আজ আমাদের বাড়িতে খুব হৈচৈ , আমি একক পরিবারে মানুষ , একমাত্র নিজের বিয়ের কয়েকদিন ছাড়া একসাথে এত মানুষ কখনো দেখিনি । অনীক থাকলে এখন খুব বিরক্ত হত , এত মানুষ একসাথে রাখা তার কখনোই পছন্দ ছিল না , বিশেষত তার অপছন্দের মানুষ হলে তো কথাই নেই , সারাদিন কপাল কুঁচকে বসে থাকত । আমি সবসময় মাথা ঠান্ডা রাখার চেস্টা করি কিন্তু আজ চেষ্টা করেও পারছি না । হঠাৎ ই মনে পড়লো আজ অনীকের ক্লাসমেট ও সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ইরার বিয়ে । ইরা এখন জার্মানিতে থাকে। ওকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এমন সময় আমার ছোট দেবর এসে বলল " ভাবী , কাজকর্ম সব শেষ ।" পিছন ফিরে দেখি তার ঘেমে নেয়ে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা । মুখে যেন একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ও বসানো , যেন আমার এখন ফোনালাপটা তার চিন্তার একেবারে বাইরে ছিল । তবুও ফোনটা নামিয়ে না রেখেই ওকে বললাম ," ঠিক আছে ভাই। রান্নাও প্রায় হয়ে এলো বোধ হ্য় । তুমি গোসলটা সেরে যাই হোক কিছু খেয়ে নাও । অনেক খাটাখাটনি গেছে তোমার ।" অবাক ব্যাপার , এরপরও আমার দেবরের মুখ থেকে আশ্চর্যবোধক চিহ্নটা সরলো না । একটু থতমত খেয়ে বললো " ভাবী , কোনো প্রবলেম ? হেল্প করবো ?"আমি মৃদু হেসে বললাম " আপাতত তুমি গোসল করে কিছু খেয়ে নিলেই আমার হেল্প হবে ।"আশিক কিছুটা হতাশ , কিছুটা অবাক হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও ইরার সাথে কথা সেরে বেরিয়ে এলাম ।
অনেক লোকের ভীড়ে আমার আর অনীকের সাজানো বাড়িটা রীতিমত বিধ্বস্ত হওয়ার যোগাড় হয়েছে। এমনিতেই মাথা গরম , তারপর শ্রাবণকে দেখে আরো বিরক্ত লাগল। শ্রাবণ আমাদের একমাত্র ছেলে , ফাইভে পড়ে। সমাপনীর পরীক্ষা চলছে ওর , কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা , এর মধ্যে আমার গুণধর ছেলে একঘর লোকের মাঝে বসে অবাক মুখে শোক-কীর্তন এবং তার দায়িত্ব কর্তব্য সম্বন্ধে ধারণা নিচ্ছে । যেহেতু আলোচোকরা হলেন অনীকের চাচী , ফুপু , মামী শ্রেণীর মহিলারা তাই বলাই বাহুল্য যে আলোচনাটা মোটেও শ্রাবণের উপযুক্ত নয় , তবুও শ্রাবণ শুনছে , না বুঝলেও বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ছে । গম্ভীর গলা্য় শ্রাবণকে ডাকলাম " শ্রাবণ তোর পড়াশোনা নেই ? সন্ধ্যে হতে চলেছে তুই এখনো এখানে বসে কি করিস ? কালকের পরীক্ষাটা কি আমি দেব ? যা পড়তে বস !" শ্রাবণ হালকা প্রতিবাদের স্বরে বললো " কিন্তু মা আজ তো বাবা ... " ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই শুরু করলাম আমি " বাবা থাকলেও এটাই বলত। যাও পড়তে বসো । " ছেলেটা কাচুমাচু মুখ নিয়ে পড়ার রুমে চলে গেল । ও চলে যাওয়ার প্রায় পরপরই অনীকের রাঙা ফুপু বলে উঠলেন " বৌমা তোমার সব ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি । পোলাটার মনটা খারাপ খামোখা পড়তে বসাইলা !" আমি জবাব দিলাম " ফুপু ওর কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা , এখন না পড়লে কাল খাতায় কি লিখবে বলেন তো ?" অনীকের আরেক মামী তখন ঝাঁঝালো গলায় বললেন ,"এসবের কুনো মানেই নাই । শুধু বকলে আর বকলেই কি পোলাপাইন মানুষ হয় নাকি ! আমরা কি তোমার পোলারে কু-পরামর্শ দিতাসিলাম নাকি যে তারে এমনে উঠায় দিলা !" আমি যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম " মামী , অনীক আপনাদের ছেলে , তার ব্যাপারে সমস্ত সিদ্ধান্ত আপনারই নিয়েছেন এবং আমি যেমন আপত্তি করিনি তেমনি শ্রাবণের ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ও আমার আছে। "কথাটা বলে আর দাড়ালাম না ঐ ঘরে । আমি জানি যে এখন বয়স্কা আত্মী্য়মহলে আমার আচরণের সমালোচনা শুরু হবে , আবছা কয়েকটা কথা যেন ভেসেও এলো কানে । কেউ যেন বলছে " বৌটার দেমাকে আর শ্বাস নেয়ার জো নেই !" উত্তরে কে একটা যেন বলছে " হুমম ... জামাইটা মরতে না মরতেই দেখবেন আবার বিয়ে বসেছে । কারোর তো আর কিছু হবে না , যা ক্ষতি আমাদের দাদুভাই্য়েরই হবে "
আমাদের বাড়িটা বরাবরের মত নিরিবিলি হয়ে এলো রাত ৮টার দিকে। আত্মীয়রা যে যার বাড়িতে চলে গেছে , একমাত্র আমার এক দেবর আর ননদ আজ রাতটা আমাদের এখানেই থাকবে। অগোছালো ঘরটা গোছাচ্ছি এমন সময় আবার কলিং বেল বাজলো । অপরিসীম বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দেখি আমার অফিসের পিয়ন সুজিত এসেছে , হাতে বেশ কয়েকটা ফাইল । গতদিন তাড়াহুড়ো করে সাইন করে আসিনি ওগুলো , আবার আর্জেন্টলি সাইন না করলেই নয় । তাই সুজিতকে পাকোড়া আর চা খেতে দিয়ে ওর সামনে বসেই সবগুলো চেক করে সাইন করে দিলাম । যাওয়ার সময় সুজিত বললো " ম্যাডাম , বড় সাহেব বিশেষ মাফি চাইসেন । আপনার এমন অবস্থা , সাহেবের এমনে .... আমরা আসলেই কস্ট পাইসি "আরো কিছু সে নিশ্চয়ই বলেছিল কিন্তু অতকথা খেয়াল করে শোনার মত ধৈর্য্য আমার তখন ছিল না ।
সুজিত চলে যেতেই রিডিং রুমে ঢুকলাম । শ্রাবণ মন দিয়ে পড়ছে তখন । ওর গালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বললাম " সরি বাবা , তোকে তখন বকার জন্য । শ্রাবণ তখন জড়িয়ে ধরে বলল " ইটস ওকে আম্মু , আমি কিচ্ছু মনে করিনি ।"দক্ষিণ দিকের বুক শেলফ টার পাশে অনীকের পড়ার টেবিল রাখা । আর টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কলম , নোটপ্যাড , একটা শেষ হতে চলা পেন্সিল আর গুটিকয় বিভিন্ন আকারের বই । অন্যসময় হলে আমি এগুলো গুছিয়ে রাখতাম , কিন্তু আজ ওর চেয়ারে বসে নোটপ্যাড আর কলম টেনে নিয়ে বহুদিন পর অনীককে চিঠি লিখতে বসলাম ....
প্রিয় অনীক ,
বহুদিন পর তোমায় লিখছি , তাই না বলো ?
তুমি তো জানোই আজ অফিসে বোর্ড অব ডিরেক্টরস এর সামনে আমার একটা প্রেজেন্টেশন ছিল । কাল রাতে অফিসেই প্রেজেন্টেশন তৈরী করছিলাম। রাত ১০টার দিকে নিশি ফোন করলো যে তোমার গাড়ির নাকি আ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বিশ্বরোডের কাছে। তোমাকে নাকি স্কয়ারে আনছে । রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল জানো ? ১২ টার দিকে হসপিটালে পৌছে শুনি তোমায় নাকি বাড়িতে নিয়ে গেছে । বাড়িতে এসে ড্রয়িংরুমে দেখলাম তোমায় ওরা একটা ফোমে মাটিতে শুইয়ে রেখেছে । আর কেউ জানুক আর না জানুক , আমি তো জানি যে তোমার ফোমে শুতে ভালো লাগতো না । ওদেরকে এত করে বললাম তোমায় ডিভানের উপর শোয়াতে , ওরা শুধু বাধা দিয়ে বলছিল লাশকে নাকি ডিভানে রাখতে নেই । অদ্ভুত তো ! এই যে কালও আশিক তোমার সাথে কোলাকুলি করে গেল , তোমার মা রুপমের হাতে করে তোমার জন্য তরকারি পাঠালেন , কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তুমি ভাইয়া অথবা বড় ছেলের পরিবর্তে লাশ কি করে হয়ে গেলে !তোমার মাথার কাছে তোমার মা খুব হাহুতাশ করে কাঁদছিলেন। এক আধবার তো বলেও ফেললেন যে আমি নাকি অপয়া , অলক্ষ্মী , তার ছেলেকে খেয়েছি । আমারো নাকি বেঁচে থাকতেই পুত্রশোক সইতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি । সবাই কাঁদছিল জানো ? এমনকি তোমার চাচাতো ভাই শরীফ , যে তোমায় সম্পত্তির জন্য মাফিয়া দিয়ে হুমকি পাঠিয়েছিল , সেও কাঁদছিল , সত্যি না অভিনয় তা আল্লাহই জানেন ! শুধু কাঁদিনি আমি আর শ্রাবণ । শ্রাবণ বেচারি তো ব্যাপারটার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে আমার বুকের কাছে মিশেই ছিল । আর আমি কি করে কাঁদি বলো তো ?? আমি কখনো তোমার বুকে মাথা না রেখে কেঁদেছি ???
গ্রাম থেকে তোমার বড়মামা এসে তোমায় গোসল করাবেন বলে তোমায় ওভাবেই সকাল অবধি রাখা হলো । আমি মাঝে তোমার ক্ষতগুলো ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে দিলাম । ঘরে কেউ ছিল না তখন , কপালে আলতো করে একটা চুমুও খেলাম তাই , ঠিক যেমন তুমি অফিসে যাওয়ার আগে করতাম ...অনেকক্ষণ ওরা তর্ক বিতর্ক করলো নিজেদের মধ্যে কোথায় তোমায় দাফন করা হবে এই নিয়ে । আমায় রুপম একবার জিজ্ঞেস করলো যে আমার মত কি , কিন্তু কিছু বললাম না , কারণ আসল মতটা বললে ওরা হয়তো পাগলামি বলবে .. আচ্ছা তুমিই বলো , তোমায় কি তুষারকন্যার গল্পের মত একটা কাঁচের কফিনে আমাদের ড্রয়িংরুমে রাখা যেত না ? তাহলে অন্তত তুমি তো এখানেই থাকতে , তোমায় চোখের দেখাটা তো দেখতে পারতাম । বলো , আমার চাওয়া কি ভুল ? ....... খুব খারাপ লাগছিল তখন , তোমায় যখন গোসলের পর আপাদমস্তক ঢেকে রাখলো ওরা , তোমায় শেষ কয়েকটা মুহূর্তের জন্যও দেখতে পারলাম না । ওরা কি বুঝবে বলো আমার আকুতি ? ওরা কি জানে যে কিভাবে আমি সবসময় অবাক চোখে তোমায় দেখতাম ?? কি পরম প্রশান্তি ছিল তার মধ্যে !
বিকেলে সবাই মিলে জানাজার পর তোমায় আজিমপুর গোরস্থানে রেখে এলো । শ্রাবণকে আমিই যেতে দিইনি । মনের মধ্যে যে ঘূর্ণিঝড় চলছিল ,শ্রাবণ না থাকলে হয়তো তার কাছে হার মেনে যেতাম আমি । ও হ্যা , ইরার আজ বিয়ে । ওকে ফোন করে শুভকামনা জানিয়েছি , বলেছি জিম উইলসনের সাথে ওর বিবাহিত জীবন যেন সুখের হয় , দূর থেকে আমি আর তুমি এই প্রার্থনাই করি । তুমিও এমন কিছুই বলতে হয়তো , তাই না ? ওকে তোমার খবরটা দিইনি । বিয়ের মত বিশেষ দিনে এমন একটা খবর দিয়ে আনন্দের আমেজ নষ্ট করার পক্ষে নিশ্চয়ই তুমিও নও ....
আজ অনেকেই অনেক কিছু হারিয়েছে , কিন্তু আমি হারিয়েছি আমার সোলমেটকে । যাকে ঘিরেই আমার বেঁচে থাকা ছিল । ডিভোর্সী বাবা-মায়ের সন্তান এই আমি যার কাছে প্রথম ভালোবাসা পেয়েছিলাম , অনাথ একজন আমি যার কাছে প্রথম আশ্র্য় পেয়েছিলাম , পরিবার পেয়েছিলাম , জীবন পেয়েছিলাম তাকে হারিয়েছি । আমার একমাত্র অভিভাবক , একমাত্র প্রেম , একমাত্র বন্ধুকে হারিয়েছি । মনে আছে , ভার্সিটিতে পড়াকালীন একদিন তোমার সাথে মান অভিমানের পর তোমায় বলেছিলাম যে তোমার সাথে বেঁচে থাকার জন্য একটা ৬০/৭০ বছরের জীবন যথেষ্ট না , আমি তোমার সাথে কমপক্ষে হাজার বছর বাঁচতে চাই । তুমি হাসতে হাসতে আমায় বুকে টেনে বলেছিলে " হ্যা রে পাগলি , হাজার বছর তোর যন্ত্রণা সহ্য করার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে !" তোমার হাজার বছর কি বিয়ের ১৩ বছরেই ফুরিয়ে গেল ? এখনো যে আমি তোমার সাথে মরুভূমিতে বেদুইন তাবুতে রাত কাটাইনি , এখনো যে তোমার সাথে এন্টার্কটিকায় সূর্যোদয় দেখা হয়নি ! এখনো যে আমি তোমার পাকা চুল বেছে দিইনি , এমনকি তোমায় ওষুধ খেতে ভুলে যাওয়ার জন্য বকাও হয়নি এখনো !! এত কিছু বাকি রেখেই চলে গেলে তুমি ?
তুমি সবসময় বলতে বেঁচে থাকা মানে আত্মাকে শরীরের সাথে বেঁধে রাখা , তাকে ঈশ্বরের সাথে এক হওয়া থেকে আটকে রাখা । মৃত্যুর পরই আত্মা নির্দ্বিধায় মিলতে পারে নিজের স্রষ্টার সাথে , এই নৈকট্য , এই মিলনেই তার মুক্তি । তবে কি তুমি নিজের জন্য মুক্তি খুঁজে নিলে ? আচ্ছা তুমি সুখি তো মুক্তি নিয়ে ? তবে সুখে থাকো তুমি , সুখে থাকুক ভালোবাসা ।
শুধু বলো , তুমি কি সত্যিই চলে গেলে ? সত্যিই মুখ ফিরিয়ে নিলে ? সত্যিই কি তুমি নেই ?" ......
অনীকের বুকে মাথা না রেখে আমি কাঁদতে পারিনা , কিন্তু চিঠিটা লিখতে লিখতে ভিতরে চলছিল অবিরাম রক্তক্ষরণ ... কলম থামাতেই নাকে এসে লাগল অনীকের আরমানি পারফিউমের গন্ধ ....