ঐ দেখা যায় তাল গাছ ঐ আমাদের গা ,ঐ খানেতে বাস করে কাণী বগের ছা । কবিতায় ও গানে সবসময় আমাদেরকে টানে তাল তমাল ছায়া ঘেরা , নীল আকাশের নীচে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে কাশবনের মায়াবী মৃদৃ মন্দ পরশে দাদী নানীর হাতে শরতের পাকা তালের সৌরভময় পিঠা পায়েশের স্বাদ নিতে । শরতের আগমনে গানে কবিতায় একে বরণ করে নিলেও দেখা যায় শরত বিলুপ্ত হল বলে অনেকেই আছেন আশঙ্কায় । এ প্রেক্ষিতে জোর দিয়েই বলা যায় যতদিন রবে নীল আকাশ ,তাল গাছ আর কাশবন ততদিন শরত হতেই থাকবে অবগাহন নীজ মহিমায় । তাল গাছই যেন শরতের প্রাণ ,নীল আকাশে মেঘের আনাগুনা সেসাথে বাজারে তালের সমারোহ দেখে সকলেই বুঝে যায় শরত এসে গেছে ।
তাল এক আজব উদ্ভিদ । পৃথিবীতে প্রায় ২৫০০ প্রজাতীর তাল/পাম জাতীয় বৃক্ষ আছে । বাংলাদেশেও বেশ কয়েক জাতের পামজাতীয় বৃক্ষ আছে যার মধ্যে কতক সৌখীন পাম , নারিকেল , শুপারী , খেজুর এবং তাল অন্যতম ।
ছবি-০২/২৪
এই ছবি ব্লগে মুলত দেশীয় তাল গাছ তার সাথে কিছু বিদেশী সৌখীন পাম জাতীয় বৃক্ষ পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে ।
পাম জাতীয় বৃক্ষগুলিকে তাদের আকার , কান্ড, পাতা , ফুল ও ফল দিয়ে স্বাতস্ত্র মন্ডিত ও চিহ্নিত করা যায় ।
পাম বা তাল জাতীয় বৃক্ষগুলি মুলত লম্বা সরু কান্ড বিশিস্ট হয় , তবে হ্রস্বাকৃতিও হয় । এর কোনটির পাতা হয় পাখীর পালকের মত কোন টির পাতা পাখার( ফ্যান ) মত ।
বীজ হতে তালগাছ জন্মায় । তাল এক পরম পরোপকারী বৃক্ষ , জন্মের পর বছর না পেরুতেই এই গাছ মানুষের সেবায় হয় নিয়োজিত । জন্মের পর হতেই এর পাতা থেকে পাখা তৈরীর কাজ হয়ে যায় শুরু , মানুষই নিয়ে যায় তা কিনে শান্ত শীতল বাতাস অনুভবের প্রয়োজনে ।
পাখা তৈরীর উপযোগী তালের চারা বৃক্ষ
ছবি-০৩/২৪ : ঘরে বসে তালের পাখা তৈরী
বাংলাদেশে খুব কম বাড়ীই আছে যেখানে একটি তালের পাখা নেই । বিদ্যুতের লোড শেডিংএর কারণে বলতে গেলে সবাই ঘরে একটি করে তালের পাখা রাখেন । ছোট বড় , ভাজ করা বা লম্বা হাতল বিশিস্ট হরেক রকমের তাল পাতার পাখা দেখতে পাওয়া যায় সর্বত্র। এটা এখন একটি কুটির শিল্প হিসাবে পরিগনিত । দেশের গ্রামাঞ্চলে ও সেমি আরবান এরিয়ায় অনেক জায়গায় পরিবারের সকলে মিলে এই কুটির শিল্পজাত পাখা তৈরী ও বিপননের কাজে নিয়োজিত আছেন ।
ছব-০৪/২৪
ছবি-০৫/২৪ : বাজারে তালের পাখা বিত্রয়
তাল গাছটি বড় হতে থাকে আর বিলুতে থাকে তার পাতা , গাছের কান্ডতে জড়িয়ে থাকা নীজ পাতার লস্বা বাটের প্রান্তদেশের চেপ্টা চাটি দুখানা পা বাড়িয়ে হাটি হাটি করে চলে যায় ছোবরা কারখানায় । পাতা যায় গরীবের কুটির রচনায় ।
ছবি-০৬/২৪ : তালের বেড়া, তালের ছাউনি , তালের খুটি তাল গাছের ফালীর মারুল আর টানায় তৈরী ঘর
শুধু কি মানুষই , তাল পাতার নীচে ও সে পাতা দিয়েই বাবুই পাখীও করে রচনা কারুকার্যময় মোহনীয় নীড়খানা , কুড়ে ঘর হলেও সে তো করতেই পারে অপরূপ শিল্পের বড়াই , যার দিকে চোখ তুলে সকলে তাকাই ।
ছবি-০৭/২৪ : তালগাছে বাবুই পাখীর নীড়
তাল পাতার ছোবরা যায় কারখানায় তৈরী হতে বিবিধ বাহারী নিত্য প্রয়োজনীয় দব্য সম্ভাবনা নীচে দেখানো হল তাদের কখানা ।
ছবি-০৮/২৪ : তালের ছোবরা দিয়ে তৈরী দ্রব্যাদি
জিও টেক্সটাইল হিসাবে তালের ছোবরা হতে তৈরী নেট/জালের এর রয়েছে বিশ্বব্যপী ব্যাবহার । নতুন রাস্তার ল্যন্ডস্কেপ , বাধ ও নদীর ভাঙ্গন ঠেকাতে এর রয়েছে সফল প্রয়োগ । এটা মাটির সাথে মিশে গিয়ে রোধ করে পরিবেশ বিপর্যয় । তালের ছোবরার জাল তৈরী করেছে নতুন এক সম্ভাবনা ।
ছবি-০৯/২৪ : তালের ছোবরা হতে তৈরী জাল :জিও টেক্সটাইল
তাল গাছটি খানিক বড় হলে ডোঙ্গা নৌকা করে একে অনেকেই ভাসায় বিলের জলে, নৌকা বাইচের কত আয়োজন কত ভাবে যে চলে, মেতে উঠে বানবাসী এলাকার মানুষ, পারি দেয় এ বাড়ী থেকে সে বাড়ীতে বর্ষাকালে তালের ডোঙ্গা মত নৌকায় ভেসে চলে ।
ছবি-১০/২৪ : তালগাছের ডোঙ্গার নৌকা বাইচ
তালের রস
তালগাছের মাথায় চড়ে গাছি সাহেব কোমরে কাছি বেধে তালের কুড়ি কিংবা মর্দা গাছের ফূলের ডগায় বিশেষ কৌশলে ঘটি বেধে তালের রস করেন আহরণ । কিছু তাজা রস তারা বিকায় , কিছু যায় তারির ভুবনে ( বিশেষ কায়দায় হাড়িতে ভরে রোদের তেজে চোলাই বাংলা মদের মত কিছু একটা উত্তেজক পানীয়) , রয়েছে এর চাহিদা বিকাল গড়ালে নিবৃত আনাচে কানাচের তারিখানায় কতক মানুষের কাছে ) ।
ছবি-১১/২৪ : তাল গাছ হতে রস আহরণ
কচি তালের শাঁস
ছবি-১২/২৪ : কচি তালের শাঁস কেটে পরিবেশন
এই তালের শাঁসে আছে অনেক গুণ , ১০০ গ্রামের একটি তালের শাঁসের ৯২ দশমিক ৩ শতাংশই থাকে জলীয় অংশ, ক্যালরি থাকে ২৯, শর্করা ৬ দশমিক ৫ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪৩ মিলিগ্রাম, খনিজ শূন্য দশমিক ৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৪ মিলিগ্রাম। শারীরবৃত্তীয় কাজে অংশ নেওয়া এই তালশাঁস খুবই উপকারী, শরীরকে দ্রুত শীতল করে তালশাঁস।
এর বেশির ভাগ অংশ জলীয়। ফলে শরীরের পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম, তালশাঁস শরীরের কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। এমনকি ক্ষয় হয়ে গেলে তা পূরণ করে , তারুণ্যকে ধরে রাখে।
তালের পিঠা
শরতের পাকা তালে ভরে গেছে বাজার। পিঠা তো খাওয়া হবেই, কেক বা ক্ষীর হলেও বা মন্দ কি
ছবি-১৩/২৪ : পাকা তাল হতে রস নির্যাস
তাল চিপে রস বের করা আর তা দিয়ে সুস্বাদু পিঠা তৈরীর পদ্ধতি সকলেরই জানা । এ ব্লগের আপুমনিরা তালের পিঠার বিষয়ে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ সেটা সকলেরই জানা । যারা এই মহুর্তে বিস্তারিত আরো জানতে চান তাঁরা পিঠা তৈরীর রেসিপিগুলো এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন ।
ছবি-১৪/২৪ : রকমারী তালের পিঠা-১
ছবি-১৫/২৪ : রকমারী তালের পিঠা-২
তাল গাছের চাষ
তালের চারা রোপন করে তা থেকে ফল ও সারবান কাঠ পেতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয় । এ জন্য এ গাছটির চাষ করতে অনেকেরই অনিহা দেখা যায় । তবে এই তাল বৃক্ষটি তার শিশুকাল থেকেই এর রোপন ও পরিচর্চাকারীকে অর্থনেতিক কর্মকান্ডে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে পারে, সে সম্পর্কে ব্যপক গন সচেতনতা ও তথ্যের আদান প্রদান আবশ্যক । তাল বা পাম জাতীয় বৃক্ষ যে শুধু ফলই দেয়না বরং এমন অনেক সৌখীন পাম বৃক্ষ রয়েছে যা বাড়ী কিংবা প্রতিষ্ঠান , পার্ক বা উদ্যানের শুভা বৃদ্ধি, রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে , প্রেসটিজিয়াস এধরনের একটি চারা গাছের মুল্যও অনেক বেশী । পৃথিবীর প্রায় সকল উন্নত দেশেই এখন অনেক পাম নার্সারীর বিকাশ লাভ হচ্ছে । আমিরিকার কালিফোরনিয়া পাম নার্সারিটি জগত জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে বিশ্বের দামী ও সৌন্দর্যময় পাম গাছের চারা উৎপাদনে । এ সমস্ত চারার কোন কোন টির দাম হাজার ডলারেও উপরে । কালিফোরনিয়া পাম নার্সারীর কিছু মুল্যবান পাম গাছের ছবি নীচে দেয়া হল ।
ছবি : ১৬/২৪ : কালিফোর্নিয়া পাম নার্সারী
ছবি -১৭/২৪ কালিফোর্নিয়া পাম নার্সারীর পাম গাছ -১
ছবি -১৮/২৪ কালিফোর্নিয়া পাম নার্সারীর পাম গাছ -২
ছবি -১৯/২৪ কালিফোর্নিয়া পাম নার্সারীর পাম গাছ -৩
ছবি -২০/২৪ কালিফোর্নিয়া পাম নার্সারীর পাম গাছ -৪
বাংলাদেশেও ইদানিং বেশ কিছু বৃক্ষ নার্সারীতে বিভিন্ন পাম জাতীয় গাছের চারা পাওয়া যায় । অনেক নার্সারির মত রাজদানীর অভিজাত এলাকা গুলশান লিংক রোডে ব্রেক ( BRAC) পরিচালিত একটি নার্সারীতেও বিভিন্ন ধরনের দেশী ও বিদেশী পাম প্লান্টের চারা পাওয়া যায় ।
ছবি-২১/২৪ : ঢাকার গুলশান লিংক রোডে ব্রেক ( BRAC) পরিচালিত নার্সারী
এছাড়া দেশের আনাচে কানাচে গ্রামীন জনপদের অনেকেই গড়ে তুলেছেন নার্সারী যেখানে বড় সুস্বাদু জাতের তালের চারা উৎপাদন করে সেগুলি আগ্রহী ক্রেতাদের নিকট বিক্রয় করা হয় ।
ছবি-২২/২৪: গ্রামীন জনপদে একটি নার্সারীতে তাল গাছের চারা জন্মানো ও বিক্রয়
জন্ম থেকে মৃত্যুর পরেও মানুষের কল্যানে নিয়োজিত এই তাল বৃক্ষটিকে গ্রামীন জনপদের মানুষ সযত্নে করছেন রোপন যার যার সুবিধামত জায়গায় । ছায়াতলে ফসলের জমির কোন ক্ষতি হয়না বলে এর চাষের প্রসার ক্রমে চলেছে বেড়ে দিগন্ত যোজন ধরে ।
গ্রামীন জনপদে তাল গাছের পরিকল্পিত চাষ
ছবি-২৩/২৪ : জমির আইলে সারী করে তাল বৃক্ষ রোপন ও পরিচর্চা
ছবি-২৪/২৪ : চারা রোপনের পর করলে পরিচর্চা সারি সারি তাল গাছ হবে যে এমন
আশা করা যায় তাল বৃক্ষের বিকাশ বাংলার বুকে শরতকে করবে ধারণ হয়ে অনন্য সাধারণ, এটা কখনো যাবেনা হারিয়ে।
শুধু শরতের জন্যই নয় ,কৃষি অর্থনীতিতে তাল গাছের রয়েছে অপার সম্ভাবনা । রাস্তার দু'পাশের পতিতজমি, অনাবাদি জমি, জমির আইল, বাড়ির আশপাশের পতিত জমিতে তালগাছ রোপণ করে গ্রামীণ জনগণের বাড়তি আয়ের উৎস সৃষ্টি করা ছাড়াও চিনি ও গুঁড়ের ঘাটতি অনেকাংশ মেটানো সম্ভব। তালের আঁশ, পাতা, কাঠ এসব টেকসই যুথসই আর আকর্ষণীয় কুটির শিল্পের বিশেষ উপকরণ। পরিকল্পনা করে ঝুঁকি বিহীনভাবে তালগাছ ভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নেয়া যায়।
গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছ হবে আগামী দিনের কৃষি, কৃষক ও পরিবেশের পরমবান্ধব। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, আইলা, সিডর, নার্গিস, শেফালী মোকাবেলায় তালগাছ মাথা উঁচু করে বুক পেতে দেবে মানব আর মানব বসতি রক্ষায়। শুধু এতেই শেষ না, পাখিদের নিরাপদ নিবিড় আবাস গড়বে তালগাছের নিবিড় বনায়ন। তাল গাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই তো বাবুই পাখীরা পৃথিবীর এত সব গাছ থাকতে একমাত্র তাল গাছকে বেছে নিয়ে নান্দনিকতার বুননে শিল্পের গাঁথুনি দিয়ে নকশীজালের নীড় তৈরি করে।
তালের লেপা বা শাস, তালের সুস্বাদু রস, কাঁচাতাল, সিদ্ধতাল, তালের পিঠা, তালস্বত্ব, তালপাতার পাখা, তালের নৌকা, তালের ব্যঞ্জরিত কুটির আইটেম আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে । পরিপক একটি গাছ থেকে বছরে অন্তত ৫ হাজার টাকা আয় করা যায়। অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়, ঝড়োহাওয়া ও জলোচ্ছ্বাস হতে উপকূলীয় বাড়িঘর, শস্য রক্ষা করতে পরিবেশ উন্নয়নে তালগাছের ভূমিকা অনন্য।
ধন্যবাদ এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৪