স্থির হয়ে কাজল বসে আছে , স্থির দৃষ্টি এক হাত দূরে বসে থাকা নীল প্রজাপতিটার দিকে ... ভারী পছন্দ হয়েছে প্রজাপতিটাকে ওর । প্রজাপতি ধরার ব্যাপারে সে খুব অপটু , তবু মনে মনে প্ল্যান কষছে কি ভাবে ব্যাথা না দিয়ে প্রজাপতিটাকে ধরা যায় ... তাই এমন ধৈর্য্য নিয়ে টার্গেটের দিকে তাকিয়ে থাকা । যখন সে মানসিকভাবে প্রস্তুত প্রজাপতিটাকে খাপ করে ধরার জন্য , তখনই কাজলকে অবাক করে দিয়ে প্রজাপতিটা নিজে কাজলের বাম হাতের উল্টো পিঠে এসে বসলো ! অন্য সময় হলে কাজল এটা নিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো , কিন্তু আজ প্রজাপতির পাখায় হালকা আদর করে ওকে উড়িয়ে দিল কাজল । মন ভালো নেই তার , একটুও ভালো নেই ।
প্রজাপতি ধরার পুরো ঘটনাটা ঘটছিল কাজলের পড়ার টেবিলে । কাজলের সামনে কেমিস্ট্রি বই খোলা কিন্তু সেটা খোলাই , কাজল সবসময়ের মত কালো কলম , পেন্সিল আর নীল কলম একসাথে ইলাস্টিক দিয়ে বেধে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে বইয়ে দাগাদাগি করছে না , চোখ বন্ধ করে সদ্য পড়া কোনো তত্ব বা সূত্রও আওড়াচ্ছে না । পাশে একটা খাতা খোলা , সেখানে একেকবার একেকভাবে শুভ্রের নাম লেখা হয়েছে , তবে খাতাটাও এখন অলস অবস্থায় পড়ে রয়েছে । কাজল পড়ালেখার সময় অমনোযোগী হতে চায় না , সময়ও অপচয় করে না তখন অযথা , কিন্তু আজ যেন কোনো কিছুই স্বাভাবিক নেই ... আসল কথা ... শুভ্রের সাথে যোগাযোগ বন্ধ কাজলের ।
প্রতিমাসেই যদিও এমনটা হয়েই থাকে , তবু কাজল বিষয়টার সাথে এখনো খাপ খাওয়াতে পারেনি । শুভ্রকে ছাড়া কাজলের চলে না । প্রতিদিন শুভ্রের সাথে একটু কথা বলা , ওর সারাদিনের খোজ নেওয়া - এসব করে যেন দূরে থেকেও কাছে থাকা হ্য় দুজনের । কথা বলার সময় মনে হয় শুভ্র তার সামনে বসে আছে , দুজনে সামনাসামনি গপ্পো চলছে । কিন্তু কাজলের বাবা ছুটিতে বাসায় আছেন এখন । শুভ্রের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই কাজলের .. কিন্তু রিস্ক নিতে চায় না সে । তাই বাবা থাকাকালীন যোগাযোগ বন্ধ থাকে ওদের। দুজনের সম্পর্কটা এখনো সিক্রেট । ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে এখন ওরা । দুজনে ক্যারিয়ার গুছিয়ে তারপর দাড়াবে দুই পরিবারের সামনে , জানাবে ভালোবাসার কথা , জানাবে সারাজীবন একসাথে থাকার ইচ্ছে । আর তারপর ? " স্বপ্ন এবার হয়ে যাবে বেলা সত্যি , এতদিন ধরে এত অপেক্ষা !"
" খাওয়ার সময় হয়েছে , খেতে এসো ।"
দরজার ফাক করে বাবার বলা এই কথাগুলো ছেদ ধরায় কাজলের চিন্তায় । চুপচাপ খেতে চলে যা্য সে । বড় হওয়ার সময় বাবাকে কাছে পায়নি সেভাবে , তাই বাবা আর মেয়ের পৃথিবী যেন কয়েক আলোকবর্ষ দূরে , সহজ হতে পারে না কাজল ওনার সাথে , তাই যেটুকু দরকার , সেইটুকুই ভাবের আদান-প্রদান তাদের । অবশ্য মায়ের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সে , মা প্রায় বন্ধুরই মত যেন । কিন্তু চাকরীজীবি মায়ের সেভাবে ওদের সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না ওকে । ভাত মাখতে মাখতে শুভ্রের পরিবারের কথা খুব মনে পড়ে তার। শুভ্রের বাসায় যাওয়া হয়েছে তার কয়েকবার । শুভ্রের বাবাকে একবারই দেখেছে । কিন্তু শুভ্রের মায়ের সাথে বেশ কয়েকবারই গল্প হয়েছে তার । ভারী সুইট মানুষ । অসুস্থ , তবু যতটুকুই দেখেছে ওনাকে কাজল , কখনো একবারের জন্যেও উহ করতে শোনেনি । যেমনটা কাজলের মা । মন থেকে এই দুই নারীকেই কাজলের খুব ভালো লাগে । শুভ্রের ফুপুর বাসায়ও গিয়েছে সে একবার । ভাই-বোনদের আড্ডা দেখেছে সেখানে । যদিও শুভ্র বলে কাজলের দেখা আড্ডা আসল আড্ডার কাছে কিছুই না । তবু ভালো লেগেছে কাজলের । নিজের জীবনে কখনো এমন ঘরোয়া আড্ডার অভিজ্ঞতা হয়নি তার । চুপিসারে কি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কাজল ??
রাতে খাওয়া সেরে নিজের পড়ার ঘরে আবার থিতু হয়েছে কাজল । শুভ্রের কথা ভাবছে বরাবরের মতই । ছোটবেলা থেকে একা থাকতে থাকতে একা থাকাটা অভ্যেস হয়ে গেছে কাজলের , কিন্তু তার একদম ভালো লাগে না এটা । নিজেকে প্রায়ই প্রাসাদের বন্দিনী মনে হয় তার । শুভ্র যেন ওর জন্য একটা মুক্ত দিগন্ত , যেখানে বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে সে । একমাত্র শুভ্র ছাড়া আর কারোর প্রতি নির্ভরশীল নয় কাজল । শুভ্র আসার আগে একাই থেকেছে সে , কিন্তু এখন শুভ্রকে ছাড়া থাকাটা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কষ্টকর । শুভ্র আসার পর পাল্টে গেছে কাজলের জীবন , কাজলের একান্তই নিজের ছোট্ট জগত টা সেজে উঠেছে নতুন ভাবে , এক নতুন খেলার সাথী পেয়েছ যেন সে । স্পষ্ট মনে আছে এখনো ৩ বছর আগের সেই দিনটা।
মানুষ ছোটবেলায় চঞ্চল থাকে , বড় হয়ে শান্ত হয় । কাজলের হয়েছে উল্টো । ফাইভ পর্যন্ত খুব ঠান্ডা মানুষ ছিল সে ,যত বড় হয়েছে তত ডানপিটে হয়েছে । বয়:সন্ধিতে যখন তার বাকি বান্ধবীদের চলা-ফেরায় সঙ্কোচ, লজ্জাবোধ আসতে শুরু করেছে , তখনও কাজল বলতে গেলে শিশুই মানসিকভাবে । এমনকি ক্লাস নাইনে ওঠার পরও শান্ত কিংবা লাজুক কোনোটাই হয়নি কাজল । লুকিয়ে লুকিয়ে সে তখনো জমিয়ে মিচকে শয়তানি করে বেড়াচ্ছে ঘরে বাইরে । সেই সময়েরই একটা দিন । শীতকাল চলছে তখন , কিন্তু ভারী সুন্দর একটা মিষ্টি রোদও উঠেছিল সেদিন । রোদ পোহাতে পোহাতে বুকমার্ক বানাচ্ছিল কাজল । হঠাৎ বাসার কাজের মেয়েটা বলে গেলো ২ জন ছেলে এসেছে , কাজলের সাথে দেখা করতে চায় । বিষয়টা অপ্রত্যাশিত , কারণ কাজল গার্লস স্কুলে পড়ে , তাই কারা এসেছে সেটা আন্দাজ করা কঠিন কাজলের পক্ষে । কারোর সাথে সাম্প্রতিক কালে আলাপও হয়নি যে দুম করে বাড়িতে হানা দেবে । ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে গেটের কাছে গেলো সে । দেখে ক্লাস ফাইভের এক সহপাঠী বন্ধু এসেছে , আমেরিকায় চলে যাচ্ছে বরারবরের মত , তাই জানাতে এসেছে । সাথে তারই এক বন্ধু এসেছে । ছেলেটা কাজলের অচেনা ।
বিদেশগামী বন্ধুটির সাথে কথা চলছিল কাজলের । কিন্তু ফাকে ফাকে বন্ধুর সাথে আসা ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করছিল সে , মানুষকে স্টাডি করার মত একটা নতুন মজার কাজ সে আবিষ্কার করেছে , তার জন্যই দেখার চেষ্টা । কিন্তু ছেলেটা যেন একটা কি !!! পারে না নিজের বন্ধুর ছায়ার পিছনে গিয়ে লুকায় । ফাস্ট ইম্প্রেশনে ছেলেটাকে বিশ্ব লাজুক মনে হয়েছিল কাজলের । পরের দিন নিজের সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর কাছে লাজুক ছেলেটার বর্ণনা দিতে গিয়ে যেন কাজল হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খায় ! কে জানে , হয়তো আর কখনো দেখা হবে না ছেলেটার সাথে ... তাই তাকে নিয়ে দু-একদিন ছেলেটাকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা । পুরোনো সহপাঠীর সাথে হঠাৎ আলাপের ঘটনার ব্যাপ্তি ঐটুকুই !
পৃথিবীটা গোল । চিরন্তন সত্যটা আবার প্রমাণিত হলো যখন দেড় বছর পর ছেলেটা আবার ফিরে আসলো কাজলের জীবনে , অপ্রত্যাশিত ভাবে ।
হ্যা পাঠক , আপনি ভুল করেননি , সেদিনের সেই লাজুক ছেলেটাই শুভ্র !
চলবে ....
বি:দ্র: পুরো গল্পের অর্ধেক যে , যার কথা না জানলে গল্পটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় ,
তার বয়ান জানতে নিম্নের লিংকে ক্লিক করুন
শুভ্র আর তার অপ্রকাশিত জীবন( দ্বিতীয় পর্ব): Click This Link