৬ই মে ঢাকার কাগজের ছোট শিরোনাম-- ”পৃথক ঘটনায় তিন নারীর মৃত্যু ” । ছোট খবর। তিনটি মৃত্যু হয়তো মিডিয়াকে নারায়নগঞ্জের ৭ মৃত্যুর মত বিচলিত করেনি। তাই খবরটি এসেছে অবহেলার সঙ্গে ভেতরের পাতায়। কারও তেমন চোখে পড়ার মত নয়। কিন্তু আমার কাছে খবরটির গুরুত্ব অন্য দশটি খুন অপহরনের খবরের চেয়ে কিছু কম নয়। কারনটা এবার খুলে বলি।
পত্রিকাগুলো বলছে--পুলিশ জানিয়েছে- এই তিনজনই মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এদের মধ্যে দুইজন গৃহবধূ ছিলেন। যাদের বয়স ৩৬,৪২ । তারা আত্মহত্যা করেছেন । ৪৫বছর বয়সী আরেকজন নারীও মানসিক রোগী; রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন। তারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ।
নারীর মৃত্যু অহরহইতো হচেছ । স্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ ছাড়া এর পেছনে রয়েছে হত্যা,ধর্ষণ ,নারী পাচার, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এর মত বহু কারণ । কিন্তু মানসিক রোগী হিসেবে নারীর মৃত্যু --তথা মানসিক রোগীর অপমৃত্যু আমাদের সমাজে নারীর পাশাপাশি মনোরোগীর প্রতি অবহেলারই বহি:প্রকাশ । আর অজ্ঞতা, কুসংস্কার ,মানবতাবোধের কমজোরী তো আছেই ।
তাই কোনভাবেই এই মৃত্যুগুলোকে আমি মেনে নিতে পারি না। কেননা এই রোগীদের মারা যাওয়ার কথা নয়। তারা কোন মরনঘাতি রোগেও ভুগছিলেন না। তারা মনোরোগের যে পর্যায়ে ছিলেন--সুচিকিৎসা পেলে আরও অনেক দিন পৃথিবীর আলো হাওয়া দেখতেন। ভাল থাকতেন। তাদের মৃত্যু হয়েছে কোন রোগে নয়। রোগের কারনে নয়। মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসা না পাওয়ায়।নিতান্তই অবহেলায় । এই অবহেলার দায় আমরা এড়াতে পারি না। তাদের আত্মীয়স্বজন এড়াতে পারেন না। সমাজ এড়াতে পারে না। মিডিয়া এভাবে এড়াতে পারে না। তাদের মৃত্যু ঘটেছে সোজা কথায় সমাজের--রাষ্ট্রের অসচেতনতা-অবহেলার কারনে।
প্রতি বছর ১০ই সেপ্টেম্বর সুইসাইড প্রিভেনশন ডে বিশ্বব্যপী পালিত হয় । আমাদের দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে । আত্মহত্যাকারীদের প্রতি দশজনের নয়জন মানসিক রোগে ভোগেন ।
আত্মহত্যার প্রবণতা কাদের মধ্যে দেখা যায় ?
বিষন্নতা রোগে আক্রান্ত এবং মাদকাসক্তদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশী দেখা যায় । বিষন্নতাগ্রস্ত রোগীদের ১১%-১৭%, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার ৩%, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের ৫%-১০% আত্মহত্যা করে থাকে। যাদের মধ্যে নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যেও এই প্রবণতা বেশী থাকে। যারা মৃগীরোগ ,দীর্ঘদিন শারীরিক রোগে ভুগছেন-- আত্মহত্যার প্রবণতা তাদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে । যারা পূর্বে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন তাদের ৩০%-৪০% রিস্ক থেকে যায় ।
বিষন্নতা রোগে রোগী নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। কোন কূল কিনারা না পেয়ে, কারও কোন সাহায্য সহযোগিতা না পেয়ে এরা এই পথ বেছে নেয় । বিষন্নতা রোগ সব বয়সে শিশু-কিশোর,পূর্নবয়স্ক এবং বৃদ্ধদের মধ্যে দেখা যায় । নারীদের ক্ষেত্রে প্রসবোত্তর সময়ে মানসিক রোগের আশংকা বেড়ে যায় । নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশন হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ দেখা যায়। যেমন ¯স্বামী ও শ্বশুরবাড়ীর দুর্ব্যবহার, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ,সাংসারিক কাজকর্মের অবমূল্যায়ন ইত্যাদি।
আত্মহত্যার প্রবণতা সিজোফ্রেনিয়া এবং অন্যান্য সাইকোটিক রোগীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় । আলগা কথা বা ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে অনেক সময় এরা আত্মহত্যা করে বসে ।
সমাজে যারা মানসিক চাপে আছেন,লোকলজ্জার ভয়ে ,কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারছেন না তাদেরকে অনুরোধ করছি দ্বিধাদ্বন্ধ ঝেড়ে ফেলুন।নারীদের প্রতি তথা মানসিক রোগীদের প্রতি সহনশীলতার হাত সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এবং যথার্থ চিকিৎসা নিন।