প্রথম পর্ব : পুর্ব মেঘ ১-৩০ স্তবক
দ্বিতীয় পর্ব: পুর্ব মেঘ ৩১- ৬৫ স্তবক
তৃতীয় পর্ব : ১- ২৭ স্তবক পর্যন্ত
উত্তরমেঘ
১)
অলকার প্রাসাদগুলি বিশেষ কিছু গুনে প্রায় তোমারই সমান ! তোমার মধ্যে বিদ্যুৎ আছে সেখানেও বিদ্যুতের মত দিপ্তিময়ী সুন্দরী রমণীরা আছেন ! তোমার মধ্যে বিচিত্র ইন্দ্রধনুর বিকাশ হয় , প্রাসাদগুলি সঙ্গিত উপলক্ষে মৃদঙ্গের ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠে । তোমার মধ্যেও সেই স্নিগ্ধ ও গম্ভীর ধ্বনি ! প্রাসাদের মনিময় মসৃনভুমি তোমার মতঁই জলমগ্ন মনে হয় । তোমার মতই সেই প্রাসাদ গুলিও উচ্চ ও আকাশচুম্বী ।
ছবি-২/১৮ : অলকা পুরীর উচ্চ প্রাসাদগুলি
২)
অলকার বন্ধুদের হস্তে লীলাকমল , কেশপাশে কুন্দপুষ্প, লোধ্রপুষ্পের পরাগে মুখ পান্ডূর বর্ণ ধারণ করেছে , তাদের করবির দুইপাশে নববিকশিত করুবক ফুল , দুই কর্ণে সুন্দর দুটি শিরীষ ফুল আর সীমান্তে বর্ষাগমে বিকশিত কদম্ব!
ছবি-৩/১৮ : বিকসিত কদম্ব ফুল
৩)
অলকার বৃক্ষগুলি কখনো পুষ্পহীন হয়না , মধূলোভী উম্মত্ত ভ্রমরকূল চারিদিক গুঞ্জন করতে থাকে ! সেখানে সরসিতে পদ্মফুল নিত্য বিকসিত ; হংসশ্রেণী তাদের বেষ্টন করে থাকে, মনে হয় যেন রূপসি মেখলা পরেছে ! সেখানে গৃহময়ুরগুলির পুচ্ছ সর্বদাই দিপ্তিময়, তাদের কেকা ধ্বনীতে চারিদিক মুখর হয়ে উঠে, সেখানে সন্ধা অতি সুন্দর ,সকল সময় জ্যোৎস্নায় আলোকিত-অন্ধকারের লেশমাত্রও থাকেনা তথা ।
ছবি-৪/১৮ : মধূলোভী উম্মত্ত ভ্রমরকূল ও গৃহময়ুরগুলির পুচ্ছ সর্বদাই দিপ্তিময়
৪)
সেখানে আনন্দ থেকে নয়নে অশ্রু দেখা দেয় অন্য কোন কারণে নয় ,যেখানে মদনের পুষ্পশরের আঘাতটাই যত তাতে দু:খ তত নয় ; সে দু:খেরও অবসান ঘটে প্রিয়জন কাছে এলেই, সেখানে প্রলয় কলহ ছাড়া আর অন্য কোন বিচ্ছেদ নেই – যৌবন ছাড়া যক্ষদের অন্য কোন বয়সও নেই ।
৫)
অলকায় প্রাসাদে শ্বেতমনি নির্মিত ভুমিতে বিচিত্র কুসুম ছড়ানো –মনে হয় যেন আকাশের তার কার ছায়া ভুমিতে লুন্ঠিত ! সেখানে উত্তম নারী সংসর্গে যক্ষগন মধুপান করছেন ,মধুপানের সময় তোমার গম্ভীর মন্ত্রের ন্যয় মৃদঙ্গের ঘম্ভীর ধ্বনিতে সেই ভোগে ভুমি মুখরিত হয়ে থাকে ।
৬)
সেই অলকার মন্দাকিনীর তীরে যক্ষ কন্যাগণ খেলায় মত্ত । স্বর্ণরেণুর মতো বালুকা, মুস্টি নিক্ষেপ করে মনি লুকিয়ে ফেলতে হবে, তারপর ছুটে গিয়ে সেই মনি খুঁজে বার করতে হবে- এই খেলা । এই যক্ষ কন্যাগন রূপেগুনে দেবতাদেরও প্রার্থনীয় । খেলা যখন চলতে থাকে তখন মন্দাকিনীর জলসিক্ত বাতাস তাদের সেবা করে , তীরস্থিত মন্দারতরুর ছায়ায় তাদের রোদের তাপ নিবারিত হয় ।
ছবি-৫/১৮ : মন্দাকিনীর তীরে যক্ষ কন্যাগণ খেলায় মত্ত
৭)
সেখানে ভোগরতা সুন্দরীগন যখন আবেগে উচ্ছসিত হয়ে উঠে , তাদের পট্টবসন সহজেই খসে পড়ে, কটিদেশের বসনগ্রন্থি শিথিল হয়ে আসে-সেই শিথিল গ্রন্থি অনুরাগ ।
৮)
চঞ্চল হস্তে অনুরাগ আকর্ষণ করেন তাদের প্রিয়তমগন । তখন লজ্জায় বিমুঢ়া সুন্দরীগণ একমুষ্ঠি চুর্ণ পদার্থ নিয়ে উজ্জল প্রদীপ শিখা লক্ষ্য করে ছুড়ে দেন, কিন্তু তাদের সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়! কেননা এ যে রত্নপ্রদীপ- নেভানো যায় না ।
৯)
অলকার উচ্চ প্রাসাদগুলির উপরের তলার ঘরগুলিতে সুন্দর সুন্দর চিত্র সজ্জিত রয়েছে । বাতাসের বেগে মেঘখন্ডগুলি সেখানে প্রবেশ করে নতুন জলকনায় চিত্রগুলি নষ্ট করে দেয় , তারপর সঙ্কিত হয়ে মেঘের দল জানালার পথে পালিয়ে যায় ,যেন উদ্গীর্ণ ধোঁয়া জানালা পথে বেরিয়ে যাচ্ছে ।
ছবি-৬/ ১৮ : উচ্চ প্রাসাদগুলির উপরের তলার ঘরগুলিতে সুন্দর সুন্দর চিত্র সজ্জিত
১০)
অলকার রতিমন্দিরে শয্যার উপরে মনির ঝালর , সেখানে চন্দ্রকান্তমনি ঝোলানো । রাত্রিতে মেঘের অবরোধ থেকে মুক্ত চাদের কিরণ এসে পড়ে চন্দ্রকান্ত মনির উপর , তখন তা থেকে বিন্দু বিন্দু শীতল জলকনা ঝরতে থাকে, সন্ধায় প্রিয়তমের গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ রতিশ্রান্তা রমণী, ঐ জলকনার বর্ষণে অঙ্গ জুড়ায় ।
১১)
অলকার কামী ব্যক্তিদের গৃহে অক্ষয় রত্ন বর্তমান, কুবের-ভবনের বাইরে ‘বৈভ্রাজ’ নামে যে উপবনটি আছে সেখানে তারা এসে বিচিত্র গল্প বলে সময় কাটান , তাদের সঙ্গে থাকেন অপ্সরা ও কিন্নরের দল। কিন্নরগণ মধুরকন্ঠে অলকাপতি কুবেরের যশোগাথা গান করেন।
ছবি-৭/১৮ : কুবেরের প্রতি কিন্নরগণের মধুরকন্ঠে যশোগাথা
১২)
অলকার রাত্রির অন্ধকারে অভিসারিকারদল যখন যাত্রা করেন তখন দ্রুত গতির ফলে তাদের অলক থেকে মন্দারকুসুম খসে পড়ে, চন্দন প্রভৃতি দ্বারা দেহে অঙ্কিত লতাপাতার ছাপ ঝরে পড়ে , কোথাও কনের স্বর্ণালঙ্কার ধুলায় লুটায় , কোথাও স্তনথেকে মুক্তার মালা , কোথাও আবার স্তনের চাপে হার ছিড়ে পথে পড়ে, তাই সুর্যোদয়ে সবাই বুঝতে পারে , কোন পথে রমণীগণ তাদের নৈশ অভিসার করেছিলেন ।
ছবি – ৮/ ১৮ : রাত্রির অন্ধকারে অভিসারিকাদের অভিসার
১৩)
সেই অলকার কুবের ভবনের বাইরের উপবনে আছেন চন্দ্র শেখর, তিনি কুবেরের সখা, ভয়ে মদন তার ভ্রমর পঙক্তির পুষ্পধনু নিয়ে সেখানে যান না । সেখানকার চতুরা সুন্দরীগণ কামীজনের প্রতি চঞ্চল সভ্রূভঙ্গ এবং অব্যর্থ কটাক্ষ নিক্ষেপ করেন , তাতেই মদনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে থাকে ।
ছবি-৯/ ১৮ : চতুরা সুন্দরীগণের অব্যর্থ কটাক্ষ নিক্ষেপ
১৪)
সেই এলাকার রমণিদের সাজসজ্জার সমস্ত উপকরণ একমাত্র কল্পবৃক্ষই যুগিয়ে থাকেন, বিচিত্র বসন ও অলঙ্কার , নয়নে বিভ্রম সৃষ্টির ঙ্কঅনুকুল শুরা, পল্লবসহ নববিকসিত পুষ্প , চরণকমলের উপযোগী আলতা !
ছবি-১০/১৮ : কল্পবৃক্ষ
১৫)
সেই অলকাতেই কুবেরের গৃহের উত্তরে আমার গৃহ দুর থেকেই দেখা যায় । ইন্দ্রধনূর সুন্দর তোরণে শোভিত সেই গৃহ ! কাছেই একটি ঠোট্ট মন্দার তরু, আমার স্ত্রী পালিত পুত্রের মতোই স্নেহে বর্ধিত করেছে । গাছটি এত নীচু যে ঘর হতে হাত দিয়েই তার পল্লবের নাগাল পাওয়া যায় ।
ছবি -১১/১৮ : কুবেরের গৃহের উত্তরে যক্ষের গৃহ
১৬)
আমার গৃহে একটি দিঘি আছে ; মরকতশিলায় তার সোপান নির্মিত। স্নিগ্ধ বৈদূর্য মনিময় মৃনালের উপরে স্বর্ণকমল বিকশিত । এই দিঘির জলে বাস করে হংসদল বর্ষাকালে তোমার দর্শণে ক্লান্তি দুর হয় বলে নিকটবর্তী মানস সরোবরে আর যায়না ।
ছবি-১২/ ১৮ : যক্ষের গৃহপাশে দিঘিতে হংস সাথে যক্ষ প্রিয়া
১৭)
সেই দিঘির তীরে এক ক্রীড়া পর্বত ; কোমল ইন্দ্রনীল মণিতে তার শিখর নির্মিত। স্বর্ণের কদলী তরুতে তার চারিদিক বেষ্টিত এবং এ কারণেই দর্শনীয় সেই পর্বতটি আমার অতি আদরের; তোমার নীল দেহের চারিদিকে যখন বিদ্যুৎ বিচ্ছুরিত হতে থাকে তখন সেই পর্বতের কথাই আমি কাতর হৃদয়ে স্মরণ করি।
১৮)
এই ক্রিড়াশৈলে কুরুবক গাছের বেড়ায় ঘেরা একটি মধুমঞ্জরি কুঞ্জ আছে; কুঞ্জের নিকটেই দুইটি তরু, একটি রক্তশোক , বাতাশের বেগে এর পল্লব কম্পমান । অন্যটি বকুল , দেখতে খুবই সুন্দর । অশোক আমার মতই তোমার সখীর অর্থাৎ আমার প্রিয়ার বামচরণের আঘাত প্রার্থনা করছে, অন্যটিও আমারই মতো তোমার সখীর মুখের মদিরার প্রার্থনা জানাচ্ছে ।
ছবি -১৩/ ১৮ : ক্রিয়াশৈলে মধুমঞ্জরি কুঞ্জ
১৯)
এই তরু তলে স্বর্ণ নির্মিত ক্রিড়াশৈলীর আধার, এর এক অংশে কুচ বর্ণের মুর্তীর উপর রংগীন স্ফটিক বসানো । দিনের মধ্যভাগে তোমার বন্ধু নীলকন্ঠ ময়ুর এসে সেই মুর্তীর উপরে বসে আর আমার প্রিয়া, সখিগন সাথে জলের উপরে ক্রিড়াকালে হাততালি দিয়ে তালে-তালে নাচতে থাকে, ময়ুরের কেকা ধ্বনিতে নৃত্যের তাল আরো মধুরতর হয়ে উঠে ।
ছবি – ১৪/ ১৮ : মধুমঞ্জরি কুঞ্জে সখীসনে যক্ষপ্রিয়ার নৃত্য
২০)
এ সব লক্ষনের কথা মনে রেখে আর আমার গৃহদ্বারের দুই পাশে আঁকা একটি শঙ্খ ও একটি পদ্ম দেখে আমার গৃহ তুমি চিনতে পারবে । আমার অভাবে সেই গৃহ আজ নিশ্চই শ্রীহীন, সুর্য অস্তমিত হলে পদ্মের কি আর সেই সৌন্দর্য থাকে?
২১)
দ্রুত নীচে নেমে আসার জন্য তোমাকে হস্তিশাবকের মত ক্ষুদ্র আকারে প্রথমে যে ক্রীড়াশৈলের কথা বলেছি সেই ক্রীড়াশৈলের সানুদেশে এসে বসতে হবে , তারপর তোমার বিদ্যুতের আলো মৃদুভাবে গৃহের মধ্যে নিক্ষেপ করবে, জোনাকীর শ্রেণী যেমন মিট মিট করে জ্বলে ঠিক সেই রকম মৃদু বিদ্যুতের চোখে তুমি দেখবে ।
ছবি-১৫/ ১৮ : হস্তিশাবকের মত ক্ষুদ্রবেশে মেঘদুত
২২)
তুমি যাকে দেখতে পাবে তিনি তম্বী, তিনি শ্যমা , পক্ক দাড়িম্ব বীজের মতো সুক্ষ শিখরযুক্ত তার দাত , পক্ক বি-বফলের তুল্য তার অধর, ক্ষীণ কটি, গভীর নাভি, নিতম্বের গুরুভারে শিথিল গতি , স্তনভারে সামান্য আনত , তোমার মনে হবে যুবতী সৃস্টিতে তিনিই বিধাতার প্রথম আদর্শ।
ছবি -১৬/১৮ : যক্ষ প্রিয়া
২৩)
তাকেই জানবে আমার দ্বিতীয় জীবন রূপে! আমি তার সহচর , দুরে পড়ে আছি- চক্রবাককে হারিয়ে চক্রবাকীর মতই সে একা, বেশি কথা বলেনা, বালিকা বয়সের এই দিন গুলি তার কেটে যাচ্ছে কঠিন বিরহে, গাঢ় উৎকন্ঠায়, আমার আসঙ্কা তুষার পীড়িত কমলের মতোই তার সৌন্দর্য এখন অন্যরূপ হয়ে গেছে ।
২৪)
অবিরল অশ্রুপাতে তার নয়ন স্ফীত ও দীপ্তিহীন , ঘন ঘন নিশ্বাসের উষ্ণতায় তার ওষ্ঠাধর মলিন , লবিত কেশপাশে মুখ ঢাকা, তাই অপ্রকাশিত –করতলে ন্যস্ত প্রিয়ার মুখ দেখলে তোমার মনে হবে , তুমি ঢেকে রাখলে চাঁদের যে দশা ঘটে , সেই দশাই তার হয়েছে ।
২৫)
আমার প্রিয়াকে হয় তো তুমি দেখবে আমারই কল্যানে পুজা পার্বণ নিয়ে ব্যস্ত কিংবা আমার বিরহক্লিষ্ট রূপ কল্পনা করে সে তারই ছবি আঁকছে, কিংবা হয় তো সে পিঞ্জরুথ মধুরচনা সারিকাকে প্রশ্ন করছে ,ওগো রসিকে ! তুমি তো প্রিয় ছিলে , তার কথা তোমার মনে পরে কি ?
ছবি -১৭ / ১৮ : পিঞ্জরুথ মধুরচনা সারিকাকে প্রশ্ন করছে যক্ষ প্রিয়া
২৬)
হয় তো দেখবে , মলিনবসনা আমার প্রিয়া কোলের উপররে ধীনতারা রেখে গান করছে – সেই গান আমারই নাম ও কূলের পরিচয়ে ভরা। সে গানের পদ সে নীজেই রচনা করছিল । কিন্তু তুমি দেখবে গাইতে গিয়ে ধীণার তার চোখের জলে সিক্ত হচ্ছে , বারম্বার মুছে নিয়ে চেষ্টা করছে তবু নিজেরই রচিত সুর আর মনে করতে পারছেনা ।
ছবি-১৮/ ১৮ : কোলের উপর ধীনতারা রেখে মলিনবসনা যক্ষ প্রিয়া গান করছে
২৭)
হয়ত দেখবে দরজার সামনেই এক বেদির উপর বিরহের দিন থেকে আরম্ভ করে প্রতিদিন একটি করে ফুল রাখতে , এতদিনে যতফুল জমে উঠেছে , তা সে গুনে দেখছে বিরহ শেষ হতে আর কত মাস বাকী ! প্রিয়ের সঙ্গে যখন বিচ্ছেদ ঘটে তখন এইসব উপায়ের সাহায্যেই বিরহিণী নারী চিত্তবিনোদন করে থাকে ।
ধন্যবাদ এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ।
সুত্র :
ড: মুরারিমোহন) সেন (২০০০) , মেঘদূত , নবপত্র প্রকাশন, কলিকাতা ।
শক্তি চট্টোপধ্যায়,(২০১৬), মেঘদূত, ফ্লিপকার্ট,ডাইস পাবলিশিং , কলিকাতা ।
বুদ্ধদেব বসু ( ২০১৬ ), মেঘদুত, আমার বই , বাংলা ব্লগ
ছবি সুত্র : গুগল
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:০৩