নাস্তিক বনাম আস্তিক
তিনটা প্রশ্ন সবসময় আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় যার সঠিক উত্তর আমি কখনোই পাইনা।
প্রথম প্রশ্ন : কেন কিছু মানুষ ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করে?
আমি সব ধর্মের মানুষের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করি। কারণ ধর্ম হলো যার যার বিশ্বাস। সেখানে মানুষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত। সবার কাছেই তার নিজের ধর্ম শ্রেষ্ঠ। তাই কোন ধর্মকেই হেয় করে কিছু বলা, করা বা লেখাকে আমি অনুচিত বলে মনে করি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ইসলাম ধর্ম নিয়ে ও মহানবী (সাঃ) - কে নিয়ে নানা অবমাননাকর লেখা প্রায়ই অনেক মানুষ লেখেন, সব ধর্ম নিয়ে নানা কটুক্তি করেন। কেন তারা এটা করেন? যদি কেউ চান তিনি ধর্ম মানবেন না, সেটা তিনি করতেই পারেন। বা কোন ধর্মের কোনকিছু কারো কাছে যৌক্তিক বা ভাল কিছু মনে না হলে তিনি সে ধর্ম ত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু তা না করে অনেকে ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর কথা লেখেন, বলেন। এটি ধার্মিকদের মধ্যে আরো বেশী প্রতিক্রিয়া তৈরী করে তথন, যখন কেউ মুসলিম হয়ে ইসলাম ধর্মের, হিন্দু হয়ে হিন্দু ধর্মের ... সমালোচনা করে।
আমি একজন নাস্তিকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন সে ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে। তার বক্তব্য হলো:
১। আমি সব ধর্মের বিরুদ্ধে লিখি কারণ আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান বলে কিছু নেই। থাকলে পৃথিবীতে এত অনাচার ঘটতে দেখেও তাদের বসে থাকার কথা না।
২। ধর্ম মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, রেশারেশি, যুদ্ধ, খুন, মানুষের সীমাহীন কষ্ট,.... এসবের জন্য দায়ী। আজ পর্যন্ত ধর্মের কারণে পৃথিবীতে যত মানুষ আক্রান্ত-ক্ষতিগ্রস্ত ও খুন হয়েছে, আর কোন কারণে এতটা হয়নি। ধর্ম না থাকলে প্রতিদিন পৃথিবীজুড়ে মানুষের এত ভোগান্তি হবেনা।
৩। হিন্দু ধর্মে জাতিভেদ আছে। ভগবান থাকলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করার কথা না। কারণ সব মানুষই তার সৃষ্টি।
৪। ইসলাম শান্তির ধর্ম হলে বহুবিবাহ সমর্থন করার কথা না। কারণ এটি নারীর প্রতি চরম বৈষম্য ও নির্যাতন। মহানবী (স) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হলে ৫২ বছর বয়সে ১১ বছরের আয়েশাকে বিয়ে, জয়নবকে বিয়ে বা ১৪ টা বিয়ে করতেন না। বেহেশতে ৭০ হুর, সুরা এসবের লোভ দেখানো হতোনা। সব ধর্মে বহুবিবাহ জায়েজ। এটি ধর্মের নামে ধর্মপ্রচারক পুরুষদের যৌন লালসা পরিতৃপ্তির কৌশল যা কোন সৃষ্টিকর্তার বিধান হতে পারেনা।
৫। সব ধর্মের প্রবর্তক পুরুষ। এটি কোন সৃষ্টিকর্তার কাজ হতে পারেনা। নারী ও পুরুষকে একই সৃষ্টিকর্তা বানিয়ে থাকলে দু'একজন নারী ধর্ম প্রচারকও পাঠাতেন।
৬। সব নবী-রাসুলদের আগমণ ঘটেছে আরব বিশ্বে। হিন্দুধর্মের প্রসার ঘটেছে ভারতবর্ষে। এভাবে সব ধর্মের আদি ব্যাপ্তি ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতবর্ষে। বিশ্বের অন্য দেশ বা এলাকাগুলোতে কেন নয়?
৭। একজন ধার্মিক নির্দিধায় ধর্মের অজুহাতে আরেকজন মানুষকে (ধার্মিক বা নাস্তিক) আক্রমণ করে। একজন নাস্তিক কখনও তা করেনা। তার কাছে সব মানুষ সমান। তাই ধর্ম না থাকা ভাল।
৮। যুগে যুগে ধর্মকে পুঁজি করে নানা কৌশলে কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ নিরীহ মানুষকে ঠকিয়েছে, নির্যাতন করেছে, লোভ দেখিয়ে বিপথগামী করেছে। ধর্ম না থাকলে এসব হবেনা।
৯। কিছু মানুষের ধর্ম পালন অন্য মানুষদের কষ্টের কারণ। যেমন - উচ্চশব্দে ঢোলের বাজনা, গীর্জার ঘন্টা, আজানের শব্দ বা মাইকে ধর্মীয় প্রচারণা ইত্যাদি। আগে মানুষের কাছে ঘড়ি ছিলনা। তাই আজান দেয়া জরুরী ছিল। এখন মানুষ জানে কখন নামাজের সময় বা গীর্জায় প্রার্থনার সময়। ঢোলের বাজনা, মন্দিরের ঘন্টা সবাই পছন্দ করবে না। তাই এগুলো বন্ধ হওয়া ভাল। সারাবিশ্বের মুসলিমের হজ্জ্বের টাকায় সৌদি আরবের লোকেরা বিলাসিতা করে, গরীব দেশের নারী এনে যৌন নির্যাতন করে, শিশু এনে উটের জকি বানায়, অন্য মুসলিম ও অমুসলিম দেশের মানুষকে কষ্ট দেয় (যেমন -ইয়েমেন)। বিভিন্ন দেশের হাজীরা হজ্জ্ব করতে গিয়ে টাকা দিয়ে সৌদিদের পাপ কাজে পরোক্ষভাবে ইন্ধন যোগাচ্ছে। ফলে পুণ্যর চেয়ে পাপ হবার সম্ভাবনা আছে। ধর্ম না থাকলে এসব হবেনা। তাই ধর্ম না থাকা ভাল। ইত্যাদি।
আমি মনে করি, ধর্ম পালন করা বা না করা একজন মানুষের ইচ্ছাধীন একটি বিষয়। তেমনি কোন ধর্ম পছন্দ না হলে তার বিরুদ্ধে বলাটাও তার ইচ্ছাধীন একটি বিষয়। ধর্ম ভাল - এটিও একটি বিশ্বাস। ধর্ম মন্দ - এটিও একটি বিশ্বাস। আমি মানুষের উভয় বিশ্বাসকে সম্মান করি। তাই ধর্ম মানার জন্য কাউকে আক্রমণ করাকে আমি যেমন সমর্থন করিনা, তেমনি ধর্ম না মানা বা ধর্ম বিশ্বাস না করার জন্যও কাউকে আক্রমণ করাকে আমি সমর্থন করিনা।
ধর্ম অবমাননার (ব্লাসফেমি) কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রায়ই সহিংসতা ঘটে। পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন ঘটেনা। এর কারণ কি? কোন দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী, সুষ্ঠু সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ, আইনের সুশাসন, সংস্কৃতি উন্নত ও শিক্ষার মান উন্নত হলে মানুষের মানসিকতা উদার হয়, সহনশীলতা বাড়ে, ধর্মান্ধতা কমে, অপরাধ কমে যায়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : কিছু মানুষ কেন ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই, করলেই তাকে নির্যাতন বা খুন করা জরুরী বা পূণ্যের কাজ মনে করে?
এর কারণ ধর্ম রক্ষা করা বা জেহাদ করা। সম্প্রতি 'পিকে' ছবিতে ধর্ম রক্ষার নেতিবাচক প্রভাব ও ধর্মকে পুঁজি করে মানুষের ভন্ডামি দেখানো হয়েছে।
আমি মনে করি, এজন্য দায়ী আমাদের ভুল বিশ্বাস, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা বা ধর্মের আদেশকে ঠিকমত বুঝতে না পারা। সব ধর্মে সব মানুষের (অন্য ধর্মের বা নাস্তিকদের) প্রতি সহনশীল আচরণ করতে বলা হয়েছে যা কোন ধর্মের লোকই মানেনা। সব ধর্মে সব মানুষের দুনিয়ার কৃতকর্মের পুরষ্কার বা শাস্তির কথা বলা আছে যা সৃষ্টিকর্তা মৃত্যুর পর দেবেন। মানুষ একথা বিশ্বাস করেনা (তাই তারা আসলে ধার্মিক নয়)। করলে নাস্তিককে বা বিধর্মীকে তার কাজের জন্য সৃষ্টিকর্তা শাস্তি দেবেন - এটা ভেবে আমরা নাস্তিক বা বিধর্মীদের প্রতি সদয় হতাম, তাদেরকে নির্যাতন বা খুন করতাম না। ধর্ম রক্ষা বা জেহাদের নামে মানুষ খুন করে পাপী হতাম না।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর অভ্যাস ছিলো কোনো না কোনো মেহমানকে সাথে নিয়ে খাওয়া। একদিন তিনি অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও কোন মেহমান না পেয়ে একজন বৃদ্ধ ভিক্ষুককে নিয়ে খেতে বসলেন। ইব্রাহীম (আঃ) বিসমিল্লাহ্ তথা আল্লাহর নামে খাবার মুখে তুললেন; কিন্তু ভিক্ষুক বিসমিল্লাহ্ না বলেই খাওয়া শুরু করল। ইব্রাহীম (আঃ) ভিক্ষুককে প্রশ্ন করলেন, "আপনি আল্লাহর নাম না নিয়েই খাওয়া আরম্ভ কেন করলেন?"
ভিক্ষুক বলল, "আমি বাপু আল্লাহ্-তে বিশ্বাসী নই। পেলে খাই, আর না পেলে না খেয়েই থাকি। কারো নাম নেওয়ার দরকার মনে করি না।" ইব্রাহীম (আঃ) খুব রাগান্বিত হয়ে বললেন, "হে অকৃতজ্ঞ বান্দা! তুমি এখান থেকে চলে যাও। আমার এই খাবার তোমার মত নাফরমান ব্যক্তির জন্য নয়।" বৃদ্ধ ভিক্ষুকটি তখন মন খারাপ করে না খেয়েই সেখান হতে চলে গেলেন। সাথে সাথে আল্লাহর পক্ষ হতে ওহী আসলো যে, "হে ইব্রাহীম! আমি এই ভিক্ষুককে দীর্ঘ ৮০ বছর যাবৎ আহার করিয়ে আসছি। আমি কখনোই অভিযোগ করি নাই, কারণ সে আমারই বান্দা। আর তুমি তাকে এক বেলা খাওয়াইতে রাজি হলে না!!!" ইব্রাহীম (আঃ) তখন তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন, এবং ভিক্ষুককে খুঁজতে লাগলেন, কিন্তু তাকে আর পেলেন না। অতঃপর তিনি অনুতপ্ত হলেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন।
এরকম উদারতার গল্প সব ধর্মে আছে। কিন্তু সব ধর্মের কিছু ধর্মান্ধ মানুষ সেটা মানেনা। সমস্যাটা এখানে।
তৃতীয় প্রশ্ন : কেন ধর্মান্ধরা ধর্মের উর্ধে উঠে নিজেদেরকে, অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে ও নাস্তিকদেরকে 'মানুষ' ভাবতে পারেনা?
আমি মনে করি, এর কারণ হলো - ধর্ম না মানার অপরাধে পরকালের শাস্তির ভয়। মানুষ ধর্ম মানে পরকালে শাস্তির ভয়ে। সব ধর্মে মানুষকে মৃত্যুর পরে পাপের জন্য শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে যাতে সমাজে বিশৃংখলা না হয়। শাস্তির ভয় না থাকলে কেউ ধর্ম মানতো না। যার মধ্যে ভয় যত বেশী, সে তত ধার্মিক। যার ভয় নেই, সে ধর্ম মানতে চায়না। সব ধর্মের মানুষ পরকালের শাস্তির কথা বিশ্বাস করে ভয় পায়। কারণ মানুষ জানেনা, মৃত্যুর পরে কি হবে বা মৃত্যুর পরের জীবনটা কেমন। এই প্রশ্নের যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক কোন উত্তর মানুষের কাছে নেই। তাই ধর্মের ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া ছাড়া মানুষের আর কোন উপায় নেই।
মানুষ নিজ নিজ ধর্মকে রক্ষা করতে খুব তৎপর। কারণ ধর্মের ভয় না থাকলে মানুষ যা খুশী তাই করবে। মানুষ স্বভাবগতভাবে বহুগামী। মানুষের মধ্যে সুপ্রবৃত্তির চেয়ে কুপ্রবৃত্তির (লোভ, হিংসা, ক্রোধ ইত্যাদি) প্রভাব বেশী। মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দাবিয়ে রাখার জন্য ধর্মের সৃষ্টি। একই কারণে বিবাহ, পরিবারপ্রথা, সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার ইত্যাদি নিয়ম তৈরী হয়েছে।
কোন ধর্মকে হেয় করে কেউ কিছু বললে, লিখলে বা করলে সে ধর্মের প্রতি ঐ ধর্মের এবং অন্য ধর্মের মানুষের সমর্থন, শ্রদ্ধা কমে যাবে বা সে ধর্ম কেউ মানবে না। এটা কেউ হতে দিতে চায়না। কারণ সব মানুষের কাছে তার নিজের ধর্ম তার ও তার পরিবার, গোত্রের লোকেদের জন্য পরকালের শান্তির নিশ্চয়তা। এই নিশ্চয়তা সে কিছুতেই নষ্ট হতে দিতে চায়না। তাই প্রয়োজনে খুন করাকেও সে পাপ মনে করেনা।
এক আস্তিককে এক নাস্তিক বলল, "কাল সকাল দশটায় রাজসভায় তুমি যদি প্রমাণ করতে পার আল্লাহ, ভগবান বা ঈশ্বর আছেন, তাহলে আমি আস্তিক হয়ে যাব। আর না পারলে তুমি নাস্তিক হয়ে যাবে।" আস্তিক রাজী হল। পরের দিন যথাসময়ে নাস্তিক রাজসভায় উপস্থিত হল। কিন্তু আস্তিক এলোনা। রাজা পেয়াদা পাঠালেন তাকে ধরে আনতে। আস্তিকের বাড়ীর কাছে একটা নদী আছে, যেটা পার হয়ে তাকে রাজবাড়ীতে আসতে হবে। দেখা গেল, আস্তিক সেই নদীর পাড়ে বসে আছে। পেয়াদা তাকে রাজসভায় যেতে বলল। আস্তিক বলল, "রাজামশায়কে গিয়ে বল, আমি অপেক্ষা করছি। নদীর পাড়ের একটা গাছ থেকে নিজে নিজে আমার জন্য নদীর উপর একটা সেতু তৈরী হবে। তারপর আমি সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হয়ে রাজসভায় য়াব।" রাজা শুনে বিরক্ত হয়ে পেয়াদা পাঠিয়ে আস্তিককে ধরে নিয়ে গেলেন রাজসভায়। তারপর বললেন, "তুমি ফাজলামো কর? গাছ দিয়ে নিজে নিজে সেতু তৈরী হবে কি করে?" আস্তিক বলল, "একটা সেতু যদি নিজে নিজে তৈরী হতে না পারে, তাহলে এতবড় পৃথিবী নিজে নিজে তৈরী হবে কি করে, যদি কোন সৃষ্টিকর্তা না থাকে?" এবার নাস্তিক বলল, "বেশ। তোমার কথা মেনে নিলাম। সারা দুনিয়া কোন না কোন সৃষ্টিকর্তাই বানিয়েছেন। তাহলে তুমি বল, এত বিশাল আকাশ-পাতাল-পৃথিবী যিনি সৃষ্টি করলেন, তাঁকে কে সৃষ্টি করেছে?"
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৫৫