনা, না পারলে কি করে পারা যায়, সেই উপায় নিয়ে ভাবুন। সন্তান পরীক্ষায় খারাপ করেছে বা বখে গেছে, কি করলে তাকে ভালো ফল করাতে বা সুপথে ফেরাতে পারবেন, তা ভেবে বের করুন। ব্যবসায় লস হয়েছে। কি করলে লাভ করতে পারবেন, তা নিয়ে চিন্তা করুন ইত্যাদি। ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন। ভুলের পুণরাবৃত্তি করবেন না।) তাতে মনে জোর পাবেন। মানসিক চাপ কমে যাবে।
৭। আপনার জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাবুন এবং সেগুলো মনে করে নিজেকে সন্তুষ্ট করুন। এতে আপনার শরীরের কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমে যাবে। ফলে এটি আপনার মানসিক চাপ কমাবে।
৮। চাপমূলক পরিস্থিতিতে যুক্তি দিয়ে ভাবুন এবং আবেগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করুন। হতাশ হবেন না। সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করুন। নেতিবাচক চিন্তা মাথায় এলে তাকে পাত্তা দেবেন না। জেনে রাখবেন, আপনার চেয়ে শতগুণ বেশী সমস্যা নিয়েও মানুষ বেঁচে থাকে।
৯। কারো আচরণে খুব বেশী কষ্ট পাবেন না। সবার মন, পরিবেশ, আবেগ, শিক্ষা, ভাবনা, মূল্যবোধ ইত্যাদি একরকম নয়। তাই ধরেই নেবেন, সবাই একরকম হবেনা, সবাই আপনার সাথে একইরকম আচরণ করবে না। এতে মানসিক চাপ কম অনুভূত হবে।
১০। নিজের সমস্যাকে আমরা সবসময় বড় করে দেখি। যার সাথে আপনার সম্পর্কের সমস্যার কারণে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, তার দিকটা আমরা কখনও ভেবে দেখিনা। কারণ ছাড়া কিছু ঘটেনা। তাই কেউ আপনার সাথে নেতিবাচক আচরণ করলে সে সেটা কেন করছে, তা বের করার চেষ্টা করবেন। কারণ জানলে সমাধানও বের হবে। প্রয়োজনে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে উভয়ের জন্য সহনীয় কোন সমাধান বের করতে হবে।
১১। আমরা পরিবারে, সমাজে বাস করি। এজন্য আমাদের জীবনের সাথে আরো অনেকের জীবন জড়িত থাকে; অন্যের প্রতিও আমাদের অনেক দায়িত্ব থাকে। তাই নিজের সাথে সাথে অন্যদের কথাও ভাবুন। তাতে কষ্ট সহ্য করার বা মানসিক চাপ সামলানোর শক্তি পাবেন।
১২। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হলে যেকোন সমস্যা খুব সহজে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়। তাই মানসিক চাপ কমানোর জন্য সবার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আনা ও সঞ্চয়ী হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
১৩। মানসিক চাপে পড়লে তা সামলানোর জন্য নিজেকে কিছুটা সময় দিন। তখনি সমাধান করতে যাবেন না। তাতে কলহ, ঝগড়া বাড়ে। কোন কলহ বা সমস্যা ঘটার কিছু সময় পর এর প্রতি আমাদের আবেগের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে যায়। তখন যুক্তি দিয়ে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে সমাধান করা সহজ হয়।
এক সন্যাসীকে এক লোক প্রশ্ন করলো, "বাবা, কি করে বৌয়ের মন জুগিয়ে চলা যায়, বলুন।" সন্যাসী বলল, "সেটা জানলে কি আর ঘরবাড়ী ছেড়ে গাছতলায় বসে থাকি?"
আপনার সমস্যা আপনার চেয়ে বেশী ভালো আর কেউ বুঝবে না। তাই তার সমাধানও আপনিই ভালো জানেন। তবে আত্মসমালোচনা করে নিজেকে শোধরানো ও সমস্যা কাটিয়ে ওঠার সদিচ্ছা থাকা চাই। আশা করছি, আমার পরামর্শগুলো কাজে লাগাবেন।
খুব খুব ভালো থাকবেন বন্ধুরা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৮