"তাহলে তুমি আর আমার সাথে থাকতে চাইছো না ?"- টেবিলে রাখা পেপারওয়েটটা নাড়াচাড়া করতে করতে সমীর বললো । আমি কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললাম ," দেখো , তোমাকে তো সব বুঝিয়ে বললামই । সো তোমার বোঝা উচিত , তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউরড। " অনেকটা বেপরোয়া হয়ে জবাব দিল সমীর
-" দেখো , এতদিনের একটা ফিলিং কি মিথ্যে ?? অল অন আ সাডেন , ইউ ফেল্ট সামথিং তারজন্য কি সব বদলে যাবে ?"
: আমার জীবনের যেকোনো ভাল মন্দ বোঝার ক্ষমতা , সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমার আছে। এতদিন যা-ই ছিল , কিন্তু এখন আমার মনে হয় , আমি ভবিষ্যতে তোমার সাথে ভাল থাকবো না ।
- কিন্তু কেন ? আমি তো কখনো তোমার সাথে থাকতে কোনো প্রবলেম ফেস করিনি ।
: তুমি না-ই করতে পারো , কিন্তু আমি করেছি ।
- কি প্রবলেম ?
: দেখো , আমাদের কিছুই মেলে না । আমি মুভি দেখতে ভালোবাসি , তুমি বই পড়তে ভালোবাসো । আমার রক মিউজিক ভালো লাগে , ইউ আর মোর ইনটু হেমন্ত-কিশোর এন্ড অল ...
- এইটা তো কোনো ব্যবধানই না ... চয়েজ একেকজনের একেক রকম হবেই ... শুধু সেটা ক্ল্যাশ না করলেই চলে ।
: এই যে এখানেও আমাদের ভিউ মেলে না .... আর সব কথার এক কথা হল আমি রাকিনের সাথে সেই বন্ডৎা , সেই হ্যাপিনেসটা ফিল করেছি যেটা তোমার সাথে আদৌ সম্ভব না , এন্ড আই আম ডিপলি ইন লাভ উইথ হিম । সো আই ওয়ান্ট আ ব্রেক আপ ।
সমীর একটা ছোট্ট নি:শ্বাস ছাড়লো ... বিশাল একটা স্কাইস্ক্র্যাপারের ২০ তলায় ওর অফিস। কেবিনের দক্ষিণ দিকটায় একটা জানালা আছে বড়সড় , সামনে দাড়ালে গোটা ঢাকা শহরটাই যেন চোখে পড়ে ... ভাবুক সমীরের এই জানালাটা বরাবরই পছন্দন। হাতে করে কফি মগটা নিয়ে জানালার সামনে আমার দিকে পেছন দিয়ে দাড়ালো সে । আমি ফিসফিস করে ডাকলাম ," সমীর ?" .... কন্ঠে অযাচিত গাম্ভীর্য নিয়ে সমীর জবাব দিল " ব্রেক আপ এত মুখে বলে বলে করা লাগে না লিলি .... " আমি আর দাড়ালাম না ওখানে , কেবিন থেকে বেরিয়ে লিফট বেয়ে নেমে গেলাম । নিচে রাকিন তার প্রিয় স্করপিয়নটা নিয়ে দাড়িয়ে আছে । আমাকে দেখেই বললো ,
- কি ? কানাবাবা কি কয় ?
: কি আর বলবে ? ব্রেক আপ করেছে ...
-ইয়েস , আই নিউ ইট ... তোমাকে বলেছিলাম না যে ও এমনিতে হেভি জেন্টেলম্যান , বাড়াবাড়ি করবে না .... কিন্তু , কান্নাকাটি করে নাই তো ??
: করলেই আমার কি ???
- হ , তাও ঠিক .... তো এবার কি জান্ ?
: এবার শুভস্য শীঘ্রম ....
বলেই আমিও হেসে ফেললাম , রাকিনও হেসে ফেলল.... কি জানি ? হয়তো উপর থেকে তখনো অভ্যাসবশত সমীর নিচেই তাকিয়ে আছে ..!
১০ বছর হতে চললো এসব ঘটনার । হঠাৎ করে এসব মনে পড়ার কোনো কারণ থাকার কথা না , নেই ও । সমীরের ভালোবাসাটা ছিল অত্যন্ত শৈল্পিক , খুবই গভীর যার প্রকাশ ছিল কম , অনুভব ছিল বেশি । আর রাকিনের ভালবাসা ছিল উদ্দাম ধরণের । তার মোহেই ওকে বিয়ে করেছিলাম । একটা ৮ বছরের মেয়েও আছে আমাদের , নাম ধারা । মেয়ের বয়স যখন ৪ বছর তখন আমাদের ডিভোর্স হয় । অবশ্য এটা হবে বোঝাই যাচ্ছিল , আমাদের পছন্দের ফারাক খুব কমই , তবুও কখনো সেভাবে বনিবনা হয়নি আমাদের । তাই হয়তো ডিভোর্স , আর তার ৫ মাসের মাথায়ই রাকিন এক রাশিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে জার্মানিতে চলে গেল । এখন আর যোগাযোগ সেভাবে হয়ও না । আমিও বিজি থাকি অফিসের কাজে আর মেয়েকে নিয়ে । পুরোনো স্মৃতি ঘাটার ফুরসৎ কই ! আজ মেয়েকে পড়তে বসিয়ে দিয়ে বইয়ের শেলফটা ঘাটতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা " পেলাম , সমীরের দেয়া । তাই হঠাৎ ১০ বছর আগের ফ্ল্যাশব্যাক চোখে সামনে । বইটা কখনো পড়িনি আমি , গিফট পেয়ে সাজিয়ে রেখে দিয়েছি। আজ প্রথমবার খুলে দেখি গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-
" ভালোবাসা মানে পরষ্পরের ভিন্নতাটাকে মুছে দেয়া নয় ,
বরং সেই ভিন্নতাটা উপলব্ধি করা ,
ভালোবাসা মানে পরষ্পরের প্রতিবিম্ব হওয়া নয় ,
বরং একটা শরীরের ছায়া হয়ে ওঠা .... ভালবাসি তোমাকে ... "
অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম লেখাগুলোর দিকে , নির্বাক । হ্য়তো বুকের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসও সন্তর্পনে বেরিয়ে গেল , জানি না , কিংবা জানলেও স্বীকার করতে চাই না আমি । ধারা শুনছি আওয়াজ করে পড়ছে " ফসিল ফুয়েলস আর নট রিসাইক্লেবল ...."
শুধু কি ফসিল ফুয়েল , কতকিছুই তো আমরা চেয়েও রিসাইকেল করতে পারি না । তবু খুব জানতে ইচ্ছে করছে আজ । সমীর , তুমি কি এখনো স্কাইস্ক্র্যাপারের জানালায় আমার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকো ?