ছোটগল্প নিয়ে কিছু কথা
★*★*★*★*★*★*★*★
‘ছোটগল্প’- শব্দটিকে আমি এভাবে-ই লেখি। তবে ‘ছোট গল্প’ এটাও সঠিক। ছোটগল্পের কি নিজস্ব কোনো সংজ্ঞা রয়েছে? আকারে ছোট হলেই তাকে ছোটগল্প বলা যাবে? ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালতা থাকতে হবে, অর্থাৎ অল্প কথায় অধিক ভাব ব্যক্ত করতে হবে। ছোটগল্প কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ রূপবন্ধ যা কাহিনীভিত্তিক এবং দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব, তবে ছোটগল্পের আকার কী হবে সে সম্পর্কে কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেই।
ছোটগল্প তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করার আগেই পৃথিবীর সব সাহিত্যে আমরা গল্পকে পেয়েছি। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, আধুনিক ছোটগল্প এক প্রকার নতুন সৃষ্টি। প্রাচীনকালের গল্পের মতো এরা যথেচ্ছাবিহারী, প্রগলভ ও নিরুদ্দেশপন্থী নয়। বিষ্ণুশর্মা বা ঈশপের মতো প্রাণী-নির্ভর কিংবা মানব-আশ্রয়ী নীতিধর্মী ছোট ছোট গল্পের রেওয়াজ ও আজ আর নেই। তাই এ কথা বলতে পারি, ছোট গল্পের কাছে সম্পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত ও কেউ আশা করে না।
সকল সাহিত্য মাধ্যমের মধ্যে প্রাচীনতম ও কঠিনতম মাধ্যম কবিতা। এর পাশেই ছোটগল্পের স্থান। ছোটগল্প কাকে বলে? কবিতা কি এটা যেমন বলা মুশকিল, তেমনি ছোটগল্প কাকে বলে সেটাও বলা সমান বিপদের কাজ। ছোটগল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে উদ্ধৃতি রয়েছে, সেটাকে কেউ কেউ সংজ্ঞা বলে চালাতে চান। তবে সেখানে যা আছে তা সংজ্ঞা নয়; বরং ওটায় বর্ণীত- ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা নিতান্ত সহজ সরল, সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি তারি দু-চারটি অশ্রু জল। নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা’- এই কথাগুলি আসলে ছোটগল্পের উপকরণ। এই তথাকথিত সংজ্ঞার ভিতরে থেকে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রচিত্রণে, পরিবেশচিত্রণে, সংলাপের ক্ষেত্রে অসম্ভব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
সব ছোটগল্পই গল্প বটে কিন্তু সব গল্পই ছোটগল্প নয়। একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কিছু নান্দনিক ও শিল্পশর্ত পূরণ করতে হয়। ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ কী সে নিয়ে সাহিত্যিক বিতর্ক ব্যাপক। এককথায় বলা যায়- যা আকারে ছোট, প্রকারে গল্প তাকে ছোটগল্প বলে।
'ক্ষুধিত পাষাণ' ও 'শাস্তি' গল্প দুটি রবীন্দ্রনাথের অন্যতম দুটি শ্রেষ্ঠ গল্প। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছোটগল্পের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন যে, ছোট ছোট দুঃখকথা থাকবে, নিতান্তই সহজ-সরল হবে অর্থাৎ খুব বেশি বাগাড়ম্বর থাকবে না, আর শৈলীর নামে শৈলী নির্ভরতাটা থাকবে না। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিজেই এটার একটা প্রমাণ যে ছোটগল্প হচ্ছে এরকম।
মানব জীবনের ছোট ছোট ভাল লাগা, ভালবাসা, মান-অভিমান, কিংবা সমাজের নানা অসঙ্গতির সুচারু চিত্রায়নেই বাঙময় হয়ে ওঠে যে কোন ছোটগল্প। আর সেই ছোটগল্পই আমাদের মনে দাগ কাটে যখন সেখানে আমরা নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পাই। তবে এক্ষেত্রে লেখককে অবশ্যই বর্ণনায় সাবলীলতা দেখাতে হয়।
গল্পের শেষ পর্যন্ত পড়েও অতৃপ্তি থেকে যাবে, এখানেই লেখকের সার্থকতা। আকৃতিতে ছোট ও প্রকৃতিতে গল্প হলেও সাহিত্যের এমন এক শিল্প প্রকরণ এ গল্পগুলি , উপন্যাস নাটকের তুলনা চলে না এদের সাথে , বরং একাঙ্কিকার একমুখীনতা ও বহুব্যাপ্ত জীবনের খণ্ডাংশ চোখে পড়ে । চলমান ঘটনার মধ্যে ক্লাইমেক্স বা মহামুহূর্তটি জীবনের গভীর রহস্যকে ব্যঞ্জনাময় করে পাঠককে 'বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু ' দর্শন করিয়ে লেখক শ্রেষ্ঠ শিল্পকৃতিত্ব নিতে সক্ষম হন। এটা-ই ছোটগল্পের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।
সমাজ জীবনের সম্পর্ক বৈচিত্র্য নিয়ে রচিত ছোটগল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ব্যবধান, মেঘ ও রৌদ্র, পণরক্ষা, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, দিদি, হৈমন্তী, কর্মফল, দান-প্রতিদান, দেনা-পাওনা, ছুটি, পুত্রযজ্ঞ, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি।
রবীন্দ্র বলয়মুক্ত কবিতা নির্মাণের পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশ বাংলা ছোট গল্পেও অনবদ্য স্বাক্ষর রেখেছেন। জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ ও দ্বান্দ্বিকতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে বেদনাবোধের উল্লম্ফন, যা তার ছোট গল্পের বিষয়বৈচিত্র্যে অন্য একটি নতুন মাত্রা দান করে। নিম্ন শ্রেণির মানুষের জীবনের চিত্রায়ন ছিল তার ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য।
আমি নিজে ছোটগল্প নামে যা লেখি, সেটা আদতেই ছোটগল্প হয় কি না কিংবা সাহিত্যের ব্যাকরণিক দিকটি ছুঁয়ে যায় কি না, আমি সেটা দেখবার প্রয়োজন মনে করি না। আমার গল্পে আমি পাঠককে নিরন্তর ভাবানোর এক উপকরণ রেখে যাই.. এক চৌম্বকীয় আবেশে পাঠক-হৃদয় পূর্ণ হয়.. তবে ছোটগল্পের একটি উপাদান আমার গল্পেও থাকে। সেটা হলো ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ তথা অতৃপ্তির ব্যাপারটি। আমার গল্পগুলি ছোটগল্প হোক কি না হোক, পাঠক যেন ভাবনাবিলাসে মেতে উঠে সৃষ্টিশীলতায় অনুপ্রাণিত হন, আমি সেই দিকটি চিন্তা করেই গল্প লেখে থাকি। তাই আমার গল্প সেটা ছোটগল্প-ই হোক কি অণূগল্প হোক, হয়ে ওঠে মামুনের ছোটগল্প/অণূগল্প।
★ গুগল সার্চ করে বিভিন্ন লেখকের লেখার অংশ নেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৬ রাত ৩:০৫