বেশ কয়েক মাস আগের ঘটনা। আমাদের নতুন ডাক্তার তাসনূভা সাখাওয়াত বীথি গিয়েছে জীবনে প্রথম বারের মতো নাইট ডিউটি করতে। ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের এই ব্লগারকে যতটুকু চিনি তাতে জানি যে এই মেয়ে এখনও মায়ের আঁচলের নিচ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। যার জন্য তার মা এখনও খাবার নিয়ে পিছে পিছে ঘুরে। যে এখনও ভাবে দূরে কোথাও চাকুরী হলে তার মা'কে সাথে নিয়ে যাবে তাহলেই কোন সমস্যা হবেনা। সেই মানুষটা জীবনে প্রথমবারের মতো রাতের বেলা তার মা'কে ছেড়ে হসপিটালে কেমন লাগছে জানার কৌতুহল হলো। ফেবুতে নক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এই নতুন অভিজ্ঞতা তার কেমন লাগছে। রিপ্লাই যেটা পেলাম তাতে তার মানসিক অবস্থার আন্দাজ পেয়ে আমার নিজ ঘরে নিরাপদ বলয়ে থেকে আমারই রীতিমতো অস্বস্থি শুরু হয়ে গেলো। দূর থেকে মেসেঞ্জারে বসে এসব কিছুনা ডাক্তার হলে তো এসবে অভ্যস্ত হতেই হবে এসব বলে সাহস জোগানোর মিথ্যে চেষ্টা করলাম। একটু পরে জানালো ওয়ার্ডে নাকি মাত্রই আরেকটা বাচ্চা মারা গেলো, ডেডবডি দেখে তার ভয় লাগছে। আর বলছে এই আতংকে আবার আবার কিছু ভুল করে ফেলে কিনা সেটা নিয়েও তার দুশ্চিন্তার কথা। এবং যতদূর বুঝতে পারলাম তাতে সে তখন রীতিমতো আতঙ্কে কাঁপছে আর আল্লাহ্র নাম জপছে এই আশায় যাতে সকাল হয় শীঘ্রই। পরিস্থিতিতে না পড়লে সে আতংকটার আসল রূপ কেমন সেটা বোঝা যায়না ঠিকই কিন্তু অনুমান করাটা দুঃসাধ্য নয়।
যাইহোক, যে জন্য কথাটা বলা। বারডেম হসপিটালে কোন এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কোন এক এএসপি পরিচয়ধারী পুলিশের ইন্ধনে ৬০/৭০ জন মানুষ মিলে ডাক্তারদের বেধড়ক মারধোর করে। পালিয়ে টয়লেটে আশ্রয় নেয়া এক নারী ডাক্তারও তাদের হাত থেকে রেহায় পায়নি। অনেকগুলো মানুষ মিলে টয়লেটের দরজা ভেঙ্গে তাকে বের করে এনে দারূন উন্মাদনায় সবাই মিলে মারধোর করে। রাস্তায় ছিনতাইকারী বা চোর ধরা পড়লে যেভাবে অনেক মানুষ মিলে মারধোর করে কিছুটা হয়তো তেমনই!
এবার সেই নারী ডাক্তারের জায়গায় কল্পনা করুন সেখানে আপনারই বোন বা আপনারই বন্ধু বা আপনারই কোন প্রিয় একজন মানুষের কথা। কোন এক রাতের বেলা ধ্বংসের উন্মাদনায় মত্ত ৬০/৭০ জন মানুষ ধেয়ে আসছে তার দিকে। সে বুঝতে পারে ধরতে পারলেই তার উপর নেমে আসবে অমানুষিক বর্বরতা। জীবনের তাগিদ তাকে খুঁজে ফেরাচ্ছে আত্নরক্ষার পথ। কোন পথ না পেয়ে অবশেষে টয়লেটের ভেতর সে লুকিয়ে ফেললো নিজেকে। কিন্তু পালানো আর হলোনা তার। ধ্বংসের উন্মাদনায় মত্ত মানুষগুলো ঠিকই জেনে গেলো তার অবস্থান। হঠাৎ টয়লেটের দরজায় আঘাত, তারা ভাংবেই দরজা। অবর্ণনীয় আতংক নিয়ে মেয়েটি তার প্রভুর নাম জপ করছে আর ক্ষীণ আশা তার মনে হয়তো মানুষগুলো দরজাটা ভাঙ্গতে পারবেনা। কিন্তু না, মেয়েটির আশা অপুর্ণ রেখেই ভেঙ্গে গেলো সেই দরজা। কিছু লোমশ হাত ধেয়ে আসলো মেয়েটির দিকে। টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলো এক পৈশাচিক উন্মাদনা নিয়ে...
নাহ আর বলতে ইচ্ছা করছেনা। আজ খবরটি শুনে বেশ কয়েক মাস আগের সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। জীবন মৃত্যুর মাঝের একটি জায়গার জন্য নিজেকে তৈরি করতে গেলে তার জন্য একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়নকারীকে মানসিক ভাবে কতটুকু প্রস্তুত করতে হয় সেদিন তার কিছুটা আন্দাজ পেয়েছিলাম। হয়তো এই মেয়েটি বা নারীই হতে পারতো আমাদেরই কোন কাছের একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ হয়তো তার প্রিয় মানুষদের বলয়টা এমনই যে তাকে কোন কষ্ট বা আঘাতের অনুভূতি বুঝতে দেয়না।
হয়তো বলবেন ডাক্তাররা খারাপ, ডাক্তাররা কসাই। আসলে ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষের সমাজ। আপনার আমার পেশার মানুষদের মধ্যে যেমন ভালো মানুষ মন্দ মানুষ রয়েছে তেমনি ডাক্তারদের মাঝে। তাই বলে পুলিশ পরিচয় দিয়ে দলবল নিয়ে সংগঠিত হয়ে অনৈতিক ভাবে কারো উপর হামলা করার অধিকার রাষ্ট্র যেমন আপনাকে দেয়নি তেমন দেয়নি হাজার হাজার ধরে চলে আসা মানুষের সামাজিক ও নৈতিক প্রথা।