আমাদের বাড়িটা পাহাড়ের কোল ঘেষেই। ঘরের জানালা খুললেই পাহাড়। ইন্ডিয়ার পাহাড়। এলাকার নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর কর্মসংস্থান এই পাহাড়। তারা নিয়মিতই পাহাড়ে যাতায়াত করে। অবশ্যই অবৈধভাবে। বেশ কয়েকজনকে বিএসএফ ধরে নিয়ে চালান করে দিয়েছিলো। ১ মাস -৩মাস বিভিন্ন মেয়াদে জেল খেটে তারা বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। কিন্তু তাই বলে পাহাড়ে যাওয়া কমেনি কারো। আমাদের কিছুলোক যেমন পাহাড়ের উপর নির্ভরশীল তেমনি পাহাড়ের লোকজনও আমাদের উপর নির্ভরশীল। কারণ পাহাড়ে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো নয়। তার উপর বাংলাদেশের চাল দিয়েই তাদের চলতে হয়।
যাইহোক, এসব জীবিকা সন্ধানী লোকদের দেখাদেখি আমারও শখ জাগলো পাহাড়ে যাবো। তখন আমি ছোট। বাড়িতে একথা জানতে পারলে পিটিয়ে হাড় আলাদা করে ফেলবে। তাই চুপিচুপি এক বন্ধু (যে পাহাড় সম্বন্ধে একটা উইকিপিডিয়া। পাহাড়ের কোথায় কি, কখন বিএসএফ থাকে না, কতক্ষণ পরপর বিএসএফ আসে সব বিষয়ে পিএইচডি করে ফেলেছে।) নিয়ে চলে গেলাম পাহাড়ের কাছে। আমাদের পরিবার এই পাহাড়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো না।তাই পাহাড় সম্পর্কে আমার জ্ঞান কম।তখন আমার বয়স ৮-৯, ঠিক মনে নেই। গিয়ে দেখি ছড়ার কাছে(পাহাড়ের সঙ্গে লাগোয়া একটা ছোট নদী। আঞ্চলিক ভাষায় ছড়া/ছইড়্যা বলা হয়) কয়েকজন ভারত গমনোন্মুখ কাঠাল ব্যবসায়ী (বর্ষাকাল ছিলো তখন। বর্ষাকালে প্রচুর কাঠাল পাহাড় থেকে নামিয়ে আনা হয় যেগুলোর ক্রয়মূল্য ঢাকার বাজারের ৭ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ঢাকায় যে কাঠাল ৭০ টাকা তা পাহাড়ে গেলে ১০ টাকায় পাওয়া যায়।) বসে আছে। তারা আমাদের দেখে ধমকে সরিয়ে দিলো। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে গেলে অযথা কোলাহল করে বিপদ ডেকে আনতে পারে তাই। আমরা তিনজন সরে গেলাম। (পথে আরো একজন আমার মতই গোবেচারা বন্ধু যোগ দিয়েছিলো।)
তারা পাহাড়ে ঢুকে গেলে আমরাও পাহাড়ে উঠে পড়লাম। যেদিকে কাঠাল সেদিকে না গিয়ে মোটামুটি উঁচু একটা ঘন বেতকাঁটা আর ঝোপঝাড়পূর্ণ টিলায় উঠলাম।ওই টিলায় এক প্রকার মিষ্টি এসিডিক ফল পাওয়া যায়, স্থানীয় ভাষার কিশনাত ফল, শুদ্ধভাষায় কি জানিনা, যার নিচে কিডনী আকৃতির বীজ থাকে। অর্থাৎ বীজ ফলের নিচে ঝুলে থাকে (নগ্নবীজী/ব্যক্তবীজী উদ্ভিদ)। টিলায় উঠার একটি মাত্র রাস্তা। ঐ ফল খেতে খেতে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম।বাংলাদেশে বসেও খেয়েছি, তবে এরকম ডাঁশা মিষ্টি বড় গুলো কখন পাই নি। তাছাড়া অনেক উঁচুতে উঠে চারদিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। আরে! সবকিছু যে একেবারে কাছে চলে এসেছে! মনে হয় একলাফেই পৌছানো যাবে। বড়বড় খেতগুলো দাবার ছকের মত দেখাচ্ছে। অনেক দূরে কলমাকান্দার টাওয়ার (কলমাকান্দা, আমাদের উপজেলা শহর, নেত্রকোনা জেলায়। টাওয়ারটা গ্রামীণফোনের ছিলো।) দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রথমবার এত উঁচুতে উঠার আনন্দে আমরা সব কিছু ভুলে গেলাম। আমার তৃতীয় বন্ধুটিকে একটা জোঁকে ধরলো। তার সেকি চিৎকার! জোঁক আমিও ভয় পাই। তার ধারে কাছে গেলাম না। আমার উইকিপিডিয়া বন্ধুটিই জোঁক ছাড়িয়ে তাকে শান্ত করলো। তখনও জানতাম না কি বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে।
কিশনাত খেতে যখন গান করতে করতে নামতে যাবো তখন আমার উইকি বন্ধু হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লো। নিচে, নামার রাস্তার মুখেই তিন তিনটে বিএসএফ (সাধারণত চারজন একসঙ্গে থাকে সবসময়। একজন কোথাও গিয়েছিলো হয়তো।) দাড়িয়ে আছে। আমরা ভয়ে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললাম। তখন যদি আমাদের দুজনের (উইকি ছাড়া) মুখেরর ছবি কেউ তুলতো (তখন আমরা ক্যামেরাসহ মোবাইল দুএকটা দেখেছি বিভিন্ন সৌখিন ব্যক্তির কাছে, এন্ড্রয়েডের নামগন্ধ ছিলো না এলাকায়।)তাহলে তা নিঃসন্দেহে ভয় পাওয়া শিশুর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছবি হত। আমরা দুজনে এদিকে প্রায় কাপড় নষ্ট করে আল্লাহ আল্লাহ করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছি, ওদিকে উইকি পালানোর রাস্তা চিন্তা করতে করতে মাথার চুল ছিঁড়ছে। পাহাড়ের অন্য কোথাও হলে পালানো কোনো বিষয় ছিলো না, কিন্তু এখানে নামার রাস্তা মাত্র একটা, তাও কুখ্যাত বিএসএফ কর্তৃক অবরোধকৃত। ইতোমধ্যে তারা আমাদের দেখতে পেয়েছে এবং আমাদের দুরবস্থা দেখে নিজেরা হাসাহাসি করছে। উইকি কে বল্লাম ভাই বাঁচা। সে তখন উল্টোদিকে হাটা আরম্ভ করলো। টিলার শীর্ষে উঠে যেদিকে বিএসএফ তার বিপরীত দিকে নামা আরম্ভ করলো। কিন্তু ওদিকে যে শুধু কাঁটাভর্তি ঝোপ, কোনো রাস্তা নেই।রাস্তা নেই তো কি হয়েছে রাস্তা বানিয়ে নেব- এই অঙ্গিকার করে উইকি সামনে আমার বন্ধু মাঝে (সে আমার থেকেও কিছুটা ভীতু) আমি পেছনে অবস্থান করে রাস্তা তৈরি অভিযান শুরু করলাম। কিন্তু এত সহজ নয়। পাহাড়ি কাঁট+বেতকাঁটার ঘা যে খেয়েছে সেই বুঝবে এই ব্যথা। তার উপর খালি পা কারণ স্যান্ডেল নিয়ে পাহাড়ে উঠা মানে বাঁশ খাওয়া। যাইহোক, উইকি যেহেতু সামনে, সিংহভাগ কাঁটা সে খেয়ে কিছু আমার মাঝের বন্ধুর জন্য রেখে মোটামুটি নামার একটা রাস্তা তৈরি করে নামতে লাগলো।আমি তাদের তুলনায় কাঁটা খুবই কম খেলাম।তাও ভাগে যা পড়লো তা বর্তমানের একজন বালক খেলে ডাক্তারের দৌড়াদৌড়ি লেগে যাবে। কিন্তু মার খাবার ভয়ে এ সম্বন্ধে বাড়িতে কিচ্ছু বলিনি।
দীর্ঘ কাঁটা অভিযানের পর অবশেষে টিলার নিচে নেমে এলাম। দেখি প্যান্টের নিচে কতটুকু অংশের সেলাই কাঁটার আঘাতে হাওয়া হয়ে গেছে। তখনও আমরা ভারতের সীমানায়। বিএসএফ গুলো তখনো আমাদের উল্টোদিকে বসে আছে। আমরা পড়িমড়ি করে বাংলায় ফিরে এলাম। বাংলার মাটি যে কত মধুময় তা ঐ দিন ভালো ভাবে উপলব্ধি করেছিলাম। তখন ছোট্ট ছড়াটা পার হয়ে দেখি বিএসএফগুলো চলে যাচ্ছে। তাদের ডিউটি শেষ অন্য দল আসবে। আমাদের উইকি বন্ধুটি তখন গলার আওয়াজ এতদুর পৌছায় না দেখে ইশারার আশ্রয় নিলো। অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যে এভাবে কাউকে গালি দেওয়া যায় তা তখন ওকে দেখে বুঝেছিলাম। বিএসএফগুলো আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো। আমরা ভেবেছি সত্যি গুলি করে দেবে।কিন্তু উইকি বন্ধু জানালো এত সহজ নয়, আমরা বাংলাদেশে আছি। আমাদের একটা গোপনাঙ্গের কেশও নাকি তারা ছিঁড়তে পারবে না। তার কথা অবিশ্বাস করব তা সম্ভব নয়। সত্যি সত্যি তারা গুলি না করেই চলে গেলো।
আমরাও ফিরে এলাম। মাঠে কিছুক্ষণ ফুটবল খেলে কাদা মেখে বাড়ি ফিরলাম।জিগ্যেস করলে বাড়িতে বলবো ফুটবল খেলেছি। কাদামাখা দেখে অবশ্য কেউ কিছু জিগ্যেস করেনি। ঐদিন সারারাত কেবল এটুকুই ভেবেছি কিভাবে বেঁচে ফিরলাম। কানধরে তওবা করলাম আর পাহাড় নয়।
তওবা অবশ্য রক্ষিত হয়নি। কিছুদিন পরেই আরো উঁচুতে কাঠাল আনতে চলে গিয়েছিলাম। এত উঁচুতে বিএসএফের ভয় নেই কিন্তু বেরোনোর মুখে ভয়টা খুব বেশি।যদি ওৎ পেতে থাকে?
*এটা একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। অবৈধভাবে অন্যদেশে প্রবেশ আইনানুসারে দণ্ডনীয় কিন্তু যে বয়সে গিয়েছিলাম তখন দেশ বিদেশ জ্ঞান তেমন হয়নি। শুধু এটুকুই জানতাম পাহাড়ে গেলে বিএসএফের হাতে ধরা না খেলেই হলো।
** মোবাইলে লেখা। তাই টাইপিং ভুল ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৩