অবশেষে গাড়িতে উঠে একটু স্বস্তি বোধ করছি । আর ২ ঘন্টার মধ্যেই পাপার কাছে পৌছে যাব আমি । যাক , শান্তি। সোনাদিঘী নাম টা যত সুন্দর , যত কাব্যিক , এখানের জলবায়ু ঠিক ততটাই বিষাক্ত । আর মানুষগুলো , বিশেষত জমিদারবাড়ির ঐ মহিলাটি !! ওনাকে তো , ওনাকে তো ডাইনী বললেও কম বলা হবে । আমার পুরো পরিবারের জীবনটা ধ্বংস করেছেন উনি , অথচ এ নিয়ে তার বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই । তাও এবার তার প্রতি বৈরীভাব দূর করার একটা প্রচেষ্টা নিয়ে এসেছিলাম । কিন্তু উনি ?? উনি এতগুলো বছর পরেও একটুও বদলান নি । আজও কি না আমার সামনে ঐ লোকটার সাথে ... ছি: ছি: , ভাবতেই গা টা রি রি করছে। আমাদের ড্রাইভার সুজন ভাই হঠাৎ পেছন ফিরে বললেন " ম্যাডাম , উনি যে পিছন পিছন আসছেন । গাড়িটা কী থামাবো ?" আমি যথেষ্ট কঠিন গলায় বললাম " পাপা আপনাকে বলে নাই সুজন ভাই যে আমি না বললে রাস্তায় কোথাও গাড়ি থামানো আমার পছন্দের নয় ??" সুজন ভাই ধমক খেয়ে বেশ থতমত হয়ে বললেন " না , মানে .... আচ্ছা , ঠিক আছে ।" সোনাদিঘী ছাড়ার সময় পেছন ফিরে দেখার মত রুচি নেই আমার। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি , মহিলা বেশ চেঁচাচ্ছেন " মোহনা , মোহনা !! মা আমার , যেও না এভাবে ... সবটা না শুনে প্লিজ তুমি এভাবে চলে যেও না !" হাঁহ !! পারেনও ভদ্রমহিলা নাটক করতে ! আরে ভদ্র কাকে বলছি !! ছি: ছি: .... " সুজন ভাই , তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালান তো ! আর এক মুহূর্তও এখানে নয় !"
প্রায় আড়াই ঘন্টা পর আমার কালো ল্যান্সারটা আমার বাড়ির নিচে এসে থামলো । " হোম , সুইট হোম " মৃদু স্বরে বললাম আমি , কিন্তু মাথার মধ্যে তখনও ঘূর্ণিঝড় চলছে , যা দেখেছি তা কিছুতেই চোখের সামনে থেকে সরছে না । প্রতিটা স্টেপে যেন ঐ রাগটাই পড়ছে বেশি করে .. হিল জুতোর খটখট আওয়াজ থেকে লিফটের বোতাম টেপা সবকিছুতেই । বাড়িতে ঢুকেই ঢকঢক করে ডাইনিং টেবিলে রাখা বোতল থেকে পানি খেয়ে নিলাম অনেকটাই । পাপা ডিভানে বসে পেপার পড়ছিল । আমার আওয়াজ পেয়ে বললো " মাই প্রিন্সেস , আর ইউ হেয়ার ??" " ইয়া , আ'ম ব্যাক..." " সো আর্লি ? এনিওয়ে ইটজ গুড দ্যাট ইউ আর হেয়ার ফাইনালি ... আই ওয়াজ মিসিং ইউ আ লট " ," সেম হেয়ার পাপা .... " কথাটা শেষ না করতেই আমার ফিফি তরকারি হাতে ডাইনিং এ ঢুকলেন । আমার ফিফি হলেন আমার ফুপু ।পাপা বিজনেসের কাজে দেশের বাইরেই বেশী থাকেন তাই ফিফি আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী । আমার যাবতীয় আবদার , খুনসুটি সবই ওর সাথে।আমায় দেখে মনে হয় ফিফি আকাশ থেকে পড়লো । বললো " এই , তুই এখানে ক্যান মোহনা !!! কখন আসলি !!" ফিফিকে আমি কখনো কথায় ছাড় দেই নাই , এবারও দিলাম না । বললাম " আমি আসাতে কি তোমার প্রবলেম হইসে ফিফি ?? আর বাই দা ওয়ে , অনেকবার বারণ করসি আমাকে মোহনা না ডাকতে ! আমি মাহিয়া , মোহনা না !"ফিফি আমার কথা খুব একটা কানে তুললো বলে মনে হলো না । বললো " তোর তো এখন সোনাদিঘী থাকার কথা । হুট করে চলে এলি কেন ?" এবার পাপা বলল " আহ শানু ! তুই জানিস না আমার প্রিন্সেস এখানে কত সমাদরে থাকে ! নিশ্চয়ই ওখানে ওর কোনো অযত্ন হয়েছে !" ফিফি বেশ রাগী গলায় বললো " বাজে কথা বলো না ভাইয়া । ও বাড়িতে যে ওর অযত্ন হওয়ার কোনো সুযোগ ই নেই এটা তুমিও ভালো করে জানো , আমিও জানি , আর কেউ না জানুক !" আমার একে তো মাথা গরম , তার উপর এখানে যা একটা নাটক শুরু হয়েছে .... বিরক্ত হয়ে রীতিমত চিৎকার করেই বললাম ," থামবে তোমরা !!! আমার থাকতে অসহ্য লেগেছে তাই চলে এসেছি , কেস ডিসমিস ! " এই বলে ঝড়ের গতিতে আমার রুমে চলে এলাম । মাথার ভিতরে ঘূর্ণিঝড়টা আরো উত্তাল হয়েছে মনে হয় । রেহাই পাওয়ার উপায় খুঁজছিলাম । শেষমেষ স্থির করলাম একটু ঘুমাবো । তাই করলাম
ফিফির সাথে আমার শান্তিতে জীবনযাপন নিয়ে একটা দ্বন্দ আছে । এই যেমন এখন আমি সারাদিন জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছি জেনেও ফিফি আমায় ঘুম থেকে উঠানোর অনবরত চেষ্টা চালাচ্ছে । হুফফফ ! ফিফির ধৈর্য্যেরও বলিহারি ! হেভি নাছোড়বান্দা মাল ! অগত্যা পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বর্তমান প্রজন্ম হেরেই গেল ( এ্যাজ ইউজুয়াল )। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলাম আমি । বিরক্ত হয়ে বললাম " তোমার মত অমানুষ ফিফি আর দুটো নাই ! কার ঘরে আগুন লেগেছে যে এভাবে টেনে তুললে !" ফিফি আরো ডাবল বিরক্তি নিয়ে বলল " ভরসন্ধ্যায় এ কী আকথা বলিস , হ্যা!! ওঠ জলদি , ফোন এসেছে তোর ল্যান্ডলাইনে , যা গিয়ে কথা বল !" উঠে গিয়ে ফোনে ঘুম জড়ানো গলায় আওয়াজ দিলাম ," হ্যালো ?" অপর প্রান্ত থেকে মুগ্ধ ভাইয়ার কন্ঠ ," মাহিয়া আমি ভাইয়া । "
-হুম বলো , কোনো দরকার ?
: আমি বুঝছি তুমি টায়ার্ড , কিন্তু আসলে আমি আজকে রাতে ইউএস আর্মি হেড কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করবো । মাকেও নিয়ে যেতাম.... তো মা তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাইছেন ।
উফফফ ! এই মহিলা পারেনও ! আমার কথা বলার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না , তারপরও সিন ক্রিয়েট করতে চাইলাম না । অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললাম ," দাও , কথা বলছি " কিছুক্ষণ পর মহিলার আওয়াজ পেলাম ।
- হ্যালো মোহনা ?
: মোহনা নয় , মাহিয়া .... আপনার কি দরকার আমার সাথে ?
- মোহনা দেখো মা , তুমি আমায় ভুল বুঝেছ ।
: এটা ছাড়া আর কিছু ?
-মোহনা তুমি যেমন ভাবছ , বিষয়টা আসলে তেমন না
: আপনি কি এটা নিয়েই কথা বলার জন্য ফোন করেছেন ? তাহলে বলে দেই আমি এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না ।
- কিন্তু মা আমার আসলেই বিষয়টা পরিষ্কার করা দরকার । নইলে তুমি আমায় সারাজীবন ভুল বুঝে যাবে ।
: আমি আপনার সাথে ভাল-মন্দ কোনো কথা বলতে চাইছিলাম না , কিন্তু আপনাকে সম্মান দেয়া আসলে আপনার ধাতে সয় না । সো ...।দেখুন আপনার তো ধারণা যে সবাই আপনাকে ভুল বোঝে । বাট দা থিং ইজ , আপনার মত দুশ্চরিত্রা মহিলাকে বুঝতে কারোর আসলে ভুল হয় না !
- কি .... কি বললে তুমি আমায় ?
: শুনেছেনই তো কি বলেছি ! আরো শুনবেন ? আপনি .... আপনি হলেন দ্বিচারিণী , শুনেছেন আপনি ?
বোধ হয় , মহিলার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছে মুগ্ধ ভাইয়া । প্রায় চিৎকার করেই বললেন -
" চুপ ! একদম চুপ ! আমি কখনোই মাকে তোমার সাথে কথা বলতে দিতাম । ঐ বাড়ির বিষাক্ত আবহাওয়া তোমায় শুধু অহংকার করা ছাড়া আর কিছুই শেখায়নি ! খুব ঘেন্না না মাকে ? এই শেষ বার , আর চাইলেও কোনোদিন কথা বলতে পারবে না ওনার সাথে !"
মাথায় রক্ত উঠে গেছে আমার ! আজ ঐ মা আর ছেলেকে বোঝাবো আমি ! এমন সময় ফিফি ফোন কেড়ে নিল আমার হাত থেকে । চিৎকার করে বললো " এই তোর শিক্ষা !!! এভাবে একজন মানুষের সাথে কথা বলা !" আমিও বেপরোয়া এখন , বললাম " উনি কোনো মানুষের পর্যায়ে পড়েন না !"এবার পাপা কথা বললো " শানু , ও হয়তো ছোটমানুষ , বেশি বড় বড় কথা বলেছে , কিন্তু ভুল তো কিছু বলেনি !" হাত দেখিয়ে ফিফি থামিয়ে দিল পাপাকে । বলল " আর নষ্ট কোরো না তুমি মেয়েটাকে । এত ঐশ্বর্যের মাঝে মেয়েকে বড় করেছ এই তো গর্ব না তোমার ? হ্যা , ঐ বড়ই করেছ , মানুষ করোনি !" এবার আমি বললাম " ফিফি তুমি পাপাকে এভাবে বলতে পারো না ! নেমকহারামির একটা লিমিট রাখো !" " নেমকহারামি তো তুই করছিস ! শোন , তুই এসবের কিছুই জানিস না , এখানে বড়রা কথা বলছে , তুই অযথা ফোড়ন দিবি না !যা এখান থেকে !" এমনিও আমি আর এখানে দাড়াতাম না ! দৌড়ে চলে গেলাম চিলেকোঠায় ।
দুনিয়াটা চুরমার করতে ইচ্ছে করছে আমার ! বাস্কেটবলটা পুরোনো আলমারিটার উপরে ছুড়ে মারলাম । রাগ নামলো না , কিন্তু একটা ধুলোভরা ঝুড়ি নিচে পড়ে গেল । হঠাৎ কি আগ্রহ হলো জানি না , ঝুড়িটা ঘাটাঘাটি শুরু করলাম । কি কি বের হল ?? একটা পুরানো বাচ্চাদের জামা , ২ জোড়া ছোট ছোট জুতা , মাফলার , কান টুপি , আরো কত কি !! পুতুল , টেডি বিয়ার ইত্যাদির ফাকে দেখলাম একটা পুরাতন ডায়েরী মতন । কৌতুহলবশত খুলতেই একটা পুরানো ছবি নিচে পড়লো , এক মহিলার কোলে একটা বাচ্চা মাড়ি বের করে হাসছে , মহিলার মুখেও একটা প্রাণোচ্ছোল হাসি । ডায়েরী টার মাঝখান থেকেই পড়া শুরু করলাম ।
২৫ ডিসেম্বর , ১৯৯৬
আজকে রাত ৩:৫৫ তে মোহনা প্রথম পৃথিবীতে শ্বাস নিল । ওকে পৃথিবীতে আনতে খুব কষ্ট হয়েছে , কিন্তু ওর মুখটা দেখেই সব কষ্ট ঘুচে গেল আমার । ইশশ , কি পবিত্র মুখ , যেন স্বর্গের একটা ফুল আমার কোলে গড়িয়ে পড়েছে । ছোটবেলায় একটা পুতুল পেয়ে খুব আনন্দ হয়েছিল , আজ আবার সেই নির্মল আনন্দ আমার মনে । আমার সবটুকু দিয়ে ওকে বড় করবো । কক্ষনো বকবো না , কেবল আদর করবো । খুব দুরন্ত হবে ও । আমার মোহনা ....
হুহ !! মহিলার আদিখ্যতা দেখে বিরক্ত লাগছে আমার । তবুও পড়ছি , নেই কাজ তো খৈ ভাজ আর কি ! এরপরের দেড়মাস শুধু আমি কবে হাত নেড়েছি , নাকি বমি করেছি ইত্যাদি লেখা । ঢং ও ! এরপর ....
২৮শে নভেম্বর , ১৯৯৭
পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন ? আমায় মোহনার বাবা দুশ্চরিত্রা , অসতী বলছে ! আমি অসতী ?? কেন ? মোহনার কাপড় এক পুরানো কলেজ বন্ধুকে সাথে নিয়ে কিনেছি বলে , আর সেই বন্ধুটি ছেলে বলে ! তাহলে চরিত্রবান কে ? উনি কি তবে মহাপুরূষ ?? ওনার সেক্রেটারি লিনা তখন প্রেগনেন্ট , আমায় এসে বলল যে ও আমার স্বামীর বাচ্চা ক্যারি করছে। মেয়েটা কাদছিল । বলছিল ওর এই সন্তান চাই না , আমার স্বামীর নামে কোর্ট কেস করবে , ওনার রেপুটেশন বরবাদ করে ছাড়বে । তখন স্বামীর সম্মান রাখতে ওকে প্রেগনেন্সিতে সিংগাপুর আমি পাঠাইনি ? সিংগাপুরে ওর কোল আলো করে ১৯৯২ সালের ১৫ অক্টোবর ছেলে , মেয়েটা সন্তান চায়নি বলে ছেলেটাকে এডোপ্ট করলাম আমি । সেই থেকে ও আমার ছেলে , মুগ্ধ । আর আজ আমি দ্বিচারিণী ?? এমনকি আমার মোহনার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ঐ হারামি! সব ছেড়ে চলে যাব আমি । আমার মোহনা আর মুগ্ধ কে এই বাড়ির দূষিত পরিবেশে বড় হতে দেব না !
৩০শে ডিসেম্বর , ১৯৯৭
আর কিছুই করার রইল না আমার । কোর্ট মুগ্ধর কাস্টডি আমায় দিয়েছে , কিন্তু মোহনাটার কপালে ঐ জাহান্নামই রইলো ! হায় ! মেয়ে হওয়া কি এত বড় অভিশাপ ! আজ ওকে যখন আমার কোল থেকে কেড়ে নিল , চিৎকার করে কাদছিল ও ! এ কেমন বিধান তোমার ! আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল ।
জানি , ও সারাজীবন ঘেন্না করবে মাকে । তবুও ভালো থাকিস তুই মোহনা , সুখে থাকিস , খুব সুখে .....
আর কিছু লেখা আছে কি না জানি না অপর পাতায় , পাতা উল্টানোর মত শক্তি নেই আমার । ডায়েরি খুলে স্থির বসে আছি আমি । নিজের অজান্তেই চোখ থেকে এক বিন্দু লোনা পানি গড়িয়ে ঠোটের কোণে জমেছে , স্বাদ পেলাম তার , যখন নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্ফুট অথচ স্বত:স্ফূর্ত ধ্বনি বেরিয়ে এলো " মা " ......