বাঁশ আমাদের সকলের কাছে একটি অতি পরিচিত উদ্ভিদ । বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ , মাগো আমার শুলক বলা কাজলা দিদি কই , যতিন্দ্রমোহন বাগচির কবিতার এ লাইন দুটো সকলের স্মৃতিতেই আছে জাগরূপ। বাঁশের গুন কির্তির নাই কোন শেষ । বাঁশের সকল প্রকার গুণের সাথে আমাদের পরিচয় নেই সবিশেষ । উদ্ভিদতত্ব মতে বাঁশ ফাঁপা কান্ড বিশিষ্ট একটি ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। বাঁশের বিস্তৃতি অতি ব্যাপক। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম বেশী এটা জন্মায় । এ দেশের বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট বাঁশের গুরুত্ব অপরিসীম । গৃহ নির্মাণ, মঞ্চ নির্মাণ, মই, মাদুর, ঝুড়ি, ফাঁদ, হস্তশিল্পসহ নিত্যদিনের ব্যবহার্য বিবিধ জিনিসপত্র তৈরির কাজে বাঁশের রয়েছে বহুল ব্যবহার ।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর ক্ষেত্রে বাঁশের মত এত ক্ষমতাশালী দ্বিতীয়টি আর নেই : অবিশ্বাস্যভাবে বাঁশ অন্য সব গাছপালার চেয়ে বেশী পরিমানে অক্সিজেন উৎপন্ন করে অপরদিকে অন্য যে কোন উদ্ভিদের চেয়ে বেশী মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে । তাই বিশ্ব ব্যাংক প্রতিশ্রুত বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলের অর্থ দিয়ে বাঁশ রোপন ও বিকাশ কর্মসুচীকে বেগমান করা আশু কর্তব্য ।
বাঁশ চাষ পরিবেশ বান্ধব ও বার্ষিক নবায়নযোগ্য: পরিপক্ক একটি বাঁশ প্রতি বছর নতুন শুট গজানোর মাধ্যমে নতুন বাঁশের জন্ম দেয় । তাই মুল উদ্ভিদটিকে ধ্বংস করা ছাড়াই স্বতন্ত্রভাবে এর থেকে প্রয়োজনীয় বাঁশ সংগ্রহ করা যায় নিয়মিতভাবে ।
বাঁশঝাড়
ভূ-নিম্নস্থ রাইজোম থেকে কচি কান্ডের কৌণিক ডগা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে একটি বাঁশ ঝারের সৃস্টি হয় । তুলনামূলকভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে (৩০-৬০ দিন) কচি ডগাগুলি পূর্ণ দৈর্ঘ্যে উপনীত হয়। এরপর গৌণ বৃদ্ধি চলতে থাকে এবং ২-৩ বছরের মধ্যে পরিপক্ক বাঁশে পরিণত হয়। পরিপুষ্ট বাঁশের রং ধূসর বা হলুদ
ছবি-২ : বাঁশ চারা ( শুট) গজানো ও বাঁশ ঝাড়
পৃথিবীর বুকে বাঁশই সবচেয়ে দ্রুততম বর্ধনশীল উদ্ভিদ , গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রজাতির কিছু বাঁশের শুটিং পর্যায়ে শিশুকালে দিনে চার ফুট পর্যন্ত বেড়ে উঠার রেকর্ড রয়েছে ।
বাঁশের বৈচিত্রতা
বিশ্বে প্রায় ১৫০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে । বাংলাদেশে জংলি ও আবাদি প্রকৃতির ২৬ প্রজাতির বাঁশ জন্মে, এর মধ্যে মৌলভি বাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ এলাকায় জন্মে দেশের সবচেয়ে বড় ও লম্বা প্রজাতীর বাঁশ । পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতীর বাঁশ জন্মে । ঢাকার শহরের অদুরে গাজীপুরের শালবলে জন্মে ছোট ছোট নলীবাঁশ , যা ঘরের সিলিং এবং বাঁশী তৈরীতে ব্যবহৃত হয় ব্যপকভাবে ।
ছবি-৩: শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছের বিখ্যাত বড় জাতের বাঁশ
বাংলাদেশের বাঁশের জাত নিয়ে পল্লী কবি জসিমুদ্দীন তাঁর অমর সৃস্টি নকশী কাথাতে দিয়েছেন
সুন্দর বিবরন , শুধু বাঁশের প্রকারই নয় বাঁশ নিয়ে হয়েছে সুন্দর কাব্য রচনা যেমনটি দেখা তার সে কবিতায় :
আশ্বিনেতে ঝড় হাকিল , বাউ ডাকিল জোরে
গ্রামভর্ –ভর ছুটল ঝপট লট পট সব করে
রূপার বাড়ীর রুসাই ঘরের ছুটল চালের ছানি
গোয়াল ঘরের খাম থুয়ে তার চাল যে নিল টানি।
ওগা’র বাঁশ দশটা টাকায় , সে গায় টাকায় তেরো,
মধ্যে আছে জলির বিল কিইবা তাহে গেরো,।
বাঁশ কাটতে চলল রূপাই কোঁচায় বেধে চিড়া,
দৃপুর বেলায় খায় যেন সে – মায় দিয়েছে কিরা ।
মাঝায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্ চকাচক্ ধার,
কাঁধে রঙিন গামছা খানি দুলছে যেন হার ।
মোল্লা বাড়ীর বাঁশ ভাল , তার ফাঁপগুলি নয় বড়;
খাঁ-বাড়ীর বাঁশ ঢোলা ঢোলা , করছে আড় মড়।
সর্বশেষে পছন্দ হয় খাঁ-বাড়ির বাঁশ :
ফাঁপগুলি তার কাঠের মত , চেকন-চোকন আঁশ।
অধিকাংশ প্রজাতির বাঁশ বড় আকারের উদ্ভিদ। এগুলি অনেক বৎসর যাবৎ অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং কদাচিৎ ফুল ধারণ করে। বাঁশের ফুল ধারণের বিষয়টি অনিশ্চিত স্বভাবের, দীর্ঘদিন পরপর ফুল আসে। তিন বছর থেকে ১২০ বছরের চক্রে ফুল আসতে পারে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৫-৬০ বছরের ব্যবধানে বাঁশ ফুল ধারণ করে। বাঁশের অধিকাংশ প্রজাতিই জমকালো ফুল প্রদানের পর মৃত্যুবরণ করে।কোন কোন ফুল থেকে বীজও হয়, তবে বীজ হওয়াটা অনিশ্চিত ।
ছবি-৪ : বাঁশের ফুল ও ফল
পরিবেশ বিশুদ্ধায়ন : বাঁশ জাতীয় উদ্ভিদ মাটি এবং জল থেকে ধাতু এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ নীজের শিকড়রের মধ্যে শোষনের মাধ্যমে বিশুদ্ধায়নের বিষয়ে খুব কার্যকরী বলে প্রমানিত ।
ছবি-৫ : বাশের শিকড়রের মাধ্যমে মাটির বিষাক্ত পরিবেশ বিশুদ্ধায়ন
উদ্ভিদ জাতীয় উককরণের মধ্য বাশ সবচেয়ে শক্তিশালী, ইস্পাতের থেকে অনেক কম হলেও এটা যথেস্ট শক্তির অধিকারী। ২৫ mm × ১০ m m পরিমান বাঁশের টেনসাইল শক্তি হলো ৯৪.৬০ N/mm² এবং ব্রেকিং ফোর্স হল ৪.৭৬ kN । অপরদিকে একই পরিমান স্টীলের জন্য টেনসাইল শক্তি হলো ৭৯২.৯০ N/mm² এবং ব্রেকিং ফোর্স হল ৩০৬.১৭ kN ( সুত্র:http://www.ijstr.org/final-print/nov2015/Comparative-Analysis-Of-The-Tensile-Strength-Of-Bamboo-And-Reinforcement-Steel-Bars ) । তবে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাঁশকে তার শক্ত অবস্থানে আনতে হবে । ইস্পাতের তুলনায় বেশী ভঙ্গুর বলে বাঁশেের রড বেশী লোড বিয়ারিং নির্মাণ কাজে ব্যবহার অনুপযোগী । যাহোক, বাঁশের এই শক্তির কারণে এখন আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে রড তৈরী করে একে ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক শিল্প কর্মে । বাঁশ দিয়ে তেরী রডের বিষয়টি এ লিখার অন্য অংশে দেয়া হয়েছে । মনে হয় বাঁশের শক্তির কথাটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বলেই তীতুমীর গড়েছিলেন বাঁশের কেল্লা যা পাক ভারত উপমহাদেশের স্বাধিনতা সংগ্রামের এক গৌরবময় স্মৃতি হিসাবে স্থান পেয়েছে ইতিহাসের পাতায় ।
ছবি-৬ : তীতুমিরের বাঁশের কেল্লা
নিরাপদ গৃহ নির্মাণে বাঁশ অনন্ন ; বিশ্বের এক বিলিয়ন মানুষ বাঁশের তৈরী ঘরে বাস করে । বাঁশ দিয়ে তৈরী ভবন অতী ভূমিকম্প সহনশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাই জাপানীরা বাঁশের বৈচিত্রময় ব্যবহারে বিশেষভাবে পারদর্শী ।
ছবি -৭ : জাপানীদের বাঁশের ঘর
অনেকই হয়ত জানেন না যে টমাস আলভা এডিসন প্রথম বৈদ্যুতিক বাতির মধ্যে বাঁশের ফিলামেন্ট ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই বাল্ব এর একটি এখনোও ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে , এবং সেটি এখনো জ্বলে । ১৮৭৯ সনে এডিসন উদ্ভাবিত বাল্বের কারবরানাইজড ব্যমবো ফিলামেন্ট ১২০০ ঘন্টা পর্যন্ত জ্বলতে সক্ষম ছিল ।
ছবি-৮ : বাঁশের ফিলামেন্ট দিয়ে টমাস আলভা এডিসন কতৃক তৈরী প্রথম বৈদ্যুতিক বাল্ভ
বাঁশের প্রাণ বড় শক্ত : জাপানের হিরোসিমায় পারমাণবিক বোমা হামলার পর সেখানে বাঁশের মধ্যেই প্রথম উদ্ভিদ জীবন ফিরে আসে । এছাড়াও, কিছু বাঁশ ( -) ২০ ডিগ্রী ফা. ঠান্ডাসহিষ্ণু ।
বাঁশ মানুষের জন্য পুষ্টিও যোগায় ; কচি বাঁশের নরম কান্ড শতাব্দী ধরে এশিয়া জুড়ে খাওয়া হচ্ছে , এতে রয়েছে জার্মেনিয়াম, যা কোষের বয়োবৃদ্ধি রোধে সহায়তা করে । খাদ্যগুন ও স্বাদের কারণে চীন, থাইল্যন্ড ও মায়ানমারে বাঁশ ভেজিটেবল হিসাবে বেশ সমাদৃত । কচি বাঁশের ডগা মুখরোচক সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী। এ ধরনের কচি ডগা স্থানীয়ভাবে বাঁশ কোরাল নামে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বর্ষার মৌসুমে বহুল পরিমাণে এটি খেয়ে থাকে।
ছবি -৯ : ব্যমবো ভেজিটেবল বা কচি বাঁশের তরকারী
থাই ,বার্মিজ ও ভিয়েতনামীরা বাঁশের ফাপানো কান্ডের ভিতরে জন্ম নেয়া শুয়োপোকা ধরে তেলে ভেজে মঝা করে খায় ।
ছবি-১০ : বাঁশের ভিতরে জন্ম নেয়া শুয়োপোকা তেলে ভেজে খাওয়া
বাঁশের শাখা ও পাতাও পশুদের জন্য ভাল পশুখাদ্য । বিশ্বের বিরল প্রজাতী পান্ডা কচি বাঁশ ও পাতা খেয়েই বেচে থাকে , এমন কি পৃথিবীর বৃহত্তর স্থল স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী হাতীর কাছেও বাঁশ পাতা একটি অতি প্রিয় খাদ্য ।
ছবি-১১ : পান্ডা এবং হাতীর বাঁশ ও পাতা খাওয়া
এদেশের গ্রামীন জনপদে ছোট ছোট খাল এবং নালা পারাপারের জন্য আবহমান কাল যাবত ব্যবহৃত হয়ে আসছে
বাঁশের সাকু । শুধু কি গ্রামীন জনপদেই , রাজধানীর কিছু খালের উপরেও দেখা যায় বাঁশের সেতু ।
ছবি-১২ : বাঁশের সাকু ও সেতু
শুধু সাকু আর সেতু হিসাবেই নয়, বাঁশ ব্যবহৃত হয় বাড়ীর ছাদ নির্মানের জন্য সেন্টারিং খুটি ও বড় বড় ভবনের নির্মাণ কর্মী ও কাজের নিরাপত্তামুলক কর্মকান্ডেও ।
ছবি-১৩ : নির্মাণ কর্মী ও কাজের নিরাপত্তামুলক কর্মকান্ডে বাঁশের ব্যবহার
বাঁশের মন্ড কাগজ তৈরীর জন্য বিখ্যাত এ কথা সকলে জানে । এরকম বাঁশ দিয়ে কাগজ তৈরীর কারখানা রয়েছে দেশে । ইদানিং বাঁশের মন্ড হতে বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যথা তুলা ও সুতা তৈরী হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বন করে, তাই এ বিষয়টিও যথেস্ট গুরুত্ব রাখে ।
ছবি-১৪ : বাঁশ হতে তৈরী মন্ড তথা পাল্প
পরিবেশ বান্ধব বাঁশতন্তুজাত সুতার তৈরী পোশাকের এখন বেজায় কদর বিশ্বের সকল উন্নত দেশের বস্ত্র বাজারে । কৃত্রিম তন্তুর তৈরী বস্ত্রের বিরোপ প্রতিক্রিয়ার কারণে ইউরোপ আমিরিকার ডিপার্টমেন্টার স্টোরে এখন বাঁশ তন্তুজাত বিভিন্ন ধরনের বস্ত্রের কদর যেতেছে বেড়ে । এ বস্ত্র দেখতে সুন্দর , নরম মোলায়েম , ভাজ পড়েনা , ইস্তারির প্রয়োজন হয়না , শীত গ্রীস্মে পড়া যায় সমান ভাবে । বাংলাদেশের রপ্তানীমুখী পোশাক শিল্প পুরাটাই নির্ভর করে আমদানি করা থান বস্ত্রের উপরে । তাই যদি বাঁশতন্তু হতে এদেশেই করা যেতো পোশাক তৈরীর জন্য সুতাও প্রয়োজনীয় বস্ত্র তাহলে কত না সহজেই দেশটি এই খাতে স্বনির্ভর হয়ে যেতো , পোশাক শিল্পটি হতো আরো লাভবান, আমাদের মিলিয়ন মিলিয়ন দরিদ্র নারী পুরুষ গার্মেন্টস কর্মীর মজুরীটাও যেতো অনেক বেড়ে । এর জন্য প্রয়োজন বাঁশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও লাগসই প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং বিনিয়োগকারীদের যথাযথ মনযোগ ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ।
ছবি-১৫: বাঁশ হতে তৈরী সুতা ও বস্র সম্ভার
এদেশের কুটির শিল্পে রয়েছে বাঁশের ব্যপক প্রয়োগ । বাঁশ দিয়ে তৈরী হচ্ছে মাদুর, চাটাই , হাত পাখা , ঝুরী, ধানের ডোলা, কোলা, আসবাব পত্র, খেলনা ঘর, খাট পালংক আরাম দায়ক বিছানা, মুর্তী ও ভাস্কর্য ।
ছবি-১৬ : বাঁশ জাত দ্রব্য
ছবি-১৭ : বাঁশের উপর মূর্তীর ভাস্কর্য শিল্পকর্ম
ছবি-১৮ : বাঁশের খাট ও বিছানা ( ব্যমবো তন্তু হতে তৈরী ম্যট্রেছ ও বালিশ)
ইদানিং আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বাঁশ হতে খুবই শক্তিশালী ও উন্নত মানের রড তৈরী হচ্ছে , জাপানীরা এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে । তারা বাঁশের তৈরী রড ব্যবহার করে ভুমিকম্প প্রবন এলাকায় বাঁশের ঘরবাড়ী তৈরী করছে । তাছাড়া শক্তিশালী ব্যমবো রড এখন মাছ ধরার ছিপ তৈরীতে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে । এরকম রডে তৈরী একটি মাছ ধরা ছিপের দাম দেশ ভেদে ২০০০ ডলারে বিক্রয় হয়ে থাকে । তাই বাঁশ এখন একটি উচ্চ মাত্রার ভেলু এডেড প্রডাক্ট হিসাবে বিবেচিত ।
ছবি-১৯ : বাঁশ হতে তৈরী রড ও মাছ ধরার ছিপ
বিভিন্ন প্রকার ঔষধী কর্মে প্রয়োগ সহ ব্যামবো ম্যাসেস এখন একটি অতি জনপ্রিয় ব্যমবো থেরাপী । হাতে পায়ে , মাঝায় , পিঠের বাত বিষ ব্যথায় , কিংবা রিলাকসেসনের জন্য এটা এখন অতি জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি । দুর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্তের অনেক শহড়ে গড়ে উঠেছে ব্যমবো থেরাপী সেন্টার । ব্যমবো থেরাপীর কতক চিত্র দেয়া হল নীচে :
ছবি-২০ : ব্যমবো থেরাপী )
ছবি-২১ : বাঁশ দিয়ে আকুপাংচার চিকিৎসা
দু:খের সাথে বলতে হয় বাঁশের সুন্দর সুন্দর বহুবিদ ব্যবহারের বাইরেও নিন্মের চিত্রের মত এর কিছু অপব্যবহার ও দেখতে পাওয়া যায় । তাই চাইনা পুলিশের বাঁশের লাঠিপেটা খেয়ে কেও দৌঁড়ায়ে পালাক জীবনটা হাতে নিয়ে ।
ছবি-২২ : পুলিশ কতৃক মিছিলকারীদেরকে বাঁশের লাঠি পেটা, মিছিল কারীদের হাতেও অবশ্য দু একটা থাকে
অবশ্য জমি জমার দখল নিয়ে বাশের লাঠির বহুল ব্যবহার আছে দেশের অনেক অঞ্চলে সেই আদিকাল থেকেই । ধানের জমির দখল নিয়ে মারামারিকে বলে সাঁঝ । কাহিণীর নায়ক রূপাইকে নিয়ে এরকম সাঁঝের মারামারির একটি দৃশ্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পল্লী কবি জসিমুদ্দীন তার নক্সীকাথার মাঠে ।
ও রূপা তুই করিস কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে?
বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে |
কি বলিলা বছির মামু ? উঠল রূপাই হাঁক ছাড়িয়া,
আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া |
লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে,
এক লাঠিতে একশ লোকের মাথা যে জন আসল দলে |
দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী,
গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি |
গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ায় লাঠি,
রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি |
রূপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, থাল বাজারে থাল বাজারে,
থাল বাজায়ে সড়কি ঘুরা হানরে লাঠি এক হাজারে |
তারি সুরে সব লেঠেল লাঠির, পরে হানল লাঠি,
"আলী-আলী" শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি
"মার মার মার" হাঁকল রূপা, --- "মার মার মার" ঘুরায় লাঠি,
ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি |
বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রূপার লোকও ফিরল বহু,
রূপা তবু নাচছে, গায়ে তাজা-খুনের হাসছে লোহু |
(মাঝে মাঝে লাইন বাদ দিয়ে কবিতাটি সংক্ষেপিত করা হয়েছে)
তবে বাঁশের এই লাঠি অনায়াসেই হতে পারে চিত্ত বিনোদনের জন্য খেলার উপকরণ । মনে প্রাণে চাই, বাঁশ পিটা নয়, বাঁশের লাঠি খেলা দেখার জন্য লোকজন দৌঁড়িয়ে এসে ভীর জমাক । গ্রাম বাংলায় বাঁশের লাঠি খেলার বেশ প্রচলন ছিল এক সময়, গ্রামীন এ খেলাটি এখন হারিয়েই যেতে বসেছে ।
ছবি-২৩ : গ্রামীন বাংলায় বাঁশের লাঠি খেলা
হেমন্তে নবান্নের উৎসবের আনন্দের অংশ হিসাবে শীতের আগমনীতে শুক্ল পক্ষে বাঁশের তৈরী সার্কাস মঞ্চে লোকজন উপভোগ করত বিশুদ্ধ বিনোদন । বাঁশের তৈরী সার্কাস প্যান্ডেলটিও দেখতেছিল মনোরম । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও রয়েছে বাঁশের তৈরী সুন্দর সুন্দর সার্কাস প্যান্ডেল ।
ছবি-২৪ : বাঁশের তৈরী চীনের বিখ্যাত একটি সার্কাস প্যান্ডেল
বাঁশের তৈরী সুউচ্চ চুড়া বিশিষ্ট মঞ্চে বিখ্যাত বেঙ্গল সার্কাস দল প্রদর্শিত ঝুঁকিপুর্ণ বাঁশের দুলনায় সার্কাস সে সাথে নিন্মের দৃশ্যের মত কিছু প্রাণঘাতি বিরল সার্কাস প্রদর্শনী বলতে গেলে এখন প্রায় উঠেই গেছে এ দেশ হতে । বিনোদনের অন্য মাধ্যম যথা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষের জন্য কৃত্রিম শুটিং নির্ভর ব্যপক বিনোদনের সুযোগ সৃস্টি হওয়ায় জীবন্ত এই সার্কাস শিল্পটি এখন অস্তিত্ব সংকটেই ভুগছে । তাই বিশুদ্ধ বিনোদনকারী অতি দক্ষ কৌশলী কলাকুশলীর এই জীবন্ত সার্কাশ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখার বিষয়টিও গুরুত্বের দাবী রাখে ।
ছবি-২৫ : বেঙ্গল সার্কাস দল প্রদর্শিত ঝুঁকিপুর্ণ সার্কাসের ছবি
দুনিয়ার সর্বত্রই বাঁশকে বলা হয় মিরাকল প্লান্ট । এর রয়েছে প্রভুত অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্ভাবনা । বানিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ করে এর থেকে বিপুল পরিমান আয় ও কর্ম সংস্থান করা যায় অনায়াসেই । আধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বন করে পৃথিবীর অনেক দেশই টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উন্নত জাতের বাঁশের চারা উৎপাদন পুর্বক এখন একর প্রতি বাৎসরিক ২০ টন পর্যন্ত বাঁশ আহরন করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে । সেরকমই উত্তর ভারতের একটি বাঁশ চাষ প্রকল্পের চিত্র নীচে দেখানো হলো ।
ছবি-২৬ : টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উন্নত জাতের বাঁশের আবাদ
বাঁশ চাষ সম্প্রসারন ও বাঁশ প্রেমিকদেরকে বাঁশের চারা সরবরাহের জন্য বিশ্বের অনেক দেশে রয়েছে নার্সারী । যেমন টি দেখা যায় আমিরিকার কালিফোর্নিয়ার ‘ব্যমবো সোর্সারীতে’ , সেখানে পাওয়া যায় গৃহস্থালী বাগানে লাগানো উপযোগী সৌখীন বাঁশের চারা গাছ যা গৃহস্থালী বাগানের শুভা বর্ধন করে ।
ছবি-২৭ : ব্যমবো তথা বাঁশ চারা নার্সারী
ঠিক অনুরূপভাবে আমরাও বাঁশ চাষ ও তার সম্প্রসারন ও বিকাশের জন্য গড়ে তুলতে পারি বাঁশ নার্সারী । টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উন্নতমানের দ্রুত বর্ধনশীল বাঁশের আবাদ প্রকল্প করতে পারি বাস্তবায়ন । বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিশ্রুত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের জলবায়ু তহবিলের অর্থ হতে গড়ে তুলতে পারি বাঁশের সবুজ বেস্টনি যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় রাখতে পারে গুরুত্বপুর্ণ অবদান । রক্ষা পেতে পারে আমাদের জীব বৈচিত্র , এমনিতেইতো বিবিধ মনুষ্যসৃস্ট পন্থায় সুন্দরবন সহ জীব বৈচিত্র আজ বিলুপ্তির সন্মূখীন ।
দোলনা হতে কবর পর্যন্ত সবখানেই বাঁশজাত দ্রব্যের প্রয়োজন পরে । দেশে রয়েছে লক্ষাধিক বাঁশ শিল্পী কিন্তু গ্রামীন বাঁশ শিল্পীদের জীবন বড়ই দুর্বিসহ ও করুন । যদিও তারা গড়েন অপরূপ শিল্পকর্ম তারপরেও তারা বাস করেন নিতান্ত কুড়ে ঘরে, ফুলের মত পবিত্র বংশধরকে কাধে নিয়ে চেয়ে থাকেন দুচোখ মেলে অনাগত সুখের নীড় রচনার স্বপ্নের দিকে ।
ছবি-২৮ : দেশের অবহেলিত বাঁশ শিল্পীর করুন জীবনাচার
আমরা কি পারব তাদের স্বপ্নের নীড় করে দিতে রচনা । সকলের সুসন্বিত প্রচেস্টায় বাঁশের আবাদ বৃদ্ধি ও উন্নতমানের প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এদেশের বাঁশকে আমরা নিয়ে যেতে পারি আরো অনেক উচ্চতায় সুখ সমৃদ্ধির সোপান তৈরীতে ।
বৃদ্ধকালে অনেকেরই অবলম্বন হয় বাঁশের লাঠি । কামনা করি কাওকে যেন যেন বাঁশের লাঠির উপর ভর দিয়ে জীবনের পথ চলতে না হয়, তাদের জন্য যেন সুন্দর সুস্বাস্থের একটি জীবন রচনা করে দিতে পারি, আপন ভুবনের কোন ক্ষেত্রেই যেন তাদেরকে বাশের লাঠির উপর ভর দিয়ে চলতে না হয়।
ছবি-২৯ : বাঁশের লাঠিটিই চলাফেরার জন্য বৃদ্ধার একমাত্র অবলন্বন
বাঁশ যেন হয় সুখের হাতিয়ার , এর থেকে যেন বের হয় মিস্টি মধুর জীবনের সুর , যেমনটি হতো শ্রীকৃঞ্চের মোহন বাঁশীতে । শেষ বেলায় আরো একটি বিষয় না বললেই নয় , আমাদের দেশের বাঁশ শিল্পীদের তৈরী বাঁশী এখন দেশের সীমা পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও দিয়েছে পারি । কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্রীমদ্দি গ্রামের অর্ধশত পরিবার মোহন, মরালী, মুখ, নাগিনী, ক্যালেন কিংবা পাখি এমনসব শ্রুতিমধুর নামের বাঁশি তৈরি করে বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলার বাঁশির নাম। শুনতে অবাক লাগলেও ঘটনা সত্যি। বাংলাদেশের তৈরি বাঁশি রফতানি হচ্ছে বিদেশে আর আনছে বিদেশী মুদ্রা। বাঁশি রফতানি হচ্ছে- সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে। তাই এখন শুধু কৃষ্ণই নন অনেক বিদেশী রাধিকার হাতেও উঠে এসেছে এদেশের শিল্পীর তৈরী ভুবন বিখ্যাত সুরেলা বাঁশের বাঁশি । এবার এখানে CLICK করে তেমনি এক রাধিকার বাঁশীর সুর শুনতে শুনতে এ লিখা পাঠের যবনিকায় চলে আসা যাক ।
ছবি-৩০ : কোন এক বিদেশী রাধিকার বংশীবাদন
পরিশেষে একটি কথাই বলা যায় বাঁশ যেন হয় শুধু মঙ্গলেরই প্রতিক ।
ধন্যবাদ এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ।
ছবি সুত্র : অন্তরজাল
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৫০