অস্ট্রেলিয়ার পতাকায় আঁকা ছয়টি তারা বা নিউজিল্যান্ডের পতাকার চারটি তারা আমরা সবাই দেখেছি। বিশেষ করে ক্রিকেটের কল্যাণে আমাদের ভারতবর্ষের প্রায় মানুষ অস্ট্রিলিয়ান ক্রিকেটারদের গায়ের জার্সির পাঁচটি তারার সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা যে একটি নক্ষত্র মন্ডলের থেকেই মূলত এই এই তারাগুলোর আগমন। অস্ট্রেলিয়ার পতাকার কমনওয়েলথ তারাটি বাদ দিয়ে বাকী পাঁচটি তারা বা নিউজিল্যান্ডের পতাকার চারটি তারা এর সবই একটি নক্ষত্র মন্ডলকে উপস্থাপন করে। খালি চোখে দৃশ্যমান ৮৮ টি নক্ষত্র মন্ডলের অন্যতম এই নক্ষত্র মন্ডলের নাম Crux যা দক্ষিণের ক্রুশ নামে পরিচিত। (উত্তরের ক্রুশ বলা হয় cygnus বা বক নক্ষত্রমন্ডলকে)
Crux নক্ষত্র মন্ডল
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত এত নক্ষত্র মন্ডল থাকতে ঠিক কি কারণে দৃশ্যমান নক্ষত্র মন্ডলের মধ্যে সবচাইতে ছোট Crux নক্ষত্র মন্ডল এত গুরুত্ব পেলো যে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের পতাকায় জায়গা করে নিলো? হ্যাঁ, একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ কারণে Crux নক্ষত্রমন্ডলের ঠাই হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার পতাকায়।
আমরা সবাই জানি প্রাচীন মানুষজনের নৌ যাত্রায় আবশ্যিক ভাবে নির্ভর করতে হতো আকাশের তারকাপুঞ্জের উপর। ঠিক যখন পর্যন্ত কম্পাস আবিষ্কার হয়নি তখন আকাশের তারকা মন্ডলই ছিলো অথৈ সাগরে নাবিকদের একমাত্র দিক নির্দেশক।
আবার আমরা আরো জানি মূলত ধ্রুব তারাকে স্থির ধরেই প্রাচীন মানুষ রাতের আকাশের দিক নির্ণয় করতো। কিন্তু যেখানে ধ্রুব তারা অদৃশ্য সেখানে কি হতো? উত্তর গোলার্ধে ধ্রুবতারা বা ধ্রুব তারা নির্ণায়ক উরসা মেজর বা সপ্তর্শি এবং ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রমন্ডল সহজলভ্য কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধে এইসব নক্ষত্রমন্ডল ঠিক এতটা সহজলভ্য নয়। বিশেষ করে ধ্রুবতারা তো সম্পুর্ণই অদৃশ্য। আর ঠিক এই কারণেই দক্ষিণের অভিযাত্রীদের কাছে Crux নক্ষত্রমন্ডল এতটা গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠে। প্রাচীন লোকেরা দক্ষিণে যাত্রার সময় দক্ষিণ দিক নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করতো এই নক্ষত্রমন্ডলকে। দক্ষিণ আকাশের অন্যান্যা তারকাপুঞ্জ সময় ভেদে অস্থিতিশীল থাকলেও রাতের আকাশে যে কোন সময়েই একমাত্র এই নক্ষত্রমন্ডলের মাধ্যমেই সঠিক ভাবে দিক নির্ণয় সম্ভব হতো।
Crux
খালি চোখে দৃশ্যমান ৮৮টি নক্ষত্রমন্ডলের মধ্যে সবচাইতে ছোট নক্ষত্র মন্ডল হচ্ছে Crux, যে নামের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ থেকে আর ইংরেজীতে Crux এর মানে হচ্ছে ক্রুশ বা ক্রস।
আলফা , বিটা , গামা ও ডেল্টা এই চার ধরনের পাঁচটি প্রধান তারা নিয়ে Crux নক্ষত্রমন্ডল গঠিত। যেখানে গামা ও আলফা টাইপ তারা দুটোকে দুটি বিন্দু ধরে আলফার দিকে একটি সরল রেখা টেনে দক্ষিণের প্রধান বিন্দু বের করা হয়। আবার শুধু এই একটি সরল রেখা দক্ষিণ দিক নির্নয় করে সাধারণ দূরত্বে ব্যবহার করা গেলেও সম্পুর্ন নিখুঁত দিক দিতে পারতো না। সম্পুর্ণ নিখুঁত ভাবে দিক নির্নয়ের জন্য নির্ভর করতে হতো |আলফা সেঞ্চুরি ও বিটা সেঞ্চুরি নামক আরো দুটি তারার উপর। এই দুটি তারা চিহ্নিত করার উপায় হচ্ছে Crux নক্ষত্র মন্ডলের ডেল্টা ও বিটা টাইপ তারা দুটোকে দুটি বিন্দু কল্পনা করে বিটা তারার দিকে একটি সরল রেখা টানলে যে দুটো উজ্জ্বল নক্ষত্রের পাশ দিয়ে যায় সে দুটোই হচ্ছে আলফা সেঞ্চুরি ও বিটা সেঞ্চুরি। এখন আলফা সেঞ্চুরি ও বিটা সেঞ্চুরির ঠিক মধ্যভাগে একটি লম্ব আঁকলে বা ৯০ডিগ্রী একটি কোণ আঁকলে Crux নক্ষত্র মন্ডলের গামা ও আলফা বরারব সরল রেখার যে বিন্দুতে ছেদ করে ঠিক সেটাই হচ্ছে দক্ষিণের বিন্দু।
নিচের চিত্র দেখুন-
কিন্তু দক্ষিণের ক্রুশ বা Crux নক্ষত্রমন্ডল থাকার পরও দক্ষিণের যাত্রাপথ এতটা সহজ ছিলোনা। দক্ষিণের যাত্রাপথ পথভ্রষ্ট নাবিকদের করুণ পরিণতির ইতিহাস। কিন্তু কেন? হ্যাঁ, ঠিক এই Crux নক্ষত্রমন্ডলের কাছেই Crux এর চাইতে অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল আরেকটি নক্ষত্র মন্ডলের নাম Vela , যাকে ফলস সাউদার্ন ক্রসও বলা হয়ে থাকে। ঠিক প্রায় Crux নক্ষত্রমন্ডলের মতো দেখতেই Vela নক্ষত্র মন্ডলকে ধরে নাবিকরা যখন দিক নির্নয় করতে যেতো তখনই হয়ে যেতো দিকভ্রম। আর দুটোর সাদৃশ্য এতটাই যে নাবিকদের কাছে সেটাকে Crux ভেবে ভুল করাটাই স্বাভাবিক ছিলো। তাছাড়া যেহেতু দুটো নক্ষত্র মন্ডলই ছায়াপথের প্রায় মধ্যিখানে অবস্থিত সেহেতু ছোট ছোট তারার ভীড়ে সঠিক Crux কে চিহ্নিত করা অনেক সময়ই কঠিন হয়ে যেতো।
অনেকের ধারণা Crux নক্ষত্র মন্ডল শুধু দক্ষিণ গোলার্ধেই দৃশ্যমান। কিন্তু এটি সম্পুর্ণ সত্যি নয়। সময় বিশেষ বিশেষ করে এপ্রিলের দিকে উত্তর গোলার্ধ থেকে এই নক্ষত্র মন্ডল দৃশ্যমান হয়। তাছাড়া ভারতীয় বা চাইনিজ জোতির্বিদ্যায় এই নক্ষত্রমন্ডলের আলোচনাও প্রাচীন কালে উত্তর গোলার্ধে এই নক্ষত্র মন্ডলের গুরুত্বের সাক্ষ্য দেয়। ভারতীয় পুরাণ এবং জোতির্বিজ্ঞানে Crux নক্ষত্র মন্ডল ত্রিশংকু নামে পরিচিত। ভারতীয় পুরণ মতে বিশ্বমিত্র যাকে দক্ষিণের নক্ষত্র মন্ডলে স্থান দেন। আবার চীনা জোতির্বিদ্যার ২৮টি রাজকীয় তারকা মন্ডলের সর্বশেষ ২৮ তম স্থানে Crux নক্ষত্রমন্ডলের অবস্থান। চীনা জোতির্বিজ্ঞানে যার নাম জেন(Zhěn)
মাউরিদের (নিউজিল্যান্ডের আদি অধিবাসী) উপকথাতে Crux নক্ষত্র মন্ডলকে পাওয়া যায় জাহাজ বা নৌকার নোঙ্গর হিসেবে। হয়তো ছায়াপথের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান এবং মাউরিরা দেখতো সমগ্র ছায়পথ তারকাপুঞ্জ ঘুর্ণয়নাম দোলরত আর সেখানে Crux নক্ষত্রমন্ডল সমস্ত ছায়াপথকে ধরে রেখেছে নোঙ্গরের মতো করে যার কারণ ছায়াপথ ছুটে বেড়িয়ে যেতে পারছেনা। আর তার থেকেই হয়তো তারা এটাকে মহাকাশের নোঙ্গর বলে ভেবেছে।
আর এভাবেই Crux নক্ষত্রমন্ডল হয়ে উঠেছে দক্ষিণের মানুষের ভালোবাসার ধন, প্রিয় নক্ষত্র মন্ডল। আর তার থেকে রচিত হয়েছে বা এখনও হচ্ছে নানা গান, উৎসবের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রতিদান। আর এভাবেই পথ প্রদর্শক হিসেব Crux নক্ষত্র মন্ডল মানুষের মাঝে ঠাঁই করে নিয়েছে। যার কারণে শুধু অস্ট্রেলিয়া নয় ব্রাজিল কিংবা পাপুয়া নিউগিনির পতাকাতেও ঠাঁই করে নিয়েছে এই নক্ষত্রমন্ডল। আর এভাবেই ভালোবাসার বিনিময়ের মাধ্যমে হাজার বছর পর যখন মানুষ নির্মিত তারা স্যাটেলাইট বা জিপিএসের আরো হাজার গুণ উৎকর্ষ সাধিত হবে তখন হয়তো ভালোবাসায় ভর করে এই নক্ষত্র মন্ডলেরই আবির্ভাব হবে কোন নতুন মিথের প্রধান চরিত্রগুলোর অন্যতম হয়ে। আর Vela হয়তো মিথের কোন খল চরিত্রে।
ব্রাজিলের পতাকায়-
ট্যাটুতে-
দেশে দেশে-
গানে-
--------
*ছবিসুত্রঃ ইন্টারনেট
**সকল লিংকঃ উইকিপিডিয়া