অতীতের কুয়াশা ভেদ করে ভেসে উঠলো কতো আধভোলা মুখ.. কল্পনায় শুনতে পেলাম সেইসব কন্ঠস্বর যা অনেক দিন আগেই চিরকালের মতো নিরব হয়ে গেছে.. আর সেই সব পরিচিত গান যা এখন আর কেউ গায় না.. আমার জাগ্রত স্বপ্ন যখন ধীরে ধীরে করুণ থেকে করুণতর সূরে নেমে এলো.. তখন বাইরের ঝড়ের হাহাকার পরিনত হলো মূদু বিলাপে.. জানালার কাঁচের উপরে বৃষ্টির ক্রুদ্ধ আঘাত অস্ফুট মৃদু শব্দে পরিণত হলো.. রাস্তার সব শব্দ একে একে থেমে এলো এবং সর্বশেষ বিলম্বিত পথিকের পদশব্দও দূর হতে দূরে মিলিয়ে গেল.. কোথাও একটি শব্দও আর রইলোনা..
একটা ভয়ংকর নির্জনতাবোধ যেন আমাকে জড়িয়ে ধরেছে.. ঘরের মধ্যে চলাফেরা করছি পা টিপে টিপে.. যা কিছু করছি সব চুপি চুপি.. যেন আমার চারপাশে এমন সব শত্রুরা ঘুমিয়ে আছে যাদের ঘুম ভাঙ্গলে মারাত্নক বিপদ হবে..
রাত্রিটার যেন আর শেষ নেই.. আমি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম.. নিস্তব্ধ, অন্ধকার রাত্রি ঝিম ঝিম করতে করতে আরো নিঝুম অন্ধকার চিলের ডানার মতো একখানা কালো কুৎসিত কম্বল আস্তে আস্তে টেনে মুড়ে দিচ্ছে.. পৃথিবীর গা থেকে একে একে সব আলোকিতো জিনিস যেন মুছে আসছে..
ঘুম ভেঙ্গে যায়.. জেগে দেখি শরীর আমার কাঁপছে প্রচন্ড.. অন্ধকারে সারা শরীর ঘামে ভেজা.. গলা শুকিয়ে কাঠ.. আর ঘুম আসে না.. সেই নিদ্রাহীন প্রহরগুলোতে জঘন্য অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অতীতের সেই ঘটনা আবার মনে পড়ে যায়.. যা অনেকদিন আগেই ঘটেছিল.. কেন মনে পড়লো আবার?.. ভুলতে পারলাম না তাহলে..
অন্ধকারে বসে আছি.. এত অন্ধকার.. যে নাকের ডগায় মেলে ধরা হাতের অস্তিত্বও যেখানে দেখতে পাওয়া যায়না.. চারদিক ঘিরে থাকা পুরু দেয়ালের মাঝে এত শুণ্যতা যে আর্তচিৎকার, হাহাকার রোজ ব্যাঙ্গ করে প্রতিধ্বনি তুলে তুলে মিলিয়ে যায় একটা সময়.. এই আঁধারেই আমি হাতড়ে চলি রোজ একটুখানি আলোর আশায়.. বাতাসের আশায়.. চার দেয়ালের প্রতিটা ইঞ্চিতে হাত বুলাতে থাকি..এ ক চিলতে ফোঁকড়ের আশায়.. এভাবে এক সময় দম বন্ধ হতে থাকে আমার.. তবু পাগলের মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে হাতড়ে চলি.. যদি পাই একটু খানি ফোকড়.. একটু খানি শ্বাস.. একটু খানি প্রাণ.. এক বিন্দু আলো..
তবু খুঁজে পাইনা আমি.. খুঁজে তো পাইনা.. পানি থেকে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে থাকি একটু খানি শ্বাসের জন্য.. আলোর জন্য.. পাগলের মতো চিৎকার করে উঠি আমি.. আর তো পারিনা..পারছি না আমি.. এ দেয়াল ও দেয়ালে কপাল ঠুকে ঠুকে রক্ত ঝরে যায়.. এক বিন্দু আলোর আশায়.. একটুখানি ছোঁয়ার আশায়..
এক সময় সমস্ত আশা ছেড়ে হতাশায় নেতিয়ে পরে দেহ আমার.. চোখ ফেটে পানি ঝরার শক্তিও থাকেনা আর.. দু'চোখের নদীতো শুকিয়ে গেছে সেই কবেই..
হঠাৎ এক স্পর্শ..পবিত্র এক মায়াবি স্পর্শ.. বৈদ্যুতিক শক খাবার মতো ছিটকে উঠি.. এতো অসম্ভব.. না এতো সম্ভব না.. আমি কি ভুল দেখছি.. মায়াবি এক আলো.. তার চারিদিকে দারুন এক মায়াবি আলোর ছটা.. পবিত্র.. সুন্দর সে যে দারুন এক লাল মায়াবি আলো.. আমার দিকে হাত দুটি বাড়ানো.. চোখে, মুখে মৃদু পবিত্র হাসি.. আমি হাত দুটো ধরলাম.. সেও ধরলো.. অন্ধকার কুৎসিত জায়গাটা আলোয় আলোয় ভরে উঠলো.. পবিত্র আলোয়.. এতো আলোতো আগে কখনো ছিলোনা.. আলোইতো ছিলোনা.. পঁচে মরতে ছিলাম এই জঘন্য অন্ধকারে.. অন্ধকারে পঁচে মরা সে যে বড় জঘন্য লজ্জার ব্যাপার.. সে আসলো.. হাত দুটি আমার ধরলো.. আলোয় আলোয় ভরে গেলো চারিদিক.. সারাটা জীবনের জন্য..
অনেক বছর পরের কথা.. দুজন যুবক-যুবতী বসে আছে চুপচাপ কোন এক জায়গাতে.. হঠাৎ তাদের ভিতর থেকে একজন আরেক জনকে বলছে মৃদু স্বরে, মুখে এক দারুন তৃপ্তির হাসি নিয়ে.. 'এই তুমি কি জানো? আমার আব্বু না এখনো আমার আম্মুকে সোনামনি বলে ডাকে!'..
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:১২