চান্দরা চৌরাস্তা।
নামে চৌরাস্তা হলেও আসলে রাস্তা তিনদিকে বিস্তৃত। গাড়িগুলো তিন দিকেই আসা যাওয়া করছে। তিতাস পরিবহনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। ঘরের বানানো... কাঁচা হাতের বোঝাই যায়। ভীড়ের জন্য বাসে উঠতে পারছেন না। বয়সও তো আর কম হলো না। ষাট পেরিয়ে এসেছেন গত বছর। এই বয়সে যুবকদের ভীড় ঠেলে ওদের প্রাণচাঞ্চল্যের কাছে হার মানাটাই কি স্বাভাবিক নয়? নিজের জীবনের কাছে তো সেই কবেই হার মেনে বসে আছেন!
টিকেট কাউন্টারের অল্প বয়স্ক ছেলেটি একবার কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করলে তিনি মাথা নেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু একটা বলেছিলেন। এই আরো এক সমস্যা। তিনি কারো কিছু বুঝেন না, তারটাও কেউ বুঝতে চায় না।
সবাই উঠে পড়লে বাস ছেড়ে দেবার আগ মুহুর্তে তিনি উঠলেন।
চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রীদের দিকে তাকালেন। এরা সবাই যাত্রী। শুধু তিনি ছাড়া। তিনি এসেছেন হকারি করতে। একজন ভ্রাম্যমান হকার হিসেবে আজ তার প্রথম দিন। অভ্যাস নেই। কীভাবে শুরু করবেন ভাবছেন। একবার গলা খাঁকারি দিলেন। কিছু বলতে গিয়েও যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। মুখ দিয়ে কথা আসছে না। ব্যাগের ভিতর থেকে কিছু টুথ ব্রাশের প্যাকেট বের করে হাতে নিলেন। প্রতিটির সাথে একটি করে বল পেন। এগুলো ব্রাশের সাথে ফ্রি দেয়া হবে।
কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে এলো। 'কই যাবেন মুরব্বি?' জিজ্ঞেস করাতেই বললেন, ' এই সামনে...' । ওনার হাতের ব্যাগ আর জিনিসগুলোর দিকে নজর পড়তেই কন্ডাক্টর আর ভাড়া চাইলো না। ওর দৃষ্টিতে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য অনুভব করলেন। যাত্রী থেকে মুহুর্তে একজন হকারে পরিণত হলেন তিনি! হকারেরা মানুষ নয় বোধহয়। তবে কষ্ট পেলেন না কন্ডাক্টরের চাহনির মর্ম বুঝে। ইদানিং এর থেকেও অনেক বেশী অবহেলা আর তাচ্ছিল্য পেতে পেতে মনটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে এখন।
ছেলের সংসারে অনাহুতের মত বাস করছেন তিনি। ছোট্ট ষ্টোর রুমটি এখন তার এক চিলতে 'শোবার ঘর'! বউমার মিছরির ছুরিতে অণুক্ষণ ফালা ফালা হবার পরে একটুখানি শ্রান্তিতে পিঠ এলিয়ে দেবার জায়গা এটাই। ছেলে দিনভর অফিসে ব্যস্ত থাকে। রাতে ও বাসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই ব্যস্ততার ভিড়ে বাবাকে দেবার মত 'সময়' আর তার থাকেনা। যান্ত্রিক জীবনে সবাই যন্ত্রের মতো ভাবলেশহীন! টাকা নামের কিছু কাগুজে ভালোবাসায় হৃদয়ের লেনদেন চলে এখন। তাই এতোগুলো বছর পার করেও 'ওগুলোই' অর্জনে আবার পথে নেমেছেন আজ। যদিও ভেবেছিলেন, এই পথটিতে চলা অনেক আগেই ফুরিয়েছে তার। আর বুঝি নামার প্রয়োজন হবে না।
বাসের মাঝামাঝি এক বৃদ্ধ দম্পতির দিকে চোখ পড়তেই নিজের অর্ধাঙ্গীনির কথা মনে পড়ে গেলো। বছর পাঁচেক হল তিনি তাঁকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন। হৃদয়ের গহীন কোনো এক কোণ থেকে বোবা অনুভুতিগুলো ঠিকরে বের হতে চাইলো। চাইলো পাথরের বুক চিরে এক অপ্রতিরোধ্য ঝর্নাধারা বের হতে। মুহুর্তে দু'চোখ ভিজে উঠে... নিজেকে সম্বরণ করতে বেশ বেগ পেতে হয়। দু' ফোঁটা অশ্রুও যে ঝরিয়ে হৃদয়ের ব্যথাকে কিছুটা প্রশমন করবেন, তাও পারেন না। পাছে ছেলের অমঙ্গল হয়!!
নিজেকে নিজের ভেতর থেকে টেনে বের করে একজন বাবা মুহুর্তে একজন হকারে পরিণত হন!
মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বেরিয়ে আসে, ' আসসালামু আলাইকুম। আমি আপনাদের সামনে কিছু জিনিস নিয়ে এসেছি... ...'
যাত্রীদের ভিতর কেউ তাকায়, কেউ একটু শুনেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কয়েকজন বিরক্ত হয়ে দু'একটা তীর্যক মন্তব্যও করে। কিন্তু জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ নতুন করে বাঁচার চেষ্টায় পথে নেমেছেন, তাঁকে কি এতো কিছু লক্ষ্য করলে চলে? ভালবাসার কিছু কাগুজে নোট নিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হবে চৌষট্টি স্কয়ার ফিটের এক বৃদ্ধাশ্রমে! যেখানে আপনজনের মাঝে থেকেও এক অন্তরীণ জীবনের স্বাদ লাভ করে চলেছেন- সকাল থেকে সন্ধ্যা- ভরা সাঁঝের বেলা থেকে কাকডাকা ভোর- রৌদ্রোজ্জল বেলা শুরুর মুহুর্ত থেকে শেষ বিকেলের আবির রাঙ্গা ক্ষণ পর্যন্ত... নির্বাক নিঃসঙ্গতায় মৌণ বিমুঢ়!
নিজের ভূবনে একজন বাবা... কেন বড্ড একেলা?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৩